🔶 ভূমিকা
২০২৫ সালের ৩১ অক্টোবর মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে অনুষ্ঠিত ASEAN Defence Ministers’ Meeting-Plus (ADMM-Plus) সম্মেলনে ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এক ঐতিহাসিক প্রতিরক্ষা কাঠামো চুক্তি স্বাক্ষর করে। এই নতুন ১০ বছরের চুক্তিটি দুই দেশের প্রতিরক্ষা সম্পর্ককে এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার পথ সুগম করেছে।
চুক্তির আনুষ্ঠানিক নাম — “Framework for the U.S.–India Major Defence Partnership”, যা ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং ও মার্কিন প্রতিরক্ষা সচিব পিট হেগসেথ যৌথভাবে স্বাক্ষর করেন।
এই চুক্তি মূলত দুই দেশের সামরিক সহযোগিতা, প্রযুক্তি বিনিময়, যৌথ উৎপাদন, গোয়েন্দা তথ্য ভাগাভাগি এবং অপারেশনাল সমন্বয় জোরদার করার উপর ভিত্তি করে তৈরি। এটি কেবল প্রতিরক্ষা সহযোগিতার সীমারেখা নির্ধারণ নয়, বরং আগামী এক দশকের জন্য একটি নীতিগত রূপরেখা নির্ধারণ করেছে যা ভারত–মার্কিন সামরিক অংশীদারিত্বকে এক নতুন অধ্যায়ে পৌঁছে দেবে।
🛡️ চুক্তির মূল দিকসমূহ
২০২৫ সালের এই প্রতিরক্ষা কাঠামো চুক্তি ২০১৫ সালের প্রথম চুক্তির উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। নতুন কাঠামোটি আগের তুলনায় বেশি কৌশলগত, প্রযুক্তিগত এবং শিল্পভিত্তিক সহযোগিতা অন্তর্ভুক্ত করছে।
চুক্তির প্রধান দিকগুলো হলো—
- প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি সহযোগিতা বৃদ্ধি — দুই দেশ যৌথভাবে উন্নত সামরিক প্রযুক্তি বিকাশে বিনিয়োগ করবে।
- যৌথ উৎপাদন ও প্রযুক্তি স্থানান্তর — যেমন Stryker Armoured Combat Vehicle-এর যৌথ নির্মাণ প্রকল্প।
- তথ্য ও গোয়েন্দা বিনিময় ব্যবস্থার সম্প্রসারণ — ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে নজরদারি ও প্রতিরক্ষা সমন্বয় বৃদ্ধিতে গুরুত্ব।
- লজিস্টিক্স সহযোগিতা ও ইন্টারঅপারেবিলিটি — যৌথ মহড়া, সামরিক সরঞ্জাম সামঞ্জস্য এবং একে অপরের ঘাঁটি ব্যবহারযোগ্য করা।
- প্রতিরক্ষা শিল্পে বিনিয়োগ — ভারতীয় প্রতিরক্ষা উৎপাদন ক্ষেত্রে মার্কিন কোম্পানিগুলির অংশগ্রহণ সহজতর করা।
এইভাবে, চুক্তিটি কেবল সামরিক সম্পর্ক নয়, বরং প্রযুক্তি, শিল্প এবং কৌশলগত দৃষ্টিকোণ থেকে ভারত–মার্কিন সম্পর্ককে আরও শক্তিশালী করবে।
🌏 কৌশলগত প্রেক্ষাপট ও গুরুত্ব
ভারত–মার্কিন প্রতিরক্ষা সহযোগিতার কৌশলগত গুরুত্ব বহুস্তরীয়। এর পেছনে রয়েছে উভয় দেশের চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব ও সামরিক বিস্তারের প্রতি উদ্বেগ।
দুই দেশই এখন ইন্দো–প্যাসিফিক অঞ্চলকে “Free, Open and Rules-Based Region” হিসেবে গড়ে তোলার পক্ষে। ফলে, এই চুক্তি সরাসরি চীনের আগ্রাসী নীতির মোকাবিলায় যৌথ প্রতিরক্ষা প্রস্তুতির দিক নির্দেশ করে।
এছাড়া, এটি ভারতের জন্য এক বড় কৌশলগত সুবিধা সৃষ্টি করেছে —
- ভারত আর এককভাবে রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীল নয়।
- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সহযোগিতার ফলে উন্নত পশ্চিমা প্রতিরক্ষা প্রযুক্তিতে ভারতের প্রবেশাধিকার তৈরি হয়েছে।
- একই সঙ্গে, ভারত তার কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন (strategic autonomy) বজায় রেখে পশ্চিমা ও পূর্ব ব্লকের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করছে।
২০১০–এর দশকে ভারতের মোট প্রতিরক্ষা আমদানির ৭৬% রাশিয়া থেকে আসত। কিন্তু ২০১৯–২০২৩ সময়কালে সেই হার নেমে এসেছে ৩৬%–এ। এর অর্থ, ভারত এখন বহুমাত্রিক প্রতিরক্ষা অংশীদারিত্বে আগ্রহী এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সেই কৌশলের কেন্দ্রে অবস্থান করছে।
⚙️ ভারতের সামরিক সক্ষমতা বৃদ্ধিতে চুক্তির প্রভাব
এই ১০ বছরের কাঠামো ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর আধুনিকীকরণ প্রক্রিয়াকে আরও গতি দেবে।
চুক্তির আওতায় রয়েছে—
-
উন্নত সামরিক সরঞ্জাম প্রাপ্তি
ফেব্রুয়ারি ২০২৫ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বৈঠকে ভারতকে উন্নত মার্কিন অস্ত্র বিক্রির প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। যদিও ভারত শেষ পর্যন্ত F-35 স্টেলথ ফাইটার না কেনার সিদ্ধান্ত নেয়, তবে Javelin অ্যান্টি-ট্যাংক মিসাইল, নজরদারি সিস্টেম এবং যোগাযোগ প্রযুক্তি ক্রয়ের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। -
যৌথ উৎপাদন উদ্যোগ
ভারতের “Make in India” প্রকল্পের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে দুই দেশ Stryker Armoured Vehicles ও অন্যান্য প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম যৌথভাবে নির্মাণ করবে। এতে ভারতের প্রতিরক্ষা শিল্পে কর্মসংস্থান ও প্রযুক্তিগত দক্ষতা বাড়বে। -
ইন্টারঅপারেবিলিটি ও যৌথ মহড়া বৃদ্ধি
চুক্তির ফলে ভারতীয় ও মার্কিন সেনার মধ্যে সরঞ্জাম, সফটওয়্যার ও কৌশলগত প্রশিক্ষণে সমন্বয় আরও দৃঢ় হবে। এতে ভবিষ্যতে ইন্দো–প্যাসিফিক অঞ্চলে যে কোনো যৌথ সামরিক অভিযানে উভয় দেশ কার্যকরভাবে কাজ করতে পারবে। -
গোয়েন্দা ও নজরদারি সহযোগিতা
উন্নত রিকনেসান্স ড্রোন, স্যাটেলাইট যোগাযোগ, এবং সাইবার ডিফেন্স ব্যবস্থায় সহযোগিতা ভারতের প্রতিরক্ষা সক্ষমতাকে আরও বর্ধিত করবে।
এইসব উদ্যোগের ফলে ভারতীয় সেনাবাহিনীর কার্যক্ষমতা ও প্রতিক্রিয়া–ক্ষমতা উভয়ই উন্নত হবে।
⚖️ চুক্তির সীমাবদ্ধতা ও চ্যালেঞ্জ
যদিও চুক্তিটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, তবুও এর বাস্তবায়নে বেশ কিছু বড় চ্যালেঞ্জ রয়েছে।
রাশিয়ান নির্ভরতা ও CAATSA আইনের ঝুঁকি
ভারতের ৬০–৭০% সামরিক সরঞ্জাম এখনও রাশিয়ান উত্স থেকে আসে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের CAATSA (Countering America’s Adversaries Through Sanctions Act) আইন রাশিয়ার সঙ্গে সামরিক লেনদেনে যুক্ত দেশগুলির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারে।
ফলে, ভারতকে রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা ও মার্কিন সহযোগিতা—দুটির মধ্যে কূটনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা করতে হচ্ছে।
প্রযুক্তি স্থানান্তরে মার্কিন বিধিনিষেধ
মার্কিন Arms Export Control Act এবং ITAR (International Traffic in Arms Regulations) অনুযায়ী কিছু সংবেদনশীল প্রযুক্তি — যেমন নিউক্লিয়ার সাবমেরিন প্রোপালশন প্রযুক্তি — স্থানান্তর করা নিষিদ্ধ।
এটি ভারতের প্রতিরক্ষা আধুনিকীকরণে সীমাবদ্ধতা তৈরি করে।
ভারতের অভ্যন্তরীণ প্রশাসনিক জট
ভারতের Defence Acquisition Procedure (DAP) এবং বাজেট বরাদ্দ প্রায়শই মিল না হওয়ায় প্রকল্প বাস্তবায়ন বিলম্বিত হয়। এছাড়াও মার্কিন কোম্পানিগুলি “Offset Credit” প্রদানে দেরির অভিযোগ করেছে।
কৌশলগত দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইন্দো–প্যাসিফিক অঞ্চলে চীনের মোকাবিলাকে অগ্রাধিকার দেয়, কিন্তু ভারত চীনের সঙ্গে সরাসরি সংঘাতে না গিয়ে শান্তিপূর্ণ সমাধান ও Indian Ocean Region–কেন্দ্রিক নিরাপত্তায় বেশি জোর দেয়। এই পার্থক্য চুক্তির দীর্ঘমেয়াদি কার্যকারিতাকে প্রভাবিত করতে পারে।
সাইবার নিরাপত্তা ও ডেটা সংরক্ষণ সমস্যা
ভারতের ডেটা লোকালাইজেশন নীতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের “Free Data Flow” নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এর ফলে ইন্টেলিজেন্স শেয়ারিং ও সাইবার সহযোগিতা ক্ষেত্রে আস্থার ঘাটতি তৈরি হতে পারে।
বাণিজ্যিক উত্তেজনা
২০২৫ সালের আগস্টে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভারতের রপ্তানি পণ্যের ওপর ৫০% আমদানি শুল্ক আরোপ করে, যার মধ্যে টেক্সটাইল, গয়না, লেদার, ও রাসায়নিক পণ্য অন্তর্ভুক্ত। যদিও প্রতিরক্ষা খাত আপাতত সেই প্রভাব থেকে মুক্ত, তবুও দীর্ঘমেয়াদে অর্থনৈতিক টানাপোড়েন কৌশলগত সহযোগিতায় প্রভাব ফেলতে পারে।
🌐 আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
চুক্তিটি বৈশ্বিক পরিসরে নানা প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে।
🔸 পশ্চিমা দেশসমূহের প্রতিক্রিয়া
ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত মহল এটিকে ইন্দো–প্যাসিফিক অঞ্চলে চীনা আগ্রাসনের বিরুদ্ধে যৌথ প্রতিরোধ গড়ে তোলার এক বড় পদক্ষেপ হিসেবে দেখছে। মার্কিন প্রশাসন এই চুক্তিকে "Asia Pivot Strategy"–এর অংশ হিসেবে বর্ণনা করেছে।
🔸 রাশিয়া ও চীনের অবস্থান
দুই দেশই প্রকাশ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া না জানালেও, তারা ভারতের এই ধরণের কৌশলগত পরিবর্তনকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে।
বিশেষত, রাশিয়া উদ্বিগ্ন যে ভারতের প্রতিরক্ষা ক্রয় নীতি ধীরে ধীরে পশ্চিমা প্রযুক্তিনির্ভর হয়ে পড়ছে।
🔸 ASEAN দেশগুলির প্রতিক্রিয়া
চুক্তিটি ASEAN দেশগুলির কাছে ইতিবাচক বার্তা বহন করছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো ভারতের Act East Policy–কে স্বাগত জানাচ্ছে, কারণ এটি চীনের প্রভাবের বিপরীতে একটি ভারসাম্য রক্ষা করতে সাহায্য করবে।
🔸 পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়া
পাকিস্তান এই চুক্তিকে তার নিরাপত্তার জন্য হুমকি হিসেবে দেখছে। ভারতের উন্নত প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি ও মার্কিন সহযোগিতা পাকিস্তানের কৌশলগত পরিবেশকে আরও জটিল করে তুলবে বলে ইসলামাবাদ আশঙ্কা করছে।
🔍 ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা ও কৌশলগত দৃষ্টিভঙ্গি
এই চুক্তি শুধু সামরিক সহযোগিতার প্রতীক নয়, বরং দুই গণতান্ত্রিক দেশের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত বিশ্বাস ও সমন্বয়ের ভিত্তি।
যদি সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা যায়, তবে আগামী এক দশকে ভারত নিম্নলিখিত সুবিধাগুলি পেতে পারে—
- উন্নত সামরিক প্রযুক্তি ও প্রতিরক্ষা অবকাঠামো উন্নয়ন।
- নিজস্ব প্রতিরক্ষা শিল্পের বিকাশ ও রপ্তানি বৃদ্ধি।
- ইন্দো–প্যাসিফিক অঞ্চলে ভারতের কৌশলগত প্রভাব বৃদ্ধি।
- যৌথ মহড়া ও নিরাপত্তা নেটওয়ার্কের মাধ্যমে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা।
তবে, ভারতকে একইসঙ্গে রাশিয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে সুষম কূটনীতি বজায় রাখতে হবে।
ভারতের বিদেশনীতি সবসময় “Multi-Alignment rather than Alliance” নীতির উপর নির্ভর করে এসেছে — অর্থাৎ কোনো এক ব্লকের সঙ্গে সম্পূর্ণভাবে না জড়িয়ে, বিভিন্ন দেশের সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্ক বজায় রাখা।
এই নতুন চুক্তি সেই নীতিরই সম্প্রসারিত রূপ — যেখানে ভারত তার স্বাধীনতা ও স্বার্থ উভয়ই সংরক্ষণ করতে চায়।
🧭 উপসংহার
২০২৫ সালের ভারত–মার্কিন ১০ বছরের প্রতিরক্ষা কাঠামো চুক্তি নিঃসন্দেহে দক্ষিণ এশিয়া ও ইন্দো–প্যাসিফিক অঞ্চলের ভূ-রাজনীতিতে এক নতুন মোড় এনেছে।
এই চুক্তি শুধু দুই দেশের প্রতিরক্ষা সম্পর্ককে গভীর করছে না, বরং সমগ্র অঞ্চলের কৌশলগত ভারসাম্য পুনর্গঠনের ইঙ্গিত দিচ্ছে।
ভারতের জন্য এটি একটি বহুমুখী সুযোগ — উন্নত প্রযুক্তি, আধুনিক সামরিক সক্ষমতা এবং বৈশ্বিক প্রভাব বৃদ্ধির ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে।
তবে এই সহযোগিতা সফল করতে হলে ভারতকে তার অভ্যন্তরীণ প্রশাসনিক সংস্কার, প্রযুক্তিগত দক্ষতা এবং কূটনৈতিক ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে।
চুক্তির মূল বার্তা স্পষ্ট —
ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখন কেবল প্রতিরক্ষা সহযোগী নয়, বরং কৌশলগত ভবিষ্যতের সহযাত্রী।
You may also like this হঠাৎ খেলার মোড় ঘুরলো: HAL-রাশিয়ার এই চুক্তি ভারত-এর জন্য কেন এত গুরুত্বপূর্ণ?
