শাহীন-৩ ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষায় বিপর্যয়: পাকিস্তানে সামরিক ব্যর্থতা ও বালুচিস্তানে আতঙ্ক


"শাহীন-৩ ব্যর্থতা!" বালুচিস্তানে বিস্ফোরণ ও পারমাণবিক আতঙ্ক

২২ জুলাই, ২০২৫ — পাকিস্তানের দীর্ঘপাল্লার পারমাণবিক সক্ষমতাসম্পন্ন শাহীন-৩ (Shaheen-III) ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের সর্বশেষ পরীক্ষাটি এক ভয়াবহ ব্যর্থতার সম্মুখীন হয়েছে বলে সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে জানা যাচ্ছে। ক্ষেপণাস্ত্রটি নির্ধারিত লক্ষ্যবস্তুতে না পৌঁছে কন্ট্রোল হারিয়ে পড়ে যায় বালুচিস্তানের জনবসতি এলাকায়, যা দেশের সামরিক দক্ষতা ও পরমাণু নিরাপত্তা নিয়ে গভীর উদ্বেগ তৈরি করেছে।


ক্ষেপণাস্ত্র ব্যর্থতা: কী ঘটেছিল?

সূত্র অনুযায়ী, শাহীন-৩ ক্ষেপণাস্ত্রটি উৎক্ষেপণের কিছুক্ষণের মধ্যেই দিকভ্রান্ত হয়ে পড়ে যায় এবং লক্ষ্যচ্যুত হয়ে গিয়ে বিস্ফোরণের সঙ্গে বালুচিস্তানের ডেরা বুগতি (Dera Bugti) জেলার গ্রাপন পাস (Grapan Pass) এলাকায় বিধ্বস্ত হয়। স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, মিসাইলটির ধ্বংসাবশেষ পড়েছে লুপ সেহরানী লেভিস স্টেশনের (Loop Sehrani Levies Station) মাত্র ৫০০ মিটার দূরত্বে। এই স্থানটি ডেরা গাজি খান (Dera Ghazi Khan) পরমাণু স্থাপনারও নিকটবর্তী, যা বিপদের মাত্রাকে বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে।


বিস্ফোরণ ও স্থানীয় আতঙ্ক

প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাতে জানা যায়, এলাকায় এক "ভয়াবহ বিস্ফোরণ" হয়, যার শব্দ বহু কিলোমিটার দূর থেকেও শোনা যায়। বিস্ফোরণের ফলে ঘরবাড়ির কাঁচ ভেঙে যায়, এবং বহু মানুষ আতঙ্কে বাইরে বেরিয়ে আসেন। কেউ কেউ মনে করেছিলেন ভূমিকম্প হচ্ছে, কিন্তু পরে জানা যায় এটি ক্ষেপণাস্ত্রের ভেঙে পড়ার ফল।

এমন একটি ক্ষেপণাস্ত্র, যা পারমাণবিক বা প্রচলিত যুদ্ধাস্ত্র বহনে সক্ষম, জনবসতিপূর্ণ এলাকায় ভেঙে পড়ার ফলে মারাত্মক বিপর্যয় ঘটতে পারত।


সেনাবাহিনীর প্রতিক্রিয়া: তথ্য গোপন ও ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউট

ঘটনার পরপরই পাকিস্তানের সেনাবাহিনী দ্রুত পদক্ষেপ নেয়। পুরো এলাকা ঘিরে ফেলা হয়, এবং মিডিয়া প্রবেশ সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করা হয়। ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ করে দেওয়া হয় ডেরা বুগতি ও ডেরা গাজি খান সংলগ্ন অঞ্চলে। স্থানীয় বাসিন্দাদের ঘরের বাইরে যেতে নিষেধ করা হয়। এরকম আচরণ থেকে বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন, সেনাবাহিনী চায়নি এই ব্যর্থতা আন্তর্জাতিক মহলে প্রকাশ পাক।


বালুচ স্বাধীনতাকামীদের প্রতিক্রিয়া

ঘটনাটির পর পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্নতাকামী বালুচ মুক্তি ফ্রন্ট (Balochistan Liberation Front - BLF) এবং বালুচিস্তান রিপাবলিকান গার্ডস (BRG) এর মুখপাত্ররা এই ঘটনাকে পাকিস্তানের সামরিক ব্যর্থতার প্রতীক হিসেবে তুলে ধরেছে। তাঁদের বক্তব্য অনুযায়ী, এই দুর্ঘটনা প্রমাণ করে যে পাকিস্তান শুধুমাত্র রাজনৈতিকভাবে নয়, সামরিকভাবেও ব্যর্থ।

BLF-এর মুখপাত্র এক বিবৃতিতে বলেন:

"শাহীন-৩ মিসাইলের ব্যর্থতা কেবলমাত্র একটি প্রযুক্তিগত ত্রুটি নয়; এটি পাকিস্তানের সামরিক ব্যবস্থা এবং পরমাণু নীতির অব্যবস্থাপনাকে উন্মোচন করেছে। যারা আমাদের ভূমিতে দখলদারিত্ব চালায়, তারা আজ নিজেরাই নিজেদের বিপদ সৃষ্টি করেছে।"

বালুচ নেতারা আরও দাবি করেছেন, এই মিসাইল পরীক্ষাগুলো বালুচিস্তানকে আন্তর্জাতিক পারমাণবিক সংঘাতের সম্ভাব্য ময়দান হিসেবে গড়ে তুলছে। তাঁরা আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেছেন, "এই অঞ্চলকে পারমাণবিক পরীক্ষার ময়দান বানানো হচ্ছে, যা বালুচ জনসাধারণের জন্য মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি করছে।"


শাহীন-৩ ক্ষেপণাস্ত্র: প্রযুক্তিগত পরিচিতি

প্রকার: শাহীন-৩ একটি দুই ধাপবিশিষ্ট, কঠিন জ্বালানিভিত্তিক (solid-fueled) ভূমি থেকে উৎক্ষেপণযোগ্য ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র।
পরিসীমা: এর সর্বোচ্চ পাল্লা ২,৭৫০ কিলোমিটার (১,৭১০ মাইল), যা ভারতের সব অঞ্চল ছাড়াও মধ্যপ্রাচ্যের অনেক অংশে পৌঁছাতে সক্ষম।
পেলোড: এটি পারমাণবিক ও প্রচলিত উভয় ধরণের ওয়ারহেড বহনে সক্ষম।
উৎপত্তি ও পরীক্ষা: ২০০০-এর দশকে গোপনে প্রকল্পের কাজ শুরু হয়, ভারতের অগ্নি-৩ ক্ষেপণাস্ত্রের প্রতিক্রিয়ায়। প্রথম সফল পরীক্ষা হয় ২০১৫ সালের ৯ মার্চ।
উন্নত বৈশিষ্ট্য: এতে Post-Separation Altitude Correction (PSAC) প্রযুক্তি থাকার কথা বলা হয়, যা মিসাইল প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে ফাঁকি দিতে সাহায্য করে। এছাড়া, একাধিক লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানার জন্য MIRV (Multiple Independently Targetable Reentry Vehicle) প্রযুক্তি সংযুক্ত করার কথাও উঠেছে।


পূর্বের ব্যর্থতার ইতিহাস

এই প্রথম নয় যে শাহীন-৩ ক্ষেপণাস্ত্র এমনভাবে লক্ষ্যচ্যুত হয়েছে। গোপন সূত্রের দাবি, ২০২১ ও ২০২৩ সালেও দুটি অনানুষ্ঠানিক পরীক্ষায় মিসাইল লক্ষ্যচ্যুত হয়ে দক্ষিণ-পশ্চিম পাকিস্তানের সীমান্ত অঞ্চলে বিধ্বস্ত হয়েছিল। যদিও সরকারিভাবে এই বিষয়গুলো কখনো স্বীকার করা হয়নি।


আন্তর্জাতিক উদ্বেগ

বিশ্লেষকরা বলছেন, এই ধরণের পরমাণু-সক্ষম ক্ষেপণাস্ত্র যদি জনবসতিপূর্ণ এলাকায় পতিত হয়, তাহলে শুধু স্থানীয় বাসিন্দারাই নয়, গোটা অঞ্চলের নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়ে। পারমাণবিক বিস্ফোরণ না হলেও, এর ইঞ্জিনে ব্যবহৃত কঠিন জ্বালানী এবং অন্যান্য রাসায়নিক উপাদান পরিবেশের উপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে।


ভারত ও আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া

ভারত এখনও আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানায়নি, তবে নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা মনে করছেন যে এই ব্যর্থতা পাকিস্তানের পারমাণবিক নীতিতে এক বড় ফাঁক ফাঁস করে দিয়েছে। আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি সংস্থা (IAEA)-র পক্ষ থেকেও ভবিষ্যতে এমন ঘটনায় সতর্কতা অবলম্বনের জন্য পাকিস্তানকে আহ্বান জানানো হতে পারে।


উপসংহার

২২ জুলাইয়ের শাহীন-৩ ক্ষেপণাস্ত্র ব্যর্থতা পাকিস্তানের সামরিক প্রযুক্তিগত দুর্বলতা, তথ্য গোপনের প্রবণতা, এবং বালুচ অঞ্চলে দখলদার মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে সামনে এসেছে। এই ঘটনায় শুধু একটি মিসাইল ব্যর্থ হয়নি, প্রশ্নের মুখে পড়েছে পাকিস্তানের জাতীয় নিরাপত্তা ও পারমাণবিক দায়িত্বশীলতা।

বালুচিস্তানের স্বাধীনতাকামীদের কণ্ঠে এই ঘটনায় উৎসাহের সুর থাকলেও, সাধারণ মানুষের মধ্যে ভয়, হতাশা এবং অনিশ্চয়তার ছায়া নেমে এসেছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত হবে এই ধরণের ঘটনাগুলো গুরুত্ব সহকারে দেখা এবং একটি নিরাপদ, দায়িত্বশীল পরমাণু ভবিষ্যতের জন্য যৌথভাবে চাপ সৃষ্টি করা।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

যদি আপনার কোনও বিষয়ে ডাউট থাকে বা কোনও বিষয় suggest করতে চান তাহলে মেল করুন!

নবীনতর পূর্বতন

banglafacts 4