🔷 ভূমিকা
বর্তমান বৈশ্বিক ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে, এক মেরু আধিপত্যের যুগ অনেকটা শেষের দিকে। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা দেশগুলির একচেটিয়া প্রভাবকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে নতুন শক্তির উদ্ভব, যার মধ্যে অন্যতম হল RIC (Russia-India-China) ট্রোইকা। এই জোট যদিও আনুষ্ঠানিক কোনো সামরিক বা অর্থনৈতিক জোট নয়, তবুও আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত মঞ্চ।
এই প্রবন্ধে আমরা আলোচনা করব কেন আমেরিকা এই RIC জোটকে সহ্য করতে পারে না, ভারত-চীনের মধ্যে গলওয়ান সংঘর্ষ ও সীমান্ত সমস্যার প্রভাব কী, কেন ভারতকে চীনের উপর আস্থা রাখা উচিত নয়, এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর ‘ননসেন্স’ ট্যারিফ পলিসি কিভাবে বৈশ্বিক অর্থনীতিকে প্রভাবিত করছে।
🔷 RIC ট্রোইকা: একটি সংক্ষিপ্ত পরিচয়
RIC ট্রোইকা হলো রাশিয়া, ভারত এবং চীনের মধ্যে একটি অনানুষ্ঠানিক পরামর্শমূলক ফোরাম। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল বিশ্ব রাজনীতিতে বহুমেরুতা আনয়ন এবং যুক্তরাষ্ট্রের একতরফা আধিপত্যের বিরুদ্ধে একটি যৌথ মঞ্চ গড়ে তোলা।
এই ধারণাটি প্রথম উপস্থাপন করেন রাশিয়ার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইয়েভগেনি প্রিমাকভ ১৯৯৮ সালে। তিনি মনে করেন, তিনটি প্রধান এশীয় শক্তি—রাশিয়া, ভারত, এবং চীন—যদি একসাথে কাজ করে, তাহলে বৈশ্বিক ভারসাম্য তৈরি করা সম্ভব হবে।
RIC-এর লক্ষ্য:
- নিরাপত্তা, অর্থনীতি, জ্বালানি ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান সংস্কার সংক্রান্ত কৌশলগত সহযোগিতা
- সন্ত্রাসবিরোধী পদক্ষেপ ও আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা রক্ষা
- বিশ্ব রাজনীতিতে শক্তির ভারসাম্য বজায় রাখা
🔷 কেন RIC-এর ভবিষ্যৎ আজ অনিশ্চিত?
বর্তমানে এই ফোরাম প্রায় নিস্ক্রিয়। এর প্রধান কারণ:
- COVID-19 মহামারী: আন্তর্জাতিক বৈঠকগুলির স্থগিত হওয়া
- ভারত-চীন সীমান্ত উত্তেজনা: বিশেষ করে ২০২০ সালের গলওয়ান সংঘর্ষের পর সম্পর্কের অবনতি
- রাশিয়া-চীন ঘনিষ্ঠতা: রাশিয়ার চীনের দিকে ঝুঁকে পড়া ভারতকে ভাবিয়ে তুলেছে
রাশিয়া যদিও এই ফোরাম পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টা করছে, ভারত এখনও স্পষ্টভাবে কোনও সিদ্ধান্ত নেয়নি।
🔷 গলওয়ান সংঘর্ষ: RIC-এর বিশ্বাস সংকটের সূচনা
২০২০ সালের জুন মাসে পূর্ব লাদাখের গলওয়ান উপত্যকায় চীনা ও ভারতীয় সেনাবাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষ ঘটে, যেখানে ২০ জন ভারতীয় জওয়ান শহীদ হন। এটি ছিল ১৯৭৫ সালের পর ভারত-চীন সীমান্তে সবচেয়ে প্রাণঘাতী সংঘর্ষ।
এই সংঘর্ষের পর ভারতীয় জনগণ ও সরকার উভয়ের মধ্যে চীনের উপর বিশ্বাস কার্যত ভেঙে পড়ে। সীমান্তে চীনের আগ্রাসন এবং ভ্রাতৃত্বের মুখোশের আড়ালে সামরিক কৌশল ভারতের কাছে চরম প্রতারণার নামান্তর হয়ে ওঠে। ফলস্বরূপ, RIC-এর মতো যে কোনো সহযোগিতামূলক মঞ্চে ভারত চীনের পাশে বসতে অনিচ্ছুক হয়ে পড়ে।
🔷 ভারত-চীন: কেন এই দুই দেশ একসাথে আসতে পারছে না?
১. সীমান্ত ও ভূখণ্ড বিতর্ক
চীনের একপাক্ষিক LAC ব্যাখ্যা, অরুণাচল প্রদেশকে "সাউথ তিব্বত" বলা, এবং সীমান্তে রাস্তা নির্মাণে বাধা—সব মিলিয়ে চীন প্রমাণ করে দিয়েছে তারা দীর্ঘমেয়াদী শান্তি চায় না।
২. চীনের দ্বিচারিতা
চীন একদিকে RIC বা BRICS মঞ্চে বন্ধুত্বের মুখোশ পরে, অন্যদিকে সীমান্তে সেনা বাড়াচ্ছে। ভারত বারবার বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হয়েছে।
৩. ভারতীয় স্বার্থবিরোধী চীনা প্রকল্প
- বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (BRI): পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরের উপর দিয়ে প্রকল্প
- পাকিস্তানকে সামরিক সাহায্য: ভারতের নিরাপত্তার জন্য সরাসরি হুমকি
৪. বৈশ্বিক মঞ্চে চীনের আগ্রাসী কূটনীতি
ভারতের জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য হওয়ার প্রয়াসে বারবার বাধা সৃষ্টি করেছে চীন।
🔷 কেন আমেরিকা RIC জোটকে ঘৃণা করে?
আমেরিকা বহুদিন ধরেই একতরফা নেতৃত্বের অভ্যাসে অভ্যস্ত। তারা চায় না কোনো বিকল্প শক্তি কেন্দ্র তৈরি হোক। RIC-এর সম্ভাব্য প্রভাব:
- আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে নতুন শক্তির ভারসাম্য
- ডলারের একাধিপত্যে চ্যালেঞ্জ
- চীনের উত্থান এবং রাশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক ঘরানাকে বৈধতা প্রদান
- ভারত যদি রাশিয়া-চীনের দিকে ঝুঁকে পড়ে, তবে QUAD, AUKUS ও অন্যান্য পশ্চিমা স্ট্র্যাটেজিগুলি দুর্বল হয়ে যাবে
এ কারণেই আমেরিকা চায় না RIC সক্রিয় হোক। তারা চায় ভারতকে চীনের বিরুদ্ধে ব্যবহার করে রাশিয়া-চীন একত্রিত হওয়া ঠেকাতে।
🔷 QUAD বনাম RIC: ভারতের কূটনৈতিক টানাপোড়েন
ভারত বর্তমানে একটি কঠিন কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জের মধ্যে রয়েছে। একদিকে QUAD, যেখানে আমেরিকা, জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখা জরুরি; অন্যদিকে RIC-এর মতো প্ল্যাটফর্মে রাশিয়া ও চীনের সঙ্গে ভারসাম্য রক্ষা করা জরুরি।
কিন্তু চীনের প্রতি অবিশ্বাস এবং QUAD-এর মাধ্যমে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার প্রবণতা ভারতের পক্ষে RIC-কে কার্যকর অংশীদারত্বে পরিণত করতে বাধা দিচ্ছে।
🔷 রাশিয়া-চীন ঘনিষ্ঠতা: ভারতের দুশ্চিন্তা
ইউক্রেন যুদ্ধের পর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার মুখে রাশিয়া চীনের দিকে আরও বেশি করে ঝুঁকেছে। এশিয়া ও ইউরেশিয়াতে রাশিয়া-চীন দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ও প্রতিরক্ষা সম্পর্ক বাড়ছে।
ভারতের জন্য সমস্যা হল:
- RIC-এ চীনের কথা বেশি গুরুত্ব পাবে
- রাশিয়া চীনের ‘সাইড’ নিতে পারে
- ভারতের কৌশলগত স্বার্থ অগ্রাহ্য হতে পারে
🔷 আমেরিকা ও ন্যাটোর 'ননসেন্স' ট্যারিফ পলিসি: বৈশ্বিক অর্থনীতির হুমকি
সম্প্রতি আমেরিকা ও ইউরোপ:
- চীনা ইলেকট্রিক গাড়ির উপর ১০০% পর্যন্ত ট্যারিফ
- রাশিয়ার গ্যাস, তেল, প্রযুক্তির উপর নিষেধাজ্ঞা
- ভারতীয় ফার্মা ও IT-এর উপর ভিন্নভাবে কড়া শুল্ক চাপাচ্ছে
এর ফলে:
- মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাচ্ছে
- আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত
- উন্নয়নশীল দেশগুলির রপ্তানির সুযোগ কমে যাচ্ছে
- WTO-এর নীতির পরিপন্থী হচ্ছে এই একতরফা ব্যবস্থা
RIC-এর মতো মঞ্চ এই অবস্থায় বিকল্প অর্থনৈতিক নেটওয়ার্ক তৈরি করতে পারত, কিন্তু ভারত-চীন দ্বন্দ্বে তা সম্ভব হচ্ছে না।
🔷 উপসংহার: ভারত কী করবে?
RIC একটি সম্ভাবনাময় কৌশলগত প্ল্যাটফর্ম হলেও চীনের বিশ্বাসযোগ্যতার অভাব ও সীমান্তে যুদ্ধাবস্থা RIC-এর ভবিষ্যৎ অনিশ্চয় করে তুলেছে।
ভারতের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো—জাতীয় স্বার্থ ও নিরাপত্তা। চীনের সঙ্গে অতীত অভিজ্ঞতা বিচার করে ভারত যদি RIC-এ কৌশলগত দূরত্ব বজায় রাখে, তাহলে তা একেবারে অযৌক্তিক নয়।
একইসঙ্গে, আমেরিকার ‘ননসেন্স ট্যারিফ’ নীতিকে মোকাবিলা করতে হলে ভারতকে আরও আত্মনির্ভর হতে হবে এবং বিকল্প বাণিজ্য নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে হবে—যা রাশিয়ার সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের মাধ্যমে সম্ভব।
🗣️ পাঠকের জন্য প্রশ্ন
আপনার মতে, ভারত কি চীনের সঙ্গে ফের কূটনৈতিক সম্পর্ক স্বাভাবিক করা উচিত? RIC-এর ভবিষ্যৎ কি এখনও আছে?
কমেন্টে জানান আপনার মতামত।
