ভূমিকা
দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতি বর্তমানে এক গুরুত্বপূর্ণ বাঁকে দাঁড়িয়ে আছে। ঐতিহ্যগতভাবে ভারত এই অঞ্চলের নেতৃত্বে ছিল এবং দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক সংহতির প্রতীক হিসেবে SAARC (South Asian Association for Regional Cooperation) ছিল মূল ভিত্তি। কিন্তু ২০১৪ সালের পর থেকে SAARC কার্যত অচল হয়ে পড়েছে, বিশেষ করে ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের অবনতির কারণে। এই পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে চীন, পাকিস্তান ও সাম্প্রতিকভাবে বাংলাদেশ একটি নতুন আঞ্চলিক জোট গঠনের উদ্যোগ নিচ্ছে বলে আন্তর্জাতিক মহলে ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়েছে।
এই জোট যদি বাস্তবায়িত হয়, তবে তা কেবল ভারতের আঞ্চলিক প্রভাবকে চ্যালেঞ্জ জানাবে না, বরং SAARC-এর কার্যকারিতাকেও প্রশ্নের মুখে ফেলবে। এই প্রবন্ধে আমরা বিশ্লেষণ করব কীভাবে এই চীন-পাকিস্তান-বাংলাদেশ "নেক্সাস" গঠিত হচ্ছে, এর পিছনে কৌশলগত লক্ষ্যগুলো কী, ভারত ও SAARC-এর উপর এর সম্ভাব্য প্রভাব কী হতে পারে, এবং চীনের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এই জোট কতোটা বিশ্বাসযোগ্য।
SAARC-এর স্থবিরতা এবং আঞ্চলিক শূন্যতা
SAARC, ১৯৮৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল দক্ষিণ এশিয়ার আটটি দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সহযোগিতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে। কিন্তু ২০১৬ সালের উরি হামলার পর থেকে ভারত-পাকিস্তান দ্বন্দ্বের কারণে SAARC কার্যত অকার্যকর হয়ে পড়ে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কোনো গুরুত্বপূর্ণ শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়নি।
এই শূন্যতা একটি আঞ্চলিক শক্তির অভাব সৃষ্টি করেছে, যা চীন ও পাকিস্তানের মতো রাষ্ট্রগুলোকে একটি বিকল্প গঠনের সুযোগ এনে দিয়েছে। চীন তার Belt and Road Initiative (BRI)-এর মাধ্যমে এমনিতেই দক্ষিণ এশিয়ায় প্রবেশ করতে চেয়েছে, আর পাকিস্তান চায় ভারতের প্রভাব থেকে নিজেকে মুক্ত করে আঞ্চলিক কূটনৈতিক অবস্থানকে পুনর্গঠন করতে।
চীন-পাকিস্তান-বাংলাদেশ: একটি উদীয়মান জোট
চীন ও পাকিস্তানের ভূমিকাঃ
চীন ও পাকিস্তান বহুদিন ধরেই কৌশলগতভাবে একে অপরের ঘনিষ্ঠ মিত্র। চীন-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডোর (CPEC) এই সহযোগিতার সবচেয়ে বড় উদাহরণ। চীন পাকিস্তানের মাধ্যমে ভারত মহাসাগরে প্রবেশাধিকার এবং ভারতের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে একটি প্রভাব খাটানোর কৌশল অনুসরণ করছে। অন্যদিকে, পাকিস্তান এই সহযোগিতার মাধ্যমে ভারতের বিরুদ্ধে কূটনৈতিক ও কৌশলগত লিভারেজ অর্জন করতে চায়।
বাংলাদেশ এবং কুনমিং বৈঠকঃ
২০২৫ সালের জুন মাসে চীনের কুনমিং শহরে চীন, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের প্রতিনিধিদের মধ্যে একটি ত্রিপাক্ষিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। যদিও বাংলাদেশ সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে জানায় যে এটি একটি অর্থনৈতিক বৈঠক ছিল, কিন্তু বিশ্লেষকরা বলছেন, এই বৈঠকের রাজনৈতিক গুরুত্ব অনেক বেশি।
বিশেষ করে ভারতের দৃষ্টিকোণ থেকে এটি একটি সতর্ক সংকেত হিসেবে দেখা হচ্ছে যে বাংলাদেশ একটি নতুন জোটে ধীরে ধীরে প্রবেশ করতে পারে, যার মাধ্যমে চীন ও পাকিস্তান ভারতের আঞ্চলিক আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ জানাবে।
কৌশলগত লক্ষ্য ও SAARC-এর বিকল্প গঠন
এই নবগঠিত জোটের মূল লক্ষ্য হচ্ছে একটি বিকল্প আঞ্চলিক ফোরাম তৈরি করা যা SAARC-এর ব্যর্থতার জায়গাগুলো পূরণ করবে। সম্ভাব্য লক্ষ্যগুলো হলো:
- অর্থনৈতিক সহযোগিতা বৃদ্ধি
- বড় পরিকাঠামোগত প্রকল্প বাস্তবায়ন (BRI-এর মাধ্যমে)
- আঞ্চলিক নিরাপত্তা এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি
- ভারতের প্রভাবকে হ্রাস করা বিশেষত উত্তর-পূর্ব ভারতের 'চিকেনস নেক' অর্থাৎ শিলিগুড়ি করিডোরকে ঘিরে উদ্বেগ
এই পরিস্থিতিতে ভারতের আশঙ্কা যুক্তিযুক্ত। শিলিগুড়ি করিডোর ভারতের উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোর সঙ্গে মূল ভূখণ্ডের একমাত্র সংযোগ পথ। যদি এই করিডোর চীনের জোটের নজরে পড়ে বা কৌশলগতভাবে ঘিরে ফেলা হয়, তাহলে তা ভারতের নিরাপত্তা ও অখণ্ডতার উপর বড় প্রভাব ফেলতে পারে।
চীনের কৌশল: ঋণ-কূটনীতি ও অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ
চীনের তথাকথিত "debt trap diplomacy" একটি আলোচিত বিষয়। চীন বিপুল পরিমাণে ঋণ ও বিনিয়োগ প্রদান করে উন্নয়নশীল দেশগুলিকে অর্থনৈতিকভাবে নিজস্ব প্রভাব বলয়ে নিয়ে আসে।
- CPEC-এর মাধ্যমে পাকিস্তান ইতোমধ্যেই চীনের বড় ঋণগ্রহীতা হয়েছে।
- বাংলাদেশেও চীন বিভিন্ন বন্দর, রেলপথ, বিদ্যুৎ প্রকল্পে বিনিয়োগ করেছে।
চীনের লক্ষ্য হলো, এইসব দেশের অর্থনীতিকে নিজের নেটওয়ার্কে যুক্ত করে একটি ভারত-বিরোধী রাজনৈতিক এবং কৌশলগত বলয় গঠন করা।
পাকিস্তান কি বিশ্বস্ত মিত্র?
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক:
পাকিস্তান দীর্ঘদিন ধরেই যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ সামরিক মিত্র ছিল, বিশেষ করে ১৯৮০’র দশকে সোভিয়েত-আফগান যুদ্ধ এবং ২০০১-এর পর “ওয়ার অন টেরর”-এর সময়। কিন্তু আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের পর সেই সম্পর্ক অনেকটাই দুর্বল হয়েছে।
বর্তমানে পাকিস্তান চীনের দিকে বেশি ঝুঁকছে, যদিও পুরোনো আমেরিকান সংযোগ পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়নি। চীন এই পরিবর্তনকে বুঝে এবং পরিস্থিতি অনুযায়ী নিজের কৌশল ঠিক করে।
CPEC-এর ব্যর্থতা ও চীনের সতর্কতা
CPEC শুরু হলেও এর অনেক প্রকল্প কাঙ্ক্ষিত ফল দিতে পারেনি। পাকিস্তানে রাজনৈতিক অস্থিরতা, প্রশাসনিক দুর্বলতা, এবং দুর্নীতির কারণে এই প্রকল্পগুলো পূর্ণরূপে বাস্তবায়িত হয়নি। ফলে, চীনও কিছুটা বিচলিত। চীন এখন পাকিস্তানের উপর নির্ভরশীলতা নিয়ে পুনর্মূল্যায়ন করছে এবং আরও কড়া নজরদারি বজায় রাখছে।
বাংলাদেশের নতুন সরকার এবং ড. মুহাম্মদ ইউনুস
ড. ইউনুসের পরিচয় ও আমেরিকান সংযোগ:
নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনুস বর্তমানে শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর বাংলাদেশে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তাঁর সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের সম্পর্ক রয়েছে। তিনি Vanderbilt University থেকে পিএইচডি করেছেন এবং Clinton Foundation-এর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে।
চীনের দৃষ্টিকোণ:
এই আমেরিকা-ঘনিষ্ঠ পরিচয় চীনের জন্য একটি সতর্কবার্তা হতে পারে। তবে কেবল একজন নেতার ব্যক্তিগত সম্পর্কের উপর ভিত্তি করে চীন বাংলাদেশকে পুরোপুরি অবিশ্বাস করবে—এমনটা নয়। বরং চীন প্রতিটি সরকারের নীতিগত দিক, আন্তর্জাতিক অবস্থান এবং ভূরাজনৈতিক অবস্থান বিবেচনা করেই নিজের কৌশল নির্ধারণ করে।
ভারতের অবস্থান ও ভবিষ্যতের করণীয়
ভারতের জন্য এই উদীয়মান ত্রিপাক্ষিক জোট একটি গুরুতর কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ। দক্ষিণ এশিয়ায় নিজের ঐতিহ্যগত প্রভাব রক্ষা করতে হলে ভারতকে কিছু কৌশল অবলম্বন করতে হবে:
- SAARC পুনরুজ্জীবনের উদ্যোগ নেওয়া
- বাংলাদেশের সঙ্গে কৌশলগত ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক আরও মজবুত করা
- নতুন আঞ্চলিক প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা যেমন BIMSTEC, IORA
- উত্তর-পূর্ব ভারতের উন্নয়ন ও সংযোগ ব্যবস্থা শক্তিশালী করা
- চীনের ঋণ-কূটনীতির বিপরীতে বিকল্প অর্থনৈতিক সহযোগিতা প্রস্তাব করা
উপসংহার
চীন-পাকিস্তান-বাংলাদেশ জোট একটি বাস্তব ও ক্রমবর্ধমান সম্ভাবনা যা দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতিকে আমূল পরিবর্তন করতে পারে। এটি ভারতের ঐতিহ্যগত প্রভাবকে প্রশ্নের মুখে ফেলবে এবং SAARC-এর অস্তিত্বকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলবে। তবে এই জোটও অনেক অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি—বিশেষ করে পাকিস্তানের অব্যবস্থা এবং বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক ভারসাম্য রক্ষা।
চীনের দৃষ্টিভঙ্গি মূলত বাস্তববাদী—তারা প্রতিটি দেশের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলে কৌশলগত প্রয়োজনে, অন্ধ বিশ্বাসে নয়। ঠিক তেমনই, ভারতকেও এখন আবেগ বা ঐতিহ্যের বাইরে এসে কঠোর কূটনৈতিক এবং অর্থনৈতিক পন্থা অবলম্বন করতে হবে এই নতুন আঞ্চলিক সমীকরণে টিকে থাকার জন্য।