তারা কি বিবর্তিত হয়? – তারার জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত এক মহাজাগতিক সফর

 

ভূমিকা

তারা—আকাশে ছোট ছোট আলো ঝলমলে বিন্দু যাদের আমরা রাত্রিবেলা দেখি। কিন্তু কখনও কি ভেবে দেখেছেন, এই তারা গুলো কি কেবল আলোর ছিটেফোঁটা নাকি এদেরও একটা জীবনচক্র আছে? এরা কি বয়স বাড়ায়, বিবর্তিত হয়? মানুষ যেমন জন্মগ্রহণ করে, বড় হয়, বার্ধক্যে পৌঁছায় এবং এক সময় মৃত্যুবরণ করে—তেমনি কি তারারও কোনও জীবনচক্র আছে?

তারার বিবর্তন ধাপ: নেবুলা থেকে ব্ল্যাক হোল পর্যন্ত একটি ব্যাখ্যামূলক চিত্র

এই প্রশ্নের উত্তর জানলে আপনি বিস্মিত হবেন। হ্যাঁ, তারা-ও বিবর্তিত হয়। তবে এটি মানব বিবর্তনের মতো নয়। এই প্রক্রিয়াটি একক একটি তারা-র জীবদ্দশার মধ্যেই ঘটে। এই জীবনচক্রের ধাপগুলো হলো—জন্ম, প্রাপ্তবয়স্ক অবস্থা, বার্ধক্য এবং শেষপর্যায়ে মৃত্যু বা ধ্বংস। এই মহাজাগতিক নাটকের নাম হলো “তারার বিবর্তন” বা Stellar Evolution

এই প্রবন্ধে আমরা বুঝে নেব তারা কিভাবে জন্ম নেয়, কীভাবে তাদের জীবন শুরু হয়, তারা কীভাবে বিবর্তিত হয় এবং শেষপর্যন্ত তাদের ভাগ্যে কী ঘটে।


১. তারার জন্ম: মহাজাগতিক নার্সারিতে সূচনা

তারা জন্মায় গ্যাস ও ধূলিকণার একটি বিশাল মেঘ থেকে, যাকে বলে নেবুলা (Nebula)। এই মেঘ মূলত হাইড্রোজেন গ্যাস দিয়ে তৈরি, যার মধ্যে কিছু হিলিয়াম এবং ধূলিকণাও থাকে।

যখন কোনো কারণে এই গ্যাসমেঘ সংকুচিত হতে শুরু করে (হয়ত কাছের কোনো সুপারনোভার বিস্ফোরণ, বা মহাকর্ষীয় টান), তখন মেঘের ভেতরে ঘনত্ব বাড়তে থাকে। তখন সেই অঞ্চলে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেতে থাকে, এবং অবশেষে সেখানে তৈরি হয় একটি প্রোটোস্টার (Protostar)।

এই প্রোটোস্টার যখন পর্যাপ্ত তাপমাত্রা ও চাপে পৌঁছায় (প্রায় ১০ মিলিয়ন কেলভিন), তখন শুরু হয় নিউক্লিয়ার ফিউশন—হাইড্রোজেন পরমাণু একত্রিত হয়ে হিলিয়াম তৈরি করে। এর ফলে প্রচুর শক্তি নির্গত হয় এবং সেই প্রোটোস্টার পরিণত হয় একটি মূলধারার তারা বা Main Sequence Star-এ।


২. মূলধারার তারা: তারার দীর্ঘ জীবন

এই পর্যায়টি হলো একটি তারা-র সবচেয়ে দীর্ঘকালীন এবং স্থিতিশীল সময়কাল। এই সময়ে তারা তাদের কেন্দ্রে হাইড্রোজেন ফিউশন চালিয়ে যায় এবং শক্তি উৎপন্ন করে।

আমাদের সূর্য এখন এই পর্যায়েই রয়েছে। এটি একটি G-শ্রেণির হলুদ বামন তারা (Yellow Dwarf)। এর ভর প্রায় 1.99 × 10³⁰ কিলোগ্রাম, যা পৃথিবীর ভরের প্রায় ৩,৩০,০০০ গুণ। এর তাপমাত্রা প্রায় ৬০০০ কেলভিন বা ১১,০০০ ডিগ্রি ফারেনহাইট

সূর্য তার জন্মের প্রায় ৪.৫ বিলিয়ন বছর পার করে ফেলেছে এবং ধারণা করা হয় এটি আরও ৫ বিলিয়ন বছর ধরে মূলধারার তারা হিসেবেই থাকবে।


৩. তারার বার্ধক্য: রেড জায়ান্ট বা সুপারজায়ান্ট পর্যায়

একটা সময়ে একটি তারা তার কেন্দ্রে থাকা হাইড্রোজেনের মজুত ফুরিয়ে ফেলে। তখন তার কেন্দ্র সংকুচিত হতে শুরু করে, আর বাইরের স্তর প্রসারিত হয়।

এই সময় তারা রূপান্তরিত হয় রেড জায়ান্ট (Red Giant) অথবা সুপারজায়ান্ট (Supergiant) তারা-য়। কোন রূপে রূপান্তরিত হবে তা নির্ভর করে তারার শুরুর ভরের উপর।

  • সূর্য-এর মতো মাঝারি ভরের তারাগুলো রূপ নেয় রেড জায়ান্ট-এ।
  • আর বৃহৎ ভরের তারাগুলো রূপান্তরিত হয় সুপারজায়ান্ট তারা-য়।

এই সময় তারা অনেক বড় হয়ে যায়, কিন্তু কেন্দ্রে আর ফিউশন স্থিতিশীলভাবে চলে না। তাপমাত্রা আরও বেড়ে যায় এবং হিলিয়াম ফিউশন শুরু হয়।


৪. মৃত্যুর প্রান্তে: তারার শেষ পরিণতি

একটা সময়ে তারা তার সব জ্বালানিই ফুরিয়ে ফেলে। তখন তারার উপর তীব্র মহাকর্ষ কাজ করতে শুরু করে। তারপর কী হবে তা পুরোপুরি নির্ভর করে তারার ভরের উপর।

(ক) সূর্য-এর মতো মাঝারি ভরের তারা:

  • এদের কেন্দ্রীয় অংশ একটি সাদা বামন (White Dwarf) এ রূপান্তরিত হয়। এটি খুবই ঘন এবং উত্তপ্ত কিন্তু আর নতুন করে ফিউশন ঘটে না।
  • বাইরের স্তরগুলো ছিটকে পড়ে এবং তৈরি হয় এক ধরণের রঙিন গ্যাসীয় গঠন, যাকে বলে Planetary Nebula

(খ) বৃহৎ ভরের তারা:

  • এরা শেষ পর্যায়ে কেন্দ্রে লৌহ উৎপাদন করতে করতে একদিন হঠাৎ ভেঙে পড়ে এবং একটি বিশাল বিস্ফোরণ ঘটে। একে বলে সুপারনোভা (Supernova)। এটি মহাবিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী ঘটনা।
  • বিস্ফোরণের পর কেন্দ্রীয় অংশ দুটি রূপ নিতে পারে—
    • যদি কিছুটা কম ভর হয়: নিউট্রন তারা (Neutron Star)
    • যদি ভর অত্যন্ত বেশি হয়: ব্ল্যাক হোল (Black Hole)

৫. আমাদের সূর্য-এর ভবিষ্যৎ

যেমনটি বলা হয়েছে, সূর্য এখন একটি হলুদ বামন তারা। এটি মূলধারার তারা হিসেবেই রয়েছে। আর প্রায় ৫ বিলিয়ন বছর পর এটি রূপ নেবে একটি রেড জায়ান্ট-এ। তখন এটি এতটাই বড় হয়ে যাবে যে সম্ভবত পার্শ্ববর্তী গ্রহ—বুধ ও শুক্র—এর উপরেও প্রভাব ফেলবে। এমনকি পৃথিবীও তার উত্তাপে পুড়ে ছাই হয়ে যেতে পারে।

এরপর, সূর্য তার বাইরের স্তরগুলো হারিয়ে ফেলবে এবং কেন্দ্রে রয়ে যাবে একটি সাদা বামন। অবশেষে কোটি কোটি বছরের পরে, এই সাদা বামন তার তাপশক্তি হারিয়ে কালো বামন (Black Dwarf) হয়ে যাবে—একটি ঠান্ডা, নিষ্ক্রিয় তারা।


৬. তারার জীবনচক্রের গুরুত্ব

তারারা শুধু আলো দেয় বা সৌন্দর্য তৈরি করে না, তারা আমাদের অস্তিত্বের ভিত্তি। একটি সুপারনোভার বিস্ফোরণের মাধ্যমেই মহাবিশ্বে বিভিন্ন মৌল (যেমন কার্বন, অক্সিজেন, লোহা) ছড়িয়ে পড়ে। এই মৌলগুলো থেকেই তৈরি হয়েছে গ্রহ, মহাকাশীয় বস্তু এবং এমনকি মানুষ।

অর্থাৎ, আমরা সবাই—এই পৃথিবী, আমাদের শরীরের প্রতিটি অণু—একটি তারারই ধ্বংসাবশেষ। "We are all made of stardust."


উপসংহার

তারা বিবর্তিত হয়—তবে সেটা পায়ে হেঁটে নয়, বা প্রাণীর মতো রূপান্তর হয়ে নয়। তারা জীবদ্দশার মধ্যেই ধাপে ধাপে একেকটি পর্যায়ে যায়, তাদের ভরের উপর নির্ভর করে তারা রূপ নেয় সাদা বামন, নিউট্রন তারা অথবা ব্ল্যাক হোলে।

তাদের জন্ম হয় ধূলিকণার মেঘে, তারপর ফিউশনের মাধ্যমে দীর্ঘকাল আলো দেয়, আর শেষে বিস্ফোরণের মাধ্যমে মহাবিশ্বকে সমৃদ্ধ করে। তারার এই জীবনচক্র মহাবিশ্বের সবচেয়ে চিত্তাকর্ষক ও গম্ভীর প্রাকৃতিক নাট্য।

তাই যখন আপনি রাতের আকাশে তারা দেখবেন, মনে রাখবেন—আপনি আসলে তাকিয়ে আছেন একেকটি জীবনের দিকে, যারা জন্মেছে, বেঁচেছে এবং কেউ কেউ শেষও হয়ে গেছে। এই তারা, এই জ্যোতিষ্করাই আমাদের অস্তিত্বের মহাজাগতিক ভিত্তি।


পাঠককে প্রশ্ন:
আপনি যদি আমাদের সূর্য-এর পরিবর্তে কোনও সুপারজায়ান্ট তারা-র কাছে জন্মাতেন, আপনার পৃথিবীর রূপ কেমন হতো বলে মনে করেন? মন্তব্যে জানান!


 টিপস:

  • "NASA’s Eyes on the Solar System" ওয়েবসাইটে তারার বিবর্তন নিয়ে দারুণ ভিজ্যুয়াল রয়েছে—চোখে দেখা এবং শেখা দুই-ই একসাথে!



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

যদি আপনার কোনও বিষয়ে ডাউট থাকে বা কোনও বিষয় suggest করতে চান তাহলে মেল করুন!

নবীনতর পূর্বতন

banglafacts 4