শ্রীলঙ্কার পঞ্চ ঈশ্বরম: প্রাচীন শৈব ঐতিহ্যের এক জ্বলন্ত নিদর্শন


শ্রীলঙ্কা, শুধুমাত্র বৌদ্ধ ধর্মের পীঠস্থান নয়, বরং এটি বহু প্রাচীন হিন্দু মন্দির ও শৈব ঐতিহ্যেরও ধারক ও বাহক। তেমনই একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় ঐতিহ্য হলো পঞ্চ ঈশ্বরম (তামিল: பஞ்ச ஈஸ்வரங்கள்), অর্থাৎ “শিবের পাঁচটি আবাস”। এই পাঁচটি মন্দির শুধুমাত্র ধর্মীয় দিক থেকেই নয়, বরং ইতিহাস, সংস্কৃতি ও স্থাপত্যশৈলীর দিক থেকেও অসামান্য গুরুত্বপূর্ণ।

পঞ্চ ঈশ্বরম অর্থ কী?

“পঞ্চ” শব্দের অর্থ পাঁচ এবং “ঈশ্বরম” মানে ঈশ্বর তথা শিবের আবাস বা মন্দির। সুতরাং “পঞ্চ ঈশ্বরম” বলতে বোঝানো হয় শ্রীলঙ্কায় অবস্থিত প্রাচীন পাঁচটি শিব মন্দির, যেগুলো শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে তামিল হিন্দুদের কাছে তীর্থস্থান হিসেবে পূজিত হয়ে আসছে।


এই পাঁচটি মন্দির কী কী?

পঞ্চ ঈশ্বরমের মধ্যে রয়েছে শ্রীলঙ্কার পাঁচটি বিভিন্ন স্থানে অবস্থিত উপকূলবর্তী প্রাচীন শিব মন্দির:

১. কোনেশ্বরম মন্দির (ত্রিনকোমালি)

Trincomalee-Koneswaram-Temple

এই মন্দিরটি শ্রীলঙ্কার উত্তর-পূর্বে, ত্রিনকোমালি শহরের উপকূলবর্তী উচ্চভূমিতে অবস্থিত। এটি ‘দক্ষিণ কৈলাশ’ (Dakshina Kailasa) নামেও পরিচিত, যা শিবের পবিত্র আবাস কৈলাস পর্বতের প্রতীক। এই মন্দিরটি প্রাচীন কাল থেকেই রাজা, সাধু এবং হিন্দু তীর্থযাত্রীদের কাছে এক পবিত্র তীর্থস্থান।

  • সমুদ্রের ওপরে এক খাড়া পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত এই মন্দিরটি থেকে বিস্ময়কর দৃশ্য দেখা যায়।
  • পর্তুগিজ উপনিবেশের সময় এই মন্দির ধ্বংস হয়, পরে তা আবার পুনর্নির্মাণ করা হয়েছে।

২. মুন্নেশ্বরম মন্দির (চিলাও)

LK-munneswaram-tempel-1

পুত্তালাম জেলার চিলাও শহরের কাছে অবস্থিত এই মন্দিরটি একটি গুরুত্বপূর্ণ তীর্থস্থান, যেখানে ভগবান শিবের পাশাপাশি অন্যান্য দেবতাদের উপাসনা হয়।

  • লোককথা অনুযায়ী, ভগবান রাম এখানে লঙ্কার রাজা রাবণকে বধ করার পর পাপমোচনের জন্য শিবের পূজা করেছিলেন।
  • প্রতি বছর এখানে "মুন্নেশ্বরম উৎসব" অত্যন্ত জাঁকজমকভাবে পালন করা হয়।

৩. থিরুকেথীশ্বরম মন্দির (মান্নার)

উত্তর-পশ্চিম শ্রীলঙ্কার মান্নার জেলায় অবস্থিত এই মন্দিরটি দক্ষিণ ভারতের তামিল সাহিত্যের ‘তেভারম’ কাব্যে বর্ণিত ২৭৫ Paadal Petra Sthalam-এর একটি।

  • এটি একটি অত্যন্ত প্রাচীন মন্দির, যেখানে স্থাপত্যশৈলী এবং ইতিহাসের মেলবন্ধন দেখা যায়।
  • প্রাচীন ‘নায়নার’ রাজবংশ এই মন্দির গড়ে তুলেছিল বলে ধারণা করা হয়।

৪. নাগুলেশ্বরম মন্দির (জাফনা)

Entrance-of-the-Naguleswaram-temple

জাফনা প্রদেশের কঙ্কেসন্থুরাই শহরের নিকটে অবস্থিত এই মন্দিরটি ‘কীরিমালাই নাগুলেশ্বর তিরুথম্বলেশ্বরম কভিল’ নামেও পরিচিত।

  • এটি উত্তর শ্রীলঙ্কার একটি ঐতিহাসিক শিব মন্দির এবং সমুদ্রের কাছাকাছি অবস্থিত।
  • এখানে প্রচুর হিন্দু তীর্থযাত্রী আসেন “থাই পোসম” বা “মহা শিবরাত্রি” তে।

৫. টোন্ডেশ্বরম মন্দির (মাতারা)

শ্রীলঙ্কার দক্ষিণ প্রদেশের মাতারা শহরের কাছে অবস্থিত এই মন্দিরটি অতীতে একটি গুরুত্বপূর্ণ শৈব তীর্থস্থান ছিল।

  • দুঃখজনকভাবে, পর্তুগিজ দখলের সময় এই মন্দিরের অধিকাংশ ধ্বংস হয়ে যায়।
  • বর্তমানে এর ধ্বংসাবশেষ থেকে ইতিহাস উদ্ধার করা হচ্ছে।

ঐতিহাসিক পটভূমি ও নির্মাণকাল

এই পাঁচটি মন্দিরের ইতিহাস হাজার বছরের পুরনো। বলা হয়ে থাকে, এই মন্দিরগুলি নাগা রাজাদের আমলে নির্মিত হয়েছিল, এবং পরবর্তীতে সিংহলী, তামিল ও দক্ষিণ ভারতীয় রাজারা এগুলোর সংস্কার ও সম্প্রসারণ করেন।

  • মন্দিরগুলিতে পল্লব স্থাপত্যের নিদর্শন পাওয়া গেছে।
  • বহু প্রত্নতাত্ত্বিক খননের মাধ্যমে প্রাচীন মূর্তি ও ভগ্নাংশ আবিষ্কৃত হয়েছে।

শৈব দর্শন ও ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ

পঞ্চ ঈশ্বরম মন্দিরগুলি শৈব সিদ্ধান্ত (Saiva Siddhanta) দর্শনের ওপর ভিত্তি করে তৈরি। এই দর্শনের মূল ভাবনা হল:

  • শিব সর্বশক্তিমান ঈশ্বর,
  • আত্মা ও ঈশ্বরের মিলনের মাধ্যমে মুক্তি লাভ সম্ভব,
  • শিবলিঙ্গ হল সেই চেতনার প্রতীক।

পৌরাণিক বিশ্বাস ও রাবণের সংযোগ

তামিল ও শ্রীলঙ্কার হিন্দুদের মধ্যে একটি বিস্ময়কর বিশ্বাস প্রচলিত— লঙ্কাপতি রাবণ নিজে এই পঞ্চ ঈশ্বরমের শিবলিঙ্গ স্থাপন করেছিলেন।

  • এটি রামায়ণের সঙ্গে যুক্ত— রাবণ ছিলেন শিবের পরম ভক্ত, এবং শিবের কৃপা লাভের জন্য তিনি বহু তপস্যা করেছিলেন।
  • এই বিশ্বাস শিবভক্তদের কাছে এই মন্দিরগুলিকে অতীব পবিত্র করে তুলেছে।

উপনিবেশিক ধ্বংস ও পুনঃনির্মাণ

১৫ থেকে ১৭শ শতকে পর্তুগিজ উপনিবেশের সময় হিন্দু মন্দিরগুলিকে ব্যাপকভাবে ধ্বংস করা হয়।

  • পঞ্চ ঈশ্বরমগুলির বেশ কয়েকটি মন্দির উপনিবেশিক শাসকের দ্বারা ভেঙে ফেলা হয়।
  • আধুনিককালে বহু স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক হিন্দু সংগঠন মন্দিরগুলির পুনর্নির্মাণে যুক্ত হয়েছে।

সাংস্কৃতিক ও তীর্থযাত্রার কেন্দ্র

এই মন্দিরগুলি শুধু ধর্মীয় স্থানই নয়, বরং তামিল সংস্কৃতিরও গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র:

  • ধর্মীয় উৎসব, সংগীত, নৃত্য এবং ভাষার মাধ্যমে এখানকার লোকসংস্কৃতি গড়ে উঠেছে।
  • বহু হিন্দু শাস্ত্র ও কাব্যে এই মন্দিরগুলির উল্লেখ পাওয়া যায়।

দক্ষিণ ভারতের পঞ্চভূত স্তলম বনাম শ্রীলঙ্কার পঞ্চ ঈশ্বরম

শ্রীলঙ্কার পঞ্চ ঈশ্বরমের ধারণাটি ভারতের পঞ্চভূত স্তলম (ভূমি, জল, অগ্নি, বায়ু ও আকাশ) থেকে আলাদা:

বিষয় পঞ্চ ঈশ্বরম পঞ্চভূত স্তলম
অবস্থান শ্রীলঙ্কা দক্ষিণ ভারত
প্রতীক শিবের আবাস প্রকৃতির পাঁচ উপাদান
মন্দির সংখ্যা
দর্শন শৈব দর্শন শৈব দর্শন
ইতিহাস নায়নার ও রাবণের যুগ থেকে চোল ও পল্লব রাজত্বকাল থেকে

উপসংহার

পঞ্চ ঈশ্বরম কেবলমাত্র শিবের পবিত্র তীর্থ নয়, বরং এটি শ্রীলঙ্কার ইতিহাস, ধর্ম ও সংস্কৃতির মিলনস্থল। প্রতিটি মন্দিরের পেছনে লুকিয়ে আছে এক একটি ইতিহাস, বিশ্বাস, ও পৌরাণিক কাহিনী। আজকের দিনে এই মন্দিরগুলি হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের জন্য একটি নতুন আশার আলো, যা অতীতের ঐতিহ্যকে বর্তমান প্রজন্মের সামনে জীবন্ত করে তোলে।

এই পাঁচটি মন্দির কেবল শিবভক্তদের হৃদয়ে নয়, শ্রীলঙ্কা ও দক্ষিণ এশিয়ার ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক মানচিত্রে চিরস্থায়ী ছাপ রেখে চলেছে।


#পঞ্চঈশ্বরম #শিবমন্দির #শ্রীলঙ্কারইতিহাস #Munneswaram #Koneswaram #Thiruketheeswaram #Naguleswaram #Tondeswaram #তামিলঐতিহ্য #শৈবসিদ্ধান্ত #হিন্দুধর্ম #রাবণ #ত্রিনকোমালি #শিবভক্তি


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

যদি আপনার কোনও বিষয়ে ডাউট থাকে বা কোনও বিষয় suggest করতে চান তাহলে মেল করুন!

নবীনতর পূর্বতন

banglafacts 4