সব তারা কি গ্রহ নিয়ে গঠিত? মহাবিশ্বের তারা ও তাদের পারিপার্শ্বিক বস্তুসমূহের বিস্ময়কর জগৎ

 


🌌 🌠

ভূমিকা

রাত্রি আকাশে অসংখ্য তারা ঝলমল করে। অনেকেই হয়তো ভাবেন, প্রতিটি তারা কি আমাদের সূর্যের মতোই? অর্থাৎ, তাদের চারপাশে কি গ্রহ রয়েছে? তারা কি সবসময়ই কোনো সৌরজগত গঠন করে? কিংবা তারা কি একাকী অবস্থান করে মহাশূন্যে?

এই প্রবন্ধে আমরা জানবো—সব তারা কি গ্রহ নিয়ে গঠিত, তাদের প্রকারভেদ, গ্রহ গঠনের শর্ত, এবং কোন ধরনের তারা সাধারণত গ্রহযুক্ত হয়। এছাড়াও সংক্ষেপে আলোচনা করবো মহাজাগতিক বিস্ফোরণ, কৃষ্ণগহ্বর (ব্ল্যাক হোল), এবং তারা-গ্রহের সম্পর্কের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা।

sob-tara-ki-groh-niye-gothito

মহাবিশ্বে তারার উৎপত্তি

তারা গঠিত হয় মহাকাশে ছড়িয়ে থাকা বিশাল গ্যাসীয় ও ধূলিকণার মেঘ—নেবুলা থেকে। মূলত হাইড্রোজেন গ্যাস সংকোচিত হয়ে কেন্দ্রে চরম তাপ ও চাপের মাধ্যমে নিউক্লিয়ার ফিউশন শুরু করে। তখনই তারা জন্ম নেয়। এই প্রক্রিয়ায় হাইড্রোজেন পরিণত হয় হিলিয়ামে এবং বিপুল পরিমাণ শক্তি নিঃসৃত হয়, যা আমরা আলো ও তাপরূপে দেখতে পাই।


সূর্য ও আমাদের সৌরজগত: একটি পরিচিত উদাহরণ

আমাদের পরিচিত তারাটি হল সূর্য, যার চারপাশে আটটি গ্রহ, অসংখ্য উপগ্রহ, গ্রহাণু, ধূমকেতু এবং আরও অনেক বস্তু আবর্তন করছে। এটিই হলো একটি পূর্ণাঙ্গ সৌরজগত। সূর্য হলো G-টাইপ প্রধান-অনুক্রম তারকা (main-sequence star)। তবে, প্রশ্ন হলো—সব তারা কি এমনভাবে সৌরজগত তৈরি করে?

উত্তর হলো—না, সব তারা নয়।


সব তারা কি গ্রহ সৃষ্টি করে?

তথ্য ও পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে জানা গেছে, মহাবিশ্বে কোটি কোটি তারা রয়েছে। তবে সব তারা গ্রহ সৃষ্টি করে না বা তাদের চারপাশে গ্রহ আবর্তিত হয় না।

কারণ কী?

তারা ও গ্রহ একসাথে সৃষ্টি হয়। যখন একটি তারার জন্য গ্যাস ও ধূলিকণার মেঘ (nebula) সংকুচিত হয়, তখন কিছু অংশ থেকে তারা তৈরি হয়, এবং চারপাশে বাকি ধুলোকণাগুলো ঘূর্ণায়মান ডিস্ক (protoplanetary disk) তৈরি করে—যেখান থেকে গ্রহ, উপগ্রহ ও গ্রহাণু গঠিত হয়।

কিন্তু—

  • সব নেবুলা বা গ্যাসীয় মেঘ যথেষ্ট ঘন না হলে, গ্রহ তৈরি হয় না।
  • কোন কোন ক্ষেত্রে পারিপার্শ্বিক পরিবেশ যেমন অন্যান্য তারার মহাকর্ষীয় প্রভাব, বা বিস্ফোরণ—গ্রহ গঠনের উপাদান নষ্ট করে দেয়।
  • অনেক বড় তারার জীবনকাল এতই ছোট যে গ্রহ গঠনের আগেই তারা সুপারনোভা বিস্ফোরণে ধ্বংস হয়ে যায়।

গ্রহ থাকা বা না থাকার উপর নির্ভর করে বিভিন্ন বিষয়:

১. তারা কত বড় বা কত ওজনের?

  • মাঝারি ও ছোট তারা (যেমন সূর্য): এদের জীবদ্দশা অনেক দীর্ঘ (১০ বিলিয়ন বছর পর্যন্ত), তাই গ্রহ তৈরি হওয়ার ও বিকশিত হওয়ার সুযোগ থাকে।
  • বড় তারা (যেমন O-type): অত্যন্ত দ্রুত ফিউশন ঘটে এবং কয়েক মিলিয়ন বছরের মধ্যে সুপারনোভা হয়ে যায়। এত স্বল্প সময়ে গ্রহ তৈরি হওয়া কঠিন।

২. তারা কি একা, নাকি জোড়া বা ত্রয়ী তারকাব্যবস্থার অংশ?

  • একক তারা: এদের চারপাশে গ্রহ গঠনের সম্ভাবনা বেশি।
  • বাইনারি বা মাল্টি-স্টার সিস্টেম: এখানে মহাকর্ষীয় জটিলতা বেশি থাকায় গ্রহ গঠনে ব্যাঘাত ঘটে, যদিও কিছু ক্ষেত্রে গ্রহ পাওয়া গেছে।

৩. তারা কী পর্যায়ে আছে?

  • Main sequence তারা: এই পর্যায়ে ফিউশন স্থিতিশীল থাকে এবং এটি গ্রহের জন্য উপযুক্ত সময়।
  • Red Giant বা White Dwarf: জীবনের শেষ পর্যায়ে গ্রহ ধ্বংস হয়ে যেতে পারে।

একাকী তারা: কোনো সৌরজগত ছাড়া

অনেক তারা মহাকাশে একাকী ঘুরে বেড়ায়, যাদের কোনো গ্রহ বা উপগ্রহ নেই। এই ধরনের তারা সাধারণত:

  • প্রোটোপ্ল্যানেটারি ডিস্ক গঠন করতে পারেনি।
  • অতিমাত্রায় গরম বা বিশাল।
  • অন্য কোনো তারকাজোটের প্রভাবের কারণে গঠিত গ্রহগুলিকে হারিয়ে ফেলেছে।

গ্রহযুক্ত তারা শনাক্তকরণ

গত দুই দশকে, বিজ্ঞানীরা এক্সোপ্ল্যানেট (অর্থাৎ, সৌরজগতের বাইরের গ্রহ) খোঁজার জন্য অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করছেন। যেমন:

  • Transit Method: তারা ও গ্রহের আলো পর্যবেক্ষণ করে বোঝা যায়, গ্রহ তারা অতিক্রম করলে আলোর মাত্রা সামান্য কমে যায়।
  • Radial Velocity Method: গ্রহের মহাকর্ষীয় টানে তারা সামান্য দুলে ওঠে, যা স্পেকট্রামে ধরা পড়ে।

এইভাবে হাজার হাজার তারা ও এক্সোপ্ল্যানেট শনাক্ত করা হয়েছে, যার মধ্যে কিছুতে জীবন উপযোগী পরিবেশ থাকতে পারে।


মহাকাশে বিস্ফোরিত তারা ও ব্ল্যাক হোল

সবচেয়ে বড় ও ভারী তারাগুলোর শেষ পরিণতি হয় ভয়াবহ সুপারনোভা বিস্ফোরণ। এতে তারা নিজের শক্তি হারিয়ে বিশাল বিস্ফোরণে রূপ নেয়। কিছু ক্ষেত্রে—

  • তারা পরিণত হয় নিউট্রন তারা বা পালসার-এ।
  • আবার কিছু তারা ধ্বসে পড়ে নিজেরই মহাকর্ষে এবং ব্ল্যাক হোল তৈরি করে—যেখানে এমনকি আলোও পালাতে পারে না।

এই তারাগুলোর আশেপাশে সাধারণত কোনো গ্রহ থাকে না, বা থাকলেও সুপারনোভার সময় ধ্বংস হয়ে যায়।


তারাদের শ্রেণীবিন্যাস ও গ্রহ সম্পর্ক

তারার ধরণ রঙ আয়ু গ্রহ থাকার সম্ভাবনা
O-type নীল ১-১০ মিলিয়ন বছর অত্যন্ত কম
B-type নীল-সাদা ১০-১০০ মিলিয়ন বছর কম
A-type সাদা ৫০০ মিলিয়ন বছর মাঝারি
F-type সাদা-হালকা হলুদ ২-৪ বিলিয়ন বছর মাঝারি
G-type (যেমন সূর্য) হলুদ ১০ বিলিয়ন বছর বেশি
K-type কমলা ২০-৩০ বিলিয়ন বছর বেশি
M-type লাল ১০০+ বিলিয়ন বছর সর্বোচ্চ

কিছু আকর্ষণীয় তথ্য

  • এখন পর্যন্ত ৫৫০০-এর বেশি এক্সোপ্ল্যানেট আবিষ্কৃত হয়েছে (২০২৫ অনুযায়ী)।
  • Proxima Centauri—আমাদের নিকটতম তারা—এর চারপাশেও গ্রহ আছে বলে বিশ্বাস করা হয়।
  • Trappist-1 নামক M-type একটি তারা, যার চারপাশে ৭টি গ্রহ আবিষ্কৃত হয়েছে।

উপসংহার

সব তারা গ্রহ সৃষ্টি করে না। তবে মহাবিশ্বে লক্ষ লক্ষ তারা এমন রয়েছে, যারা আমাদের সূর্যের মতো সৌরজগত গঠন করেছে, আবার অনেকেই রয়েছে একাকী বা শুধু অন্য তারার সঙ্গী হিসেবে।

তাদের গঠন, আকার, তাপমাত্রা, জীবনকাল ও আশেপাশের অবস্থার উপর নির্ভর করে তারা একটি গ্রহমণ্ডল গঠন করতে পারে কি না।

আজকের বিজ্ঞান এসব বিষয় আরও গভীরভাবে জানার চেষ্টা করছে। ভবিষ্যতে হয়তো আমরা এমন কোনো তারা বা গ্রহ আবিষ্কার করবো যেখানে প্রাণের সম্ভাবনাও থাকবে।


📅 তারিখ: জুলাই ২০২৫
📚 বিষয়: মহাবিশ্ব, তারা ও গ্রহ


পছন্দ হলে শেয়ার করুন! 🌌
#তারা #গ্রহ #মহাবিশ্ব #এক্সোপ্ল্যানেট #ব্ল্যাকহোল #সৌরজগত #বিজ্ঞানেরআলো


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

যদি আপনার কোনও বিষয়ে ডাউট থাকে বা কোনও বিষয় suggest করতে চান তাহলে মেল করুন!

নবীনতর পূর্বতন

banglafacts 4