বালুচিস্তান – পাকিস্তানের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের এক বিস্তীর্ণ, প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ প্রদেশ, যা বহু দশক ধরেই জাতীয়তাবাদ, রাজনৈতিক বঞ্চনা এবং সামরিক দমন-পীড়নের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে বালুচিস্তান লিবারেশন ফ্রন্ট (BLF)-এর নেতৃত্বে “অপারেশন বাম” নামে একটি নতুন সামরিক অভিযান এই দীর্ঘস্থায়ী সংঘাতকে এক বিপজ্জনক মোড়ে নিয়ে গেছে।

এই নিবন্ধে আমরা অপারেশন বাম, তার সামরিক ও রাজনৈতিক তাৎপর্য, এবং বালুচিস্তানের দীর্ঘদিনের আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে এর গুরুত্ব নিয়ে বিশ্লেষণ করব।
🎯 কী হচ্ছে অপারেশন বাম?
“অপারেশন বাম” (Baam অর্থ "ভোর" বা "ঊষা") হল বালুচিস্তান লিবারেশন ফ্রন্ট (BLF)-এর একটি সুসমন্বিত ও বহুমুখী সামরিক অভিযান যা ২০২৫ সালের মাঝামাঝি সময়ে শুরু হয়। এই অভিযানে BLF দাবি করেছে যে, এটি বালুচ মুক্তিযুদ্ধের একটি “নতুন যুগের সূচনা” – যেখানে ছায়া থেকে বেরিয়ে এসে তারা সরাসরি সংঘাতে জড়িয়েছে পাকিস্তানি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে।
🔫 সুসমন্বিত আক্রমণের ধরন
অপারেশন বাম BLF-এর যুদ্ধ কৌশলে একটি মৌলিক পরিবর্তনের সূচনা করেছে। পূর্বে যেখানে তারা গেরিলা আক্রমণ বা হিট-অ্যান্ড-রান পদ্ধতিতে সীমাবদ্ধ ছিল, সেখানে এই অভিযানে তারা ব্যাপক ও একযোগে ফ্রন্টাল অ্যাসল্টে অংশ নেয়।
📍 আক্রমণের এলাকা:
BLF দাবি করেছে যে তারা অন্তত ১৭টি পৃথক আক্রমণ চালিয়েছে, যদিও কিছু রিপোর্টে এই সংখ্যা ৭০-এরও বেশি বলে দাবি করা হচ্ছে। প্রধান হামলার এলাকা:
- পাঞ্জগুর (Panjgur)
- সুরাব (Surab)
- কেচ (Kech)
- খারান (Kharan)
- এবং বিস্তৃতভাবে: সোভাবতপুর, নাসিরাবাদ, কারমো ওয়াধ প্রভৃতি এলাকায়।
এই অঞ্চলগুলোতে সামরিক চৌকি, সরকারি প্রশাসনিক ভবন, এবং সিপেক (CPEC) সংক্রান্ত অবকাঠামো ছিল মূল টার্গেট।
🛡️ টার্গেট ও ক্ষয়ক্ষতি
BLF-এর এই সুপরিকল্পিত হামলায় তারা মূলত নিচের লক্ষ্যবস্তুগুলোর উপর আঘাত হানে:
- সামরিক চৌকি ও ফাঁড়ি
- সরকারী প্রশাসনিক ভবন
- টেলিযোগাযোগ অবকাঠামো
- রেল পরিষেবা ও সড়ক পরিবহন
- CPEC প্রকল্পের স্ট্র্যাটেজিক অংশ
এতে ইন্টারনেট সংযোগ ব্যাহত হয়, ট্রেন চলাচল বন্ধ হয় এবং গুরুত্বপূর্ণ সড়ক ও রেললাইন মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। CPEC প্রকল্প, যেটি চীনের "বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ"-এর অংশ, সেটির কার্যক্রমও এই হামলার ফলে বড় ধাক্কা খায়।
⚔️ কৌশলগত পরিবর্তন: গেরিলা থেকে খোলা যুদ্ধক্ষেত্রে
“অপারেশন বাম” কেবল একটি সামরিক অভিযান নয়, এটি একটি কৌশলগত বিবর্তনের প্রতীক। বালুচিস্তানের সশস্ত্র আন্দোলন বহু বছর ধরেই গোপন হামলার উপর নির্ভর করত। কিন্তু এবার তারা প্রকাশ্য সংঘাতে অবতীর্ণ হয়েছে — যা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জন্যও এক নতুন চ্যালেঞ্জ।
এই খোলামেলা এবং একযোগে ফ্রন্টাল অ্যাটাক প্রমাণ করে যে, BLF এখন শুধু টিকে থাকার লড়াই করছে না – বরং তারা আক্রমণাত্মকভাবে নিজেদের অবস্থান পাকাপোক্ত করতে চাইছে।
🌐 বিস্তৃত অভিযান – ভূগোলের সীমানা ছাড়িয়ে
বালুচিস্তানের পূর্বাঞ্চলে সোভাবতপুর, নাসিরাবাদ ও কারমো ওয়াধ – ঐতিহ্যগতভাবে BLF-এর অপারেশনের বাইরের এলাকাগুলোতেও এবার বিস্তার ঘটেছে। এই ঘটনার মাধ্যমে বোঝা যায় যে, তারা নতুন রিক্রুটমেন্ট ও স্থানীয় সমর্থনের মাধ্যমে তাদের কর্মকাণ্ডের পরিসর বাড়াতে পেরেছে।
এতে বোঝা যায় যে এই আন্দোলন এখন শুধু পাহাড় ও সীমান্ত অঞ্চলের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং বালুচিস্তানের অভ্যন্তরে বিস্তৃতভাবে ছড়িয়ে পড়ছে।
⚖️ রাজনৈতিক প্রতীকী বার্তা
অপারেশন বাম শুধু একটি সামরিক কৌশল নয়, এটি রাজনৈতিক প্রতীকবাদ বহন করে। এই অভিযান পাকিস্তানি রাষ্ট্রের প্রতি একটি শক্ত বার্তা দেয় যে বালুচিস্তানের স্বাধীনতার জন্য লড়াই এখন আরও সংগঠিত, সুসংহত ও বিস্তৃত।
এটি স্পষ্টভাবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চায়। সম্প্রতি কিছু বালুচ নেতারা “রিপাবলিক অব বালুচিস্তান”-এর ঘোষণা দিয়ে ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, জাতিসংঘ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের কাছে স্বীকৃতির আহ্বান জানিয়েছে।
💣 সংঘাতের তীব্রতা ও ভবিষ্যৎ শঙ্কা
অপারেশন বাম একটি বড় ধরণের যুদ্ধাবস্থার সূচনা করেছে। এত বড় আকারে সমন্বিত হামলা পাকিস্তানে সম্প্রতি দেখা যায়নি। এর ফলে নিরাপত্তা বাহিনী কঠোর অবস্থান নিয়েছে এবং বিভিন্ন এলাকায় সেনা অভিযান জোরদার করা হয়েছে।
🔍 পাকিস্তানি প্রতিক্রিয়া:
পাকিস্তানি সরকার এখনো এই হামলা নিয়ে বিস্তারিত আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া দেয়নি। তবে সেনাবাহিনী বিভিন্ন জেলায় সার্চ অপারেশন শুরু করেছে। সংবাদ সংস্থা সূত্রে জানা গেছে, হেলিকপ্টার টহল এবং সীমান্ত এলাকায় নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।
😡 বালুচ ক্ষোভের শিকড়
বালুচ বিদ্রোহ শুধু সামরিক নয়, এটি বহু দশক ধরে জমে ওঠা আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষোভের ফলাফল। বালুচ জাতীয়তাবাদীরা মনে করেন:
- সম্পদ শোষণ: বালুচিস্তান প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর – গ্যাস, খনিজ, তামা, সোনা – কিন্তু এখানকার জনগণ সেই সম্পদের সুফল থেকে বঞ্চিত।
- অর্থনৈতিক বঞ্চনা: শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থানের দিক থেকে বালুচিস্তান পাকিস্তানের সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া অঞ্চলগুলোর একটি।
- রাজনৈতিক প্রান্তিকতা: জাতীয় রাজনীতিতে বালুচদের অংশগ্রহণ সীমিত; স্থানীয় নেতাদের প্রভাব থাকলেও কেন্দ্রীয় নীতিনির্ধারণে তাদের উপেক্ষা করা হয়।
- মানবাধিকার লঙ্ঘন: শত শত বালুচ অ্যাক্টিভিস্ট ও তরুণ "গুম" হয়ে গেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এই enforced disappearances নিয়ে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলিও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
🌍 আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও সম্ভাবনা
বর্তমানে আন্তর্জাতিক মহল এই সংঘাত নিয়ে সরাসরি কিছু বলেনি। তবে মানবাধিকার সংগঠনগুলো নিয়মিতভাবে পাকিস্তানে বালুচ জনগণের উপর দমন-পীড়নের অভিযোগ তুলে ধরেছে। BLF এবং অন্যান্য বালুচ সংগঠনগুলো জাতিসংঘে ও বিভিন্ন বিদেশি দূতাবাসে অব্যাহতভাবে তাদের দাবিগুলো তুলে ধরছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, যদি এই সংঘাত আরও বাড়ে এবং আন্তর্জাতিক মিডিয়াতে জোরালোভাবে উঠে আসে, তাহলে ভারত, ইরান, চীন এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের ভূরাজনৈতিক স্বার্থ এতে জড়িয়ে যেতে পারে।
📉 চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর (CPEC)-এর উপর প্রভাব
CPEC, যা চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের গুরুত্বপূর্ণ অংশ, বালুচিস্তানকে কেন্দ্র করেই গঠিত। গাওদার বন্দর, যা CPEC-এর মূল ঘাঁটি, সেটিও BLF-এর আক্রমণের আওতায় এসেছে। এটি শুধু পাকিস্তান নয়, চীনের পক্ষেও এক উদ্বেগজনক বার্তা।
যদি এই ধরণের আক্রমণ অব্যাহত থাকে, তাহলে CPEC প্রকল্পের ভবিষ্যৎ ঝুঁকিতে পড়বে এবং আঞ্চলিক বাণিজ্যে বিশাল প্রভাব পড়তে পারে।
🔚 উপসংহার: এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা?
অপারেশন বামের মাধ্যমে BLF এবং বালুচ স্বাধীনতাকামী শক্তিগুলো স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছে যে, তারা শুধু অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই নয়, স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে এখন আরও সংগঠিত ও আত্মবিশ্বাসী।
পাকিস্তান সরকারের জন্য এটি এক গুরুতর সতর্কতা – সামরিক পদক্ষেপে হয়তো কিছু সময়ের জন্য বিদ্রোহ দমন করা যায়, কিন্তু বালুচ জনগণের দীর্ঘদিনের দাবি ও ক্ষোভকে উপেক্ষা করলে এই সংঘাত আরও বিস্ফোরক হয়ে উঠতে পারে।
একদিকে যেমন যুদ্ধাবস্থা ও মানবিক সংকট ঘনীভূত হচ্ছে, অন্যদিকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করছে বালুচিস্তানের ‘নতুন ভোর’ – “অপারেশন বাম”।
📌 হ্যাশট্যাগ:
#OperationBaam #BalochistanCrisis #BLF #BalochFreedom #বাংলাব্লগ #আন্তর্জাতিকরাজনীতি #CPEC #পাকিস্তান #বালুচিস্তান