বাংলাদেশের সামরিক চুক্তি: পাকিস্তান নাকি চীন? নিরাপত্তা ও কৌশলগত স্বায়ত্তশাসনের ভবিষ্যৎ পথ

বাংলাদেশের সামরিক চুক্তিতে পাকিস্তান ও চীনের প্রভাব বিশ্লেষণ


বাংলাদেশের কৌশলগত অবস্থান দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনৈতিক মানচিত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী এই রাষ্ট্রটি ভারত-মিয়ানমার সীমান্তে অবস্থিত, যার ভৌগোলিক বাস্তবতা এবং অর্থনৈতিক কাঠামো তাকে একাধিক বৈশ্বিক শক্তির আগ্রহের কেন্দ্রে নিয়ে আসে। দ্রুত পরিবর্তনশীল আন্তর্জাতিক রাজনীতি, আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা, এবং বহু-মেরু বিশ্বব্যবস্থার মধ্যে বাংলাদেশ নিজেকে এমন এক অবস্থানে খুঁজে পায়, যেখানে শক্তি-নির্ভর সামরিক জোট শুধু নিরাপত্তা নয়, বরং দীর্ঘমেয়াদী স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতে পারে।

এই প্রেক্ষাপটে, বাংলাদেশের নিরাপত্তা স্বার্থের জন্য পাকিস্তান বা চীনের সাথে গভীর সামরিক জোট কতটা লাভজনক—বা বিপজ্জনক—এটি বিশ্লেষণ করা জরুরি। দুই দেশের সাথেই বাংলাদেশের সামরিক যোগাযোগ নতুন মাত্রা নিয়েছে, কিন্তু তাদের সাথে একচেটিয়া সম্পর্ক কি বাংলাদেশের পক্ষে নিরাপদ? নাকি বরং এ ধরনের জোট কৌশলগত স্বায়ত্তশাসনের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে?

বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা ও কূটনৈতিক কৌশলের প্রশ্নে এই আলোচনাটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।


পাকিস্তানের সাথে সামরিক সম্পর্কের নতুন বাস্তবতা

২০২৫ সালের অক্টোবরে পাকিস্তান ও বাংলাদেশের সামরিক সম্পর্ক নতুন গতির ইঙ্গিত দেয়। পাকিস্তানের জয়েন্ট চিফস অফ স্টাফ কমিটির চেয়ারম্যান জেনারেল সাহির শামশাদ মির্জার সফরকে কেন্দ্র করে, দুই দেশের মধ্যে সামরিক প্রশিক্ষণ, যৌথ মহড়া এবং সন্ত্রাসবাদবিরোধী অভিজ্ঞতা বিনিময়ের বিষয়ে চুক্তি হয়।

ঢাকায় তার বৈঠকে মির্জা বাংলাদেশের সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর প্রধানদের সাথে সরাসরি বৈঠক করেন। সফরে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসও উপস্থিত ছিলেন। আলোচনার পর, উভয় দেশ সামরিক সহযোগিতা বৃদ্ধির ঘোষণা দেয়।

কিন্তু এই সম্পর্কের অন্তরালে লুকিয়ে আছে একাধিক ঝুঁকি—

১. পাকিস্তানের অর্থনৈতিক দুর্বলতা

পাকিস্তান বর্তমানে তার ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুতর অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে রয়েছে। ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বরে দেশটির বাণিজ্য ঘাটতি ৩.৩৪ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছায়। এছাড়াও, IMF-এর ২০২২ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী, পাকিস্তানের বৈদেশিক ঋণের ৩০ শতাংশ চীনের কাছে।

এমন অবস্থায় পাকিস্তান বাংলাদেশকে বড় ধরনের প্রতিরক্ষা সহায়তা বিনামূল্যে দিতে পারবে—এমন আশা বাস্তবসম্মত নয়। পাকিস্তানের সামরিক সহায়তা আসলে নির্ভর করবে চীনের আর্থিক ও রাজনৈতিক ইশারার ওপর।

২. ISI-এর উপস্থিতি ও আঞ্চলিক উত্তেজনা

ঢাকায় পাকিস্তানের হাই কমিশনে একটি বিশেষ ISI সেল স্থাপনের খবর প্রকাশ্যে এসেছে। এতে প্রথম পর্যায়ে এক ব্রিগেডিয়ার, দুই কর্নেল, চার মেজরসহ গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের একটি দল নিয়োগ দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে।

এই যৌথ গোয়েন্দা ব্যবস্থার লক্ষ্য মূলত বঙ্গোপসাগর এবং ভারতের পূর্ব সীমান্তে নজরদারি। বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করে ভারতীয় সীমান্তে গোয়েন্দা কার্যক্রম চালানোর আশঙ্কা রয়েছে, যা বাংলাদেশকে ভারত-পাকিস্তান বিরোধের মধ্যে টেনে নিতে পারে।

৩. সামরিক সক্ষমতা ও বাস্তবতার প্রশ্ন

পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী মূলত চীনা প্রযুক্তির উপর নির্ভরশীল। কিন্তু এখনও পর্যন্ত সেসব যন্ত্রপাতি বড় কোনো যুদ্ধ বা চরম পরিস্থিতিতে পরীক্ষিত নয়। তাছাড়া, বাংলাদেশের পাহাড়ি ও নদীবহুল সীমান্ত পাকিস্তানের ভূপ্রকৃতি থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। এই কারণে পাকিস্তানের সামরিক অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের মাটিতে প্রযোজ্য হবে না।

১৯৭১ সালের যুদ্ধের সময়ও পাকিস্তান একই ধরনের ভৌগোলিক ও কৌশলগত ভুলের কারণে পরাজিত হয়েছিল।


চীনের সাথে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা: শক্তিশালী, কিন্তু কৌশলগত জটিলতায় ভরা

চীনের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক ২০১০-এর দশক থেকে বহুমাত্রিক রূপ পেতে শুরু করে। চীন এখন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় অস্ত্র সরবরাহকারী দেশ। ২০১৯-২০২৩ সালের মধ্যে বাংলাদেশের মোট অস্ত্র আমদানির ৭২ শতাংশ এসেছে চীন থেকে।

এই সম্পর্ক চীনের ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’-এর (BRI) অংশ হিসেবে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ বলেই মনে করা হয়।

চুক্তির বড় সাফল্য:

✅ বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় প্রতিরক্ষা চুক্তি হলো চীনা চেংডু J-10CE মাল্টিরোল ফাইটার জেট ক্রয়, যার মূল্য ২.২ বিলিয়ন ডলার।
✅ চীনের সহযোগিতায় নির্মিত হচ্ছে BNS পেকুয়া নৌ ঘাঁটি, যার জন্য চীন বিনিয়োগ করেছে ১.২২ বিলিয়ন ডলার।
✅ ২০২৫ সালের আগস্টে বাংলাদেশ সেনাপ্রধানের চীন সফর হয়, যেখানে FK-3 সারফেস-টু-এয়ার মিসাইল এবং VT সিরিজ ট্যাংক সংগ্রহ নিয়ে আলোচনা হয়েছে।

চীনা সহযোগিতার সুবিধা

🔸 চীনা প্রযুক্তি তুলনামূলক সস্তা—যেমন J-10CE জেটের দাম Dassault Rafale বা F-35-এর চেয়ে অনেক কম।

🔸 চীন আর্থিক সহায়তার সঙ্গে সামরিক অবকাঠামো নির্মাণেও আগ্রহী।

🔸 চীনের মাধ্যমে বাংলাদেশ আঞ্চলিক অস্ত্রবাজারে প্রতিযোগিতামূলক সক্ষমতা অর্জন করেছে।

তবে এই সুস্পষ্ট সুবিধার পাশাপাশি কৌশলগত ঝুঁকিও রয়েছে যা উপেক্ষা করা যায় না—

চীনের সাথে সম্পর্কের বড় ঝুঁকি

১️⃣ ঋণের ফাঁদ—শ্রীলঙ্কার অভিজ্ঞতার পুনরাবৃত্তি?
হাম্বানটোটা বন্দরের নিয়ন্ত্রণ ৯৯ বছরের জন্য চীনের হাতে গেলে শ্রীলঙ্কা কঠিন অর্থনৈতিক ধাক্কা খায়। বাংলাদেশ বর্তমানে দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের কাছ থেকে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ঋণ গ্রহণকারী দেশ। বাংলাদেশ চীনের কাছে প্রায় ১৭.৫৪ বিলিয়ন ডলার ঋণী।

২️⃣ অস্ত্রের মান—পরীক্ষিত নয়
চীনা সামরিক সরঞ্জামের মান নিয়ে মাঝেমধ্যে অসন্তোষের কথা শোনা গেছে। চীন ১৯৭৯ সালের পর থেকে কোনো বড় যুদ্ধে সামরিকভাবে জড়িত হয়নি, ফলে তাদের অস্ত্র যুদ্ধক্ষেত্রে কতটা কার্যকর—তা বলা কঠিন।

৩️⃣ ভারতের উদ্বেগ
বাংলাদেশে চীনের সামরিক উপস্থিতি ভারতকে উদ্বিগ্ন করছে। ভারতের পূর্ব সীমান্ত চীনা রাডারের আওতায় চলে আসার সম্ভাবনা ভারতের কৌশলগত হিসাব বদলে দিতে পারে। ফলে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কেও টানাপড়েনের উদ্ভব হতে পারে।

৪️⃣ কৌশলগত নির্ভরতা
চীনের সাথে একচেটিয়া সামরিক সম্পর্ক বাংলাদেশের কৌশলগত স্বায়ত্তশাসনকে হুমকির মুখে ফেলতে পারে। দীর্ঘ মেয়াদে চীন হয়তো রাজনৈতিক বা সামরিক সিদ্ধান্তে সরাসরি প্রভাব ফেলতে চাইবে।


বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কাঠামো: সংকীর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ

বাংলাদেশের অর্থনীতি মূলত তৈরি পোশাক শিল্প (RMG) নির্ভর, যা রপ্তানির ৮০ শতাংশ গঠন করে। এই একক-নির্ভর অর্থনীতি কৌশলগত ঝুঁকি তৈরি করে। Herfindahl-Hirschman Index-এ বাংলাদেশের স্কোর ০.৮৮, যা উন্নয়নশীল দেশের গড় ০.০৯-এর তুলনায় অনেক বেশি।

এমন একটি দেশের পক্ষে বহুপাক্ষিক আর্থিক ও সামরিক অংশীদারিত্ব অপরিহার্য—যাতে কৌশলগত স্থায়িত্ব বজায় থাকে।


বিকল্প প্রতিরক্ষা অংশীদারিত্ব: কৌশলগত ভারসাম্যের পথ

বাংলাদেশের সামনে কৌশলগত নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার সর্বোত্তম উপায় হল সামরিক সম্পর্ক বৈচিত্র্যকরণ। এতে চীন বা পাকিস্তানের উপর অতিরিক্ত নির্ভরতা থেকে বেরিয়ে এসে বহু-সারিবদ্ধতার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণে স্বাধীনতা অর্জিত হবে।

✅ তুরস্ক: যৌথ উৎপাদন ও প্রযুক্তি হস্তান্তরের সুযোগ

বাংলাদেশ ও তুরস্কের মধ্যে প্রতিরক্ষা কাঠামো সহযোগিতার আলোচনা জোরদার হয়েছে। তুরস্ক Hisar-O+ এবং Siper সারফেস-টু-এয়ার মিসাইল সরবরাহে আগ্রহী, যা বাংলাদেশের আকাশ প্রতিরক্ষায় নতুন মাত্রা যোগ করবে।

✅ জাপান: নিরাপত্তা সহায়তার বিস্তৃতি

জাপান তার “Official Security Assistance” কাঠামোর অধীনে বাংলাদেশকে চারটি টহল নৌকা সরবরাহের ঘোষণা দেয়। জাপান বাংলাদেশকে দীর্ঘদিন ধরেই আর্থিক ও মানবিক সহায়তা দিয়ে আসছে।

✅ দক্ষিণ কোরিয়া, জার্মানি ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন

এরা “মধ্যম শক্তি” হিসেবে প্রযুক্তি, উন্নয়ন এবং কূটনৈতিক সহযোগিতায় বাংলাদেশের প্রাকৃতিক অংশীদার হতে পারে।


বাংলাদেশের প্রকৃত নিরাপত্তা হুমকি কোথায়?

মিয়ানমার সীমান্তে অস্থিরতা
আরাকান আর্মির উত্থান, রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যা, এবং সীমান্তে গোলাবর্ষণ—এসবই বাংলাদেশের জন্য বাস্তব নিরাপত্তা ঝুঁকি।

মাদক চোরাচালান
ইয়াবা, আফিম এবং আইসের মতো মাদকদ্রব্য মিয়ানমার সীমান্তঘেঁষা অঞ্চল দিয়ে প্রবেশ করছে। এই প্রবণতা বাংলাদেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তার জন্য গুরুতর হুমকি।

বঙ্গোপসাগরের সামুদ্রিক নিরাপত্তা
জলদস্যুতা, সামুদ্রিক সীমা নিয়ে বিরোধ, এবং অফশোর সম্পদ রক্ষা—এসব ক্ষেত্রে সামুদ্রিক নজরদারি বাড়াতে হবে।


কৌশলগত স্বায়ত্তশাসনের পথ: বঙ্গবন্ধুর নীতির পুনরুজ্জীবন

“সবার সাথে মৈত্রী, কারো প্রতি বিদ্বেষ নয়”—বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের এই পররাষ্ট্র নীতি বাংলাদেশের জন্য আজও প্রাসঙ্গিক। বর্তমানে একক শক্তির উপর নির্ভরতা ঝুঁকিপূর্ণ। বরং বহু-সারিবদ্ধতা, বা Strategic Multi-Alignment বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে যৌক্তিক কৌশল।

এই নীতি অনুসরণে: ✅ সামরিক অংশীদারিত্ব বৈচিত্র্যকরণ
✅ প্রযুক্তি হস্তান্তরের উপর জোর
✅ নমনীয় ঋণ নীতি
✅ বাস্তব নিরাপত্তা হুমকির প্রতি নজর

এসবের মাধ্যমে বাংলাদেশ তার কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন বজায় রাখতে পারবে।


উপসংহার

বাংলাদেশের নিরাপত্তা নীতিতে শুধু পাকিস্তান বা চীন—এমন সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি ক্ষতিকর হতে পারে। পাকিস্তানের অর্থনৈতিক দুর্বলতা এবং গুপ্তচর সংস্থার প্রভাব, চীনের ঋণ-ফাঁদ ও ভারতের উদ্বেগ—এই দুটোই বাংলাদেশকে অস্বস্তিকর অবস্থানে ফেলতে পারে।

সুতরাং সর্বোত্তম পথ হলো কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন বজায় রেখে, প্রতিরক্ষা সহযোগিতাকে বহুমাত্রিক ও বহুজোটভিত্তিক করা। বাংলাদেশের সামরিক নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক স্থায়িত্ব, এবং ভূরাজনৈতিক স্বাধীনতার জন্য এটি অপরিহার্য।

বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ কৌশল নির্ভর করবে একটি শক্তির প্রতি বিরূপতা নয়, বরং নিজের শক্তিকে কিভাবে বহু অংশীদারের মাঝে ভারসাম্যপূর্ণভাবে ব্যবহার করা যায়, তার উপর।


সর্বোপরি বার্তা:
বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা নির্ভর করে স্বাধীন সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতার উপর, কোনো মহান শক্তির অধীনস্থ হওয়ার উপর নয়। কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন এখন শুধু রাজনৈতিক স্লোগান নয়—এটি বেঁচে থাকার অপরিহার্য শর্ত।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

যদি আপনার কোনও বিষয়ে ডাউট থাকে বা কোনও বিষয় suggest করতে চান তাহলে মেল করুন!

নবীনতর পূর্বতন

banglafacts 4