নেপালের Gen-Z আন্দোলন: গণঅভ্যুত্থান না কি মার্কিন রেজিম চেঞ্জ অপারেশন?

নেপালের Gen-Z আন্দোলনের পেছনে মার্কিন রেজিম চেঞ্জ অভিযোগের কার্টুন চিত্র
কার্টুনে নেপাল সংকট: তরুণ আন্দোলন, ভূরাজনীতি ও বিদেশি প্রভাব

 ২০২৫ সালের শেষ প্রান্তে এসে নেপালের রাজনীতি ঘিরে যে বিস্ফোরক অভিযোগ সামনে এসেছে, তা শুধু কাঠমান্ডুর অভ্যন্তরীণ ক্ষমতার পালাবদল নয়—বরং গোটা দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনৈতিক মানচিত্রে একটি বিপজ্জনক দাগ টেনে দিয়েছে। তথাকথিত “Gen-Z protests” বা তরুণদের স্বতঃস্ফূর্ত গণআন্দোলন হিসেবে যে ঘটনাকে এতদিন প্রচার করা হচ্ছিল, ডিসেম্বর ২০২৫-এ ফাঁস হওয়া নথি ও অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে সেই আখ্যান সম্পূর্ণভাবে ভেঙে পড়েছে।

📌 নেপালের Gen-Z আন্দোলন: সংক্ষেপে যা জানা জরুরি

  • কি ঘটেছে? ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বরে নেপালে তরুণদের নেতৃত্বে ব্যাপক আন্দোলনের ফলে প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা অলি পদত্যাগ করেন।
  • ট্রিগার কী ছিল? ২৬টি সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম নিষিদ্ধ করার সরকারি সিদ্ধান্ত থেকেই আন্দোলনের সূচনা।
  • মার্কিন ভূমিকার অভিযোগ? ফাঁস হওয়া নথি অনুযায়ী, NED ও IRI-এর মাধ্যমে যুব সংগঠনগুলোকে অর্থায়ন ও প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল।
  • কৌশলগত উদ্দেশ্য? চীনের BRI প্রভাব দুর্বল করা ও নেপালকে নতুন ভূরাজনৈতিক মঞ্চে রূপান্তর।
  • ভারতের জন্য কেন গুরুত্বপূর্ণ? নেপালের অস্থিরতা ভারতের বাফার স্টেট ধারণা ও সিলিগুড়ি করিডরের নিরাপত্তাকে ঝুঁকিতে ফেলতে পারে।
➡️ বিশ্লেষকদের মতে, এটি ছিল শুধু তরুণ আন্দোলন নয়—বরং দক্ষিণ এশিয়ায় একটি সম্ভাব্য “রেজিম চেঞ্জ মডেল”।

প্রশ্নটা এখন আর “কেন আন্দোলন হলো?” নয়। প্রশ্নটা অনেক বেশি অস্বস্তিকর—
👉 এই আন্দোলন কি আদৌ নেপালি জনগণের ছিল, নাকি ওয়াশিংটনের ল্যাবরেটরিতে তৈরি একটি ‘রেজিম চেঞ্জ প্রজেক্ট’?


‘ডেমোক্র্যাটিক অ্যাসিস্ট্যান্স’ না কি সরাসরি সরকার উৎখাতের নকশা?

The Grayzone, Sunday Guardian-এর মতো অনুসন্ধানী মাধ্যম যেসব ফাঁস হওয়া নথির উল্লেখ করেছে, সেগুলো যদি আংশিক সত্যও হয়, তাহলেও একটি ভয়াবহ চিত্র স্পষ্ট হয়ে ওঠে। অভিযোগ অনুযায়ী, মার্কিন সরকারের ঘনিষ্ঠ প্রতিষ্ঠান—

  • National Endowment for Democracy (NED)

  • International Republican Institute (IRI)

নেপালের তরুণদের মধ্যে ‘গণতান্ত্রিক চেতনা’ ছড়ানোর নামে সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক প্রশিক্ষণ ও অর্থায়ন করেছে।

সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য হলো একটি প্রকল্প—

“Yuva Netritwa: Paradarshi Niti”

যার জন্য allegedly ৩,৫০,০০০ মার্কিন ডলার বরাদ্দ করা হয়।

সরকারি ভাষ্যে এটি ছিল “civic education” বা নাগরিক সচেতনতা কর্মসূচি। কিন্তু ফাঁস হওয়া প্রশিক্ষণ ম্যানুয়ালে কী ছিল?

  • বিক্ষোভ সংগঠনের কৌশল

  • সরকারবিরোধী narrative তৈরি

  • সোশ্যাল মিডিয়া দিয়ে রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে জনমত উসকে দেওয়া

  • “leaderless movement” মডেল প্রয়োগ

এগুলো কি নাগরিক শিক্ষা?
নাকি স্পষ্টভাবে একটি নির্বাচিত সরকার উৎখাতের পাঠ্যক্রম?


NGO না কি রাজনৈতিক অস্ত্র? ‘Hami Nepal’–এর রহস্যজনক রূপান্তর

সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো—যেসব সংগঠনকে সামনে রাখা হয়েছিল, তারা প্রথমে সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক পরিচয়ে কাজ শুরু করেছিল।

Hami Nepal
একসময় ভূমিকম্প ত্রাণ নিয়ে কাজ করা একটি মানবিক সংগঠন। কিন্তু কীভাবে, কবে, কোন প্রক্রিয়ায় এই সংগঠনটি কয়েক মাসের মধ্যে সারা দেশে সমন্বিত রাজনৈতিক আন্দোলন পরিচালনার সক্ষমতা অর্জন করল?

  • তাদের নেতৃত্ব কারা প্রশিক্ষণ দিল?

  • এত দ্রুত nationwide mobilization কীভাবে সম্ভব হলো?

  • সোশ্যাল মিডিয়া ব্যান ঘোষণার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই হাজার হাজার তরুণ রাস্তায় নামল—এটা কি সত্যিই spontaneous?

এখানেই প্রশ্ন ওঠে—
👉 এই আন্দোলন কি সত্যিই ‘leaderless’ ছিল, নাকি অদৃশ্য হাতেই সুতো টানা হচ্ছিল?


সেপ্টেম্বর ২০২৫: একটি পরিকল্পিত বিস্ফোরণ?

ঘটনার টাইমলাইন লক্ষ্য করলে কাকতালীয় বলে এড়িয়ে যাওয়া কঠিন।

🔹 ৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫

কে.পি. শর্মা অলি সরকার ২৬টি সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম নিষিদ্ধ করে—ফেসবুক, এক্স, ইউটিউবসহ।

সরকারের যুক্তি—

  • জাতীয় নিরাপত্তা

  • অবৈধ ডেটা সংগ্রহ

  • রেজিস্ট্রেশন না থাকা

এই সিদ্ধান্ত জনপ্রিয় ছিল না। কিন্তু প্রশ্ন হলো—
👉 একটি অজনপ্রিয় সিদ্ধান্ত থেকেই কীভাবে কয়েক দিনের মধ্যে “সরকার ফেলে দাও” আন্দোলন তৈরি হয়?

🔹 দাবির দ্রুত রূপান্তর

প্রথমে দাবি ছিল—
✔ সোশ্যাল মিডিয়া ব্যান তুলে নাও

কিন্তু খুব দ্রুত স্লোগান বদলে যায়—
❌ দুর্নীতি
❌ সম্পূর্ণ সরকার পদত্যাগ
❌ প্রধানমন্ত্রী অলির পদত্যাগ

এই র‍্যাডিকাল শিফট কি স্বাভাবিক রাজনৈতিক বিবর্তন?
নাকি এটি আগেই লেখা স্ক্রিপ্টের দ্বিতীয় অধ্যায়?


ফলাফল: নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী উৎখাত, অঘোষিত ক্ষমতার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা

শেষ পর্যন্ত কী হলো?

  • সরকারি ভবনে আগুন

  • সহিংস সংঘর্ষ

  • রাষ্ট্র কার্যত অচল

কে.পি. শর্মা অলি পদত্যাগে বাধ্য হন।
দেশ চালানোর দায়িত্ব দেওয়া হয় একটি অন্তর্বর্তী প্রশাসনের হাতে, যার নেতৃত্বে allegedly ছিলেন প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি সুশীলা কার্কি

এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন—
👉 এই অন্তর্বর্তী সরকারকে কে বৈধতা দিল? জনগণ? নাকি বিদেশি কূটনৈতিক সমর্থন?


আসল লক্ষ্য: চীনকে ঠেকানো, নেপালকে ব্যবহার করে

অভিযোগগুলোর ভেতরে ঢুকলে একটি বিষয় স্পষ্ট—
এই পুরো ঘটনাপ্রবাহের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে চীন

🔻 BRI ভাঙার চেষ্টা

অলি সরকার ছিল প্রকাশ্যে চীনঘেঁষা

  • Belt and Road Initiative

  • অবকাঠামো বিনিয়োগ

  • হিমালয় অঞ্চলে চীনের উপস্থিতি

এই সবকিছুই ওয়াশিংটনের চোখে ছিল “strategic threat”।

অলি সরকারের পতন মানে—
✔ চীনের একটি গুরুত্বপূর্ণ হিমালয় ফ্রন্ট দুর্বল করা

🔻 তিব্বত কার্ড

নেপাল ঐতিহাসিকভাবে তিব্বত প্রশ্নে সংবেদনশীল।
একটি আমেরিকাপন্থী সরকার কাঠমান্ডুতে বসলে—

  • চীনের তিব্বত সীমান্তে চাপ

  • exile politics-এর নতুন স্পেস

এই হিসাব কি খুব কঠিন?


ভারতকে পাশ কাটানো: সবচেয়ে বিপজ্জনক দিক

এই পুরো ঘটনায় ভারতের অবস্থান সবচেয়ে অস্বস্তিকর।

ভারত ঐতিহাসিকভাবে নেপালকে দেখেছে—
👉 একটি বাফার স্টেট হিসেবে।

কিন্তু এই তথাকথিত গণঅভ্যুত্থানে—

  • ভারত কার্যত sidelined

  • ওয়াশিংটন সরাসরি খেলায় নেমেছে

এর ফল কী?

🔸 সিলিগুড়ি করিডর ঝুঁকিতে

নেপালের অস্থিরতা সরাসরি প্রভাব ফেলে—

  • চিকেনস নেক

  • উত্তর-পূর্ব ভারতের নিরাপত্তা

ভারতের কৌশলগত উদ্বেগ কি আমেরিকার কাছে আদৌ বিবেচ্য?


‘বাংলাদেশ মডেল’: একই স্ক্রিপ্ট, ভিন্ন দেশ?

সবচেয়ে ভয়ংকর মিল দেখা যায় বাংলাদেশ (২০২৪) ও নেপাল (২০২৫) ঘটনার মধ্যে।

বাংলাদেশনেপাল
ছাত্র আন্দোলনGen-Z আন্দোলন
কোটা ইস্যুসোশ্যাল মিডিয়া ব্যান
“Leaderless” দাবি“Leaderless” দাবি
দ্রুত regime changeদ্রুত regime change
পশ্চিমা সমর্থনপশ্চিমা সমর্থন

এগুলো কি নিছক coincidence?

নাকি এটি একটি পরীক্ষিত রেজিম চেঞ্জ প্লেবুক, যা দক্ষিণ এশিয়ায় একের পর এক প্রয়োগ করা হচ্ছে?


উপসংহার: গণতন্ত্রের মুখোশে সাম্রাজ্যবাদ?

যদি এই অভিযোগগুলোর একাংশও সত্য হয়, তাহলে এটি কেবল নেপালের অভ্যন্তরীণ বিষয় নয়। এটি একটি বড় প্রশ্ন তুলে ধরে—

👉 গণতন্ত্র রপ্তানির নামে কি আমেরিকা এখন সরাসরি রাজনৈতিক প্রকৌশলে নেমেছে?
👉 যে দেশগুলো চীন বা ভারতের সঙ্গে ভারসাম্য রাখতে চায়, তাদের জন্য কি এটাই শাস্তি?

নেপালের তরুণদের ক্ষোভ বাস্তব হতে পারে। দুর্নীতি, বেকারত্ব, দমনপীড়ন—এসব অস্বীকার করা যায় না।
কিন্তু সেই ক্ষোভকে বিদেশি ভূরাজনৈতিক অস্ত্রে পরিণত করা হলে, তা আর গণতন্ত্র থাকে না—তা হয়ে ওঠে নতুন যুগের কোল্ড ওয়ারের হাতিয়ার

আজ নেপাল।
কাল কে?

দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিটি দেশের জন্য এই প্রশ্ন এখন আর তাত্ত্বিক নয়—
এটি অস্তিত্বের প্রশ্ন।

People Also Ask

নেপালের Gen-Z আন্দোলন কি স্বতঃস্ফূর্ত ছিল?
ফাঁস হওয়া নথি অনুযায়ী, এটি সম্পূর্ণ স্বতঃস্ফূর্ত না হয়ে সংগঠিত ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নেটওয়ার্ক দ্বারা পরিচালিত হতে পারে।

NED ও IRI কী?
এগুলো মার্কিন সরকার-ঘনিষ্ঠ প্রতিষ্ঠান, যেগুলো বিশ্বজুড়ে গণতন্ত্র উন্নয়নের নামে রাজনৈতিক প্রকল্পে অর্থায়ন করে।

কেপি শর্মা অলি কেন বিতর্কিত ছিলেন?
তিনি চীনঘেঁষা নীতি ও BRI সমর্থনের জন্য পরিচিত ছিলেন, যা ওয়াশিংটনের কৌশলগত স্বার্থের বিরুদ্ধে যায়।

এই ঘটনার ফলে চীনের কী ক্ষতি হলো?
নেপালে সরকার পরিবর্তনের ফলে BRI প্রকল্প ও তিব্বত সীমান্ত কৌশলে চীনের প্রভাব দুর্বল হতে পারে।

দক্ষিণ এশিয়ায় কি নতুন কোল্ড ওয়ার শুরু হয়েছে?
বিশ্লেষকদের মতে, নেপাল ও বাংলাদেশ ইঙ্গিত দিচ্ছে যে অঞ্চলটি নতুন ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতার ময়দান।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

যদি আপনার কোনও বিষয়ে ডাউট থাকে বা কোনও বিষয় suggest করতে চান তাহলে মেল করুন!

নবীনতর পূর্বতন

banglafacts 4