![]() |
| ১৯৭১ স্মরণ করিয়ে বাংলাদেশকে কূটনৈতিক বার্তা দিল রাশিয়া—দক্ষিণ এশিয়ায় নতুন ভূরাজনৈতিক সংকেত |
ভূমিকা: নীরবতা ভেঙে মস্কোর হস্তক্ষেপ
দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনীতিতে ডিসেম্বর দুই হাজার পঁচিশ একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড় তৈরি করেছে। এতদিন পর্যন্ত যে রাশিয়া বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে তুলনামূলকভাবে নীরব ছিল, সেই মস্কো হঠাৎ করেই প্রকাশ্যে এবং কড়া ভাষায় হস্তক্ষেপ করেছে। ডিসেম্বর বাইশ তারিখে ঢাকায় নিযুক্ত রুশ রাষ্ট্রদূত আলেকজান্ডার গ্রিগোরিয়েভিচ খোজিন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা Muhammad Yunus-এর প্রশাসনকে সরাসরি বলেন—
“Remember 1971”, অর্থাৎ “উনিশশো একাত্তরকে মনে রাখুন”।কূটনৈতিক ভাষায় এটি কোনো সাধারণ মন্তব্য নয়। এটি একটি স্পষ্ট warning। রাশিয়া বলতে চেয়েছে—বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক অস্থিরতা, সহিংসতা এবং ভারত-বিরোধী মনোভাব যদি চলতে থাকে, তবে তার ফল ভালো হবে না। এই বক্তব্যের মাধ্যমে মস্কো কার্যত জানিয়ে দিয়েছে যে, বাংলাদেশ ইস্যুতে তারা আর নিরপেক্ষ দর্শক থাকবে না।
রাশিয়ার এই বক্তব্য একটি সরাসরি কূটনৈতিক সতর্কতা। মস্কো মনে করছে যে বাংলাদেশে বর্তমান রাজনৈতিক অস্থিরতা, সংখ্যালঘু নির্যাতন এবং ভারত-বিরোধী রাজনীতি আঞ্চলিক নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলছে। উনিশশো একাত্তরের ইতিহাস স্মরণ করিয়ে রাশিয়া জানিয়ে দিয়েছে—ভারত–রাশিয়া নিরাপত্তা কাঠামো থেকে সরে গেলে তার কৌশলগত মূল্য দিতে হবে।
এক. পটভূমি: ডিসেম্বরের বারো থেকে বাইশ—রাষ্ট্রব্যবস্থার ভাঙন
রাশিয়ার এই কড়া অবস্থানের পেছনে রয়েছে মাত্র দশ দিনের মধ্যে ঘটে যাওয়া কিছু ভয়াবহ ঘটনা, যা মস্কোর দৃষ্টিতে বাংলাদেশে state control collapse-এর স্পষ্ট ইঙ্গিত।
১. শরীফ ওসমান হাদির হত্যাকাণ্ড
ডিসেম্বর আঠারো তারিখে ঢাকায় গুলিবিদ্ধ হয়ে পরে সিঙ্গাপুরে মারা যান শরীফ ওসমান হাদি। তিনি ছিলেন Inqilab Mancha নামক একটি কট্টর রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্মের মুখ্য সংগঠক। এই প্ল্যাটফর্মটি দুই হাজার চব্বিশ সালের পর থেকে স্পষ্টভাবে anti-India ও উগ্র রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে পরিচিত ছিল।
হাদির মৃত্যুর পর পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়ে ওঠে।
-
সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর আক্রমণ শুরু হয়
-
“প্রো-ইন্ডিয়া” তকমা দিয়ে মিডিয়া হাউস আক্রমণের শিকার হয়
-
বিশেষভাবে Prothom Alo ও The Daily Star-এর অফিস ও সাংবাদিকরা হুমকির মুখে পড়েন
রাশিয়ার কূটনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, এটি ছিল organized mob politics-এর পরিষ্কার নমুনা।
২. দীপু চন্দ্র দাসের নৃশংস হত্যাকাণ্ড
ডিসেম্বর উনিশ তারিখে ময়মনসিংহে ঘটে আরও ভয়ংকর ঘটনা। দীপু চন্দ্র দাস নামে এক হিন্দু গার্মেন্টস শ্রমিককে ধর্ম অবমাননার অভিযোগে প্রকাশ্যে পিটিয়ে হত্যা করা হয় এবং পরে তার দেহ পুড়িয়ে দেওয়া হয়।
এই ঘটনাটি শুধু বাংলাদেশের ভেতরেই নয়, আন্তর্জাতিক স্তরেও প্রবল প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। রাশিয়ার কূটনৈতিক মহল এটিকে সরাসরি বলে—
“proof that the interim government has lost control to Islamist mobs.”
দুই. “Remember 1971”: এই বাক্যের আসল অর্থ কী?
রুশ রাষ্ট্রদূতের বক্তব্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল “Remember 1971”। এটি নিছক ইতিহাস মনে করানো নয়, বরং একটি strategic signal।
একাত্তরের উল্লেখ কেন এত গুরুত্বপূর্ণ?
উনিশশো একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে
-
India সরাসরি সামরিক সহায়তা দিয়েছিল
-
Soviet Union (বর্তমান রাশিয়া) কূটনৈতিক ও সামরিকভাবে ভারতের পাশে দাঁড়িয়েছিল
-
অন্যদিকে United States ও পাকিস্তান একই শিবিরে ছিল
এই ইতিহাস তুলে ধরে রাশিয়া মূলত তিনটি কথা বলছে—
১. সার্বভৌমত্বের উৎস মনে করানো
বাংলাদেশের স্বাধীনতা পশ্চিমা শক্তির দানে আসেনি। এটি এসেছে India–Soviet axis-এর সহায়তায়। আজ যারা ভারত-বিরোধী রাজনীতি করছে, তারা কার্যত সেই ইতিহাসকেই অস্বীকার করছে।
২. ভারতকে চ্যালেঞ্জ করলে রাশিয়াকেও করা হবে
রাষ্ট্রদূত খোজিন স্পষ্টভাবে বলেছেন—
“Ease tensions with India… the sooner the better.”
এটি একটি direct ultimatum। অর্থাৎ ঢাকা যদি দিল্লির সঙ্গে সংঘাতের পথে হাঁটে, তবে মস্কো সেই সংঘাতে ভারতের পাশেই থাকবে।
৩. পশ্চিমমুখী pivot প্রত্যাখ্যান
রাশিয়ার মতে, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার US-backed influence-এর দিকে ঝুঁকছে। মস্কোর দৃষ্টিতে এই পথই বাংলাদেশের অস্থিরতার মূল কারণ।
তিন. ভূ-রাজনৈতিক প্রভাব: বড় খেলায় বাংলাদেশ
ক. রাশিয়া–ভারত সিকিউরিটি অ্যাক্সিস
এই হস্তক্ষেপের মাধ্যমে স্পষ্ট হয়েছে যে বাংলাদেশ ইস্যুতে Russia এবং India এখন কার্যত একই লাইনে।
ভারতের জন্য বাংলাদেশ যদি শত্রুভাবাপন্ন হয়ে ওঠে, তবে তা হবে একটি strategic nightmare—
-
পূর্ব সীমান্ত অস্থির
-
উত্তর-পূর্ব ভারতের নিরাপত্তা হুমকির মুখে
-
সেভেন সিস্টার্স বিচ্ছিন্ন হওয়ার ঝুঁকি
রাশিয়ার হস্তক্ষেপ এই সংকটকে “India vs Bangladesh” থেকে তুলে এনে বানিয়েছে—
“Eurasian Stability vs Radical Chaos”।
খ. যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব ঠেকানো
মস্কোর চোখে বর্তমান পরিস্থিতি একটি পরিচিত pattern। রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মারিয়া জাখারোভা আগেই সতর্ক করেছিলেন—
বাংলাদেশে Arab Spring style destabilization ঘটানোর চেষ্টা হতে পারে।
রাশিয়ার ধারণা—
-
অন্তর্বর্তী সরকার পশ্চিমা সমর্থনে চলছে
-
ভারত-বিরোধী আবেগকে ব্যবহার করে সরকার দুর্বল করা হচ্ছে
-
লক্ষ্য: বাংলাদেশকে একটি US geopolitical outpost বানানো
“Remember 1971” বলে রাশিয়া এই narrative তৈরি করতে চাইছে যে, যুক্তরাষ্ট্র ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধী শিবিরেই ছিল।
গ. রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্প: নীরব চাপ
রাশিয়ার হাতে আছে আরও শক্তিশালী একটি অস্ত্র—Rooppur Nuclear Power Plant।
-
প্রকল্পের মূল্য প্রায় বারো দশমিক ছয় পাঁচ বিলিয়ন ডলার
-
সম্পূর্ণ রাশিয়ান লোন ও প্রযুক্তির উপর নির্ভরশীল
বাংলাদেশ যদি মস্কোর সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ করে, তবে—
-
ফুয়েল সাপ্লাই
-
টেকনিক্যাল সাপোর্ট
-
প্রকল্পের ভবিষ্যৎ
সবই ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে। এটি এক ধরনের economic compulsion।
1971 Liberation War geopolitical impact
চার. সামনে নির্বাচন: ফেব্রুয়ারি দুই হাজার ছাব্বিশ
এই সতর্কবার্তার সময় নির্বাচন করা হয়েছে অত্যন্ত কৌশলগতভাবে।
ফেব্রুয়ারি বারো, দুই হাজার ছাব্বিশ—বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন।
সম্ভাব্য দুটি পথ
Best Case Scenario
-
ইউনুস প্রশাসন সতর্কবার্তা গুরুত্ব সহকারে নেয়
-
কট্টর ভারত-বিরোধী গোষ্ঠীর উপর দমন
-
দিল্লির সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক
-
নির্বাচনের আগে stability ফিরে আসে
Worst Case Scenario
-
সতর্কবার্তা উপেক্ষা
-
ভারত–রাশিয়া আরও কঠোর অবস্থান নেয়
-
কূটনৈতিক isolation
-
অর্থনৈতিক চাপ
-
স্থিতিশীলতা-সমর্থক বিরোধী শক্তিকে নীরব সমর্থন
উপসংহার: “১৯৭১” মানে শেষ সতর্কতা
রাশিয়া স্পষ্ট করে দিয়েছে—
একটি উগ্র, অস্থির এবং ভারত-বিরোধী বাংলাদেশ তারা মেনে নেবে না।
“Remember 1971” কোনো আবেগী স্মরণ নয়। এটি একটি কৌশলগত ঘোষণা।
এর অর্থ—
ইতিহাস ভুলে গেলে ভূ-রাজনীতির মূল্য চুকাতে হয়।
মুহাম্মদ ইউনুসের জন্য এটি কার্যত final notice—
আঞ্চলিক নিরাপত্তা কাঠামোর সঙ্গে থাকুন,
না হলে ইতিহাস আবার কঠোরভাবে মনে করিয়ে দেবে—কারা বন্ধু, আর কারা নয়।
📘 Important Terms / গুরুত্বপূর্ণ পরিভাষা
Remember 1971: রাশিয়ার কূটনৈতিক সতর্কবার্তা, যার মাধ্যমে বাংলাদেশকে তার স্বাধীনতার ইতিহাস ও ভারত–রাশিয়া সহায়তার কথা স্মরণ করানো হয়েছে। এটি একটি কৌশলগত রাজনৈতিক সংকেত।
Interim Government: নির্বাচনের আগে গঠিত অস্থায়ী প্রশাসন, যা বর্তমানে বাংলাদেশে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছে।
India–Russia Security Axis: ভারত ও রাশিয়ার মধ্যে দীর্ঘদিনের সামরিক ও কৌশলগত সহযোগিতা, যা দক্ষিণ এশিয়ার নিরাপত্তা ভারসাম্য বজায় রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
Mob Violence: আইনের বাইরে সংগঠিত জনতার দ্বারা সংঘটিত সহিংসতা, যা রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ দুর্বল হওয়ার ইঙ্গিত দেয়।
Proxy Influence: সরাসরি হস্তক্ষেপ না করে অন্য দেশের রাজনৈতিক গোষ্ঠী বা প্রশাসনের মাধ্যমে প্রভাব বিস্তার করার কৌশল।
Arab Spring Model: মধ্যপ্রাচ্যে সংঘটিত সরকার পতনের ধারাবাহিক আন্দোলনের ধরণ, যা অনেক সময় বাইরের শক্তির প্রভাবেও ঘটেছে বলে মনে করা হয়।
Rooppur Nuclear Power Plant: রাশিয়ার অর্থায়ন ও প্রযুক্তিতে নির্মিত বাংলাদেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প, যা দেশটির জ্বালানি নিরাপত্তার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
Strategic Stability: একটি অঞ্চলে শক্তির ভারসাম্য বজায় থাকা, যাতে বড় ধরনের সংঘাত বা যুদ্ধের সম্ভাবনা কমে যায়।
Diplomatic Isolation: যখন কোনো দেশ আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ শক্তিগুলোর সমর্থন হারাতে শুরু করে।
Election 2026: ফেব্রুয়ারি দুই হাজার ছাব্বিশে অনুষ্ঠিতব্য বাংলাদেশ জাতীয় নির্বাচন, যা দেশের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক দিকনির্দেশ নির্ধারণ করবে।
