![]() |
| সম্রাট হিরোহিতোর ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত—পটসডাম ঘোষণার শর্ত মেনে নেওয়ার মুহূর্ত(ai)। |
Japan Surrender 1945: জাপানের আত্মসমর্পণের প্রকৃত ইতিহাস ও সিদ্ধান্ত
১৯৪৫ সালের আগস্ট মাস। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ অধ্যায় চলছে। পৃথিবীর অনেক জায়গায় যুদ্ধের আগুন ধীরে ধীরে নিভে আসছে, কিন্তু পূর্ব এশিয়ার আকাশ তখনও কালো ধোঁয়ায় ভরা। জাপান তখনও লড়াই করছে—একটি সাম্রাজ্য যার ইতিহাসে কখনও বড় পরাজয় লেখা নেই, আর যার সামরিক নেতৃত্ব বিশ্বাস করে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত দাঁড়িয়ে লড়াই করা তাদের পবিত্র কর্তব্য।
কিন্তু জাপানের ভেতরে ভেতরে তখন শুরু হয়ে গেছে আরেক যুদ্ধ—অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের যুদ্ধ। শান্তি চাওয়া নেতাদের সঙ্গে শেষ পর্যন্ত লড়তে চাওয়া সামরিক গোষ্ঠীর সরাসরি সংঘর্ষ। এই অদৃশ্য যুদ্ধটাই শেষ পর্যন্ত ঠিক করে দেয় জাপানের ভাগ্য।
এই গল্প সেই দ্বন্দ্বের গল্প—কিভাবে এক শব্দের ভুল ব্যাখ্যা, এক ভেঙে পড়া কূটনৈতিক আশা, এক নির্দয় সামরিক বাস্তবতা, আর এক সম্রাটের নীরব হস্তক্ষেপ বিশ্ব ইতিহাসকে নতুন পথে নিয়ে গেল।
১. পটসডাম ডিক্লারেশন এবং ‘মোকুসাতসু’—এক শব্দের ভুল, এক বিপর্যয়
১৯৪৫ সালের ২৬ জুলাই। মিত্রশক্তি জাপানকে পাঠায় পটসডাম ডিক্লারেশন—অর্থাৎ আত্মসমর্পণের শর্ত।
টোকিওতে তখন প্রধানমন্ত্রী কান্তারো সুজুকি। সাংবাদিকরা তাকে জিজ্ঞেস করলেন: জাপান এই শর্ত মানবে কি?
সুজুকি একটি শব্দ ব্যবহার করলেন—“মোকুসাতসু”।
সোজা অনুবাদ করলে এর অর্থ দাঁড়ায় “নীরবতায় হত্যা করা”, অর্থাৎ এমন একটি অস্পষ্ট উত্তর যার মানে হতে পারে—
-
আমরা এখনই কোনো মন্তব্য করছি না
-
আমরা বিষয়টি উপেক্ষা করছি
-
অথবা, আমরা প্রত্যাখ্যান করছি
সুজুকি আসলে এই শব্দ দিয়ে কিছু সময় কিনতে চেয়েছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন সরকার আলোচনা করুক, শান্তিপন্থী নেতারা সমাধান খুঁজুক, আর কূটনৈতিকভাবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা হোক।
কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র এই শব্দটিকে সরাসরি পড়ল Rejection—স্পষ্ট প্রত্যাখ্যান।
হোয়াইট হাউস এবং পেন্টাগনে সিদ্ধান্ত হলো: জাপান আত্মসমর্পণ করতে রাজি নয়। এই ভুল বোঝাবুঝি ইতিহাসকে ঠেলে দিল একটি ভয়াবহ পরিণতির দিকে—atomic bomb ব্যবহারের সিদ্ধান্ত।
২. পটসডাম ঘোষণার নীরব প্রশ্ন—সম্রাটের কী হবে?
জাপানের নেতারা তখন এক বড় দুশ্চিন্তায় ছিলেন। পটসডাম ঘোষণা স্পষ্ট করে বলেনি যে সম্রাট হিরোহিতোর কী হবে।
মিত্রশক্তি শুধু লিখেছে:
“Japan’s government shall be established by the freely expressed will of the Japanese people.”
দেখতে ইতিবাচক মনে হলেও, জাপানি নেতৃত্ব বুঝতে পারছিল না:
-
সম্রাটের কি বিচার হবে?
-
তাকে কি ক্ষমতাচ্যুত করা হবে?
-
তাকে কি মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হবে?
এই প্রশ্নগুলো উত্তরহীন থাকায় জাপানের শীর্ষ নেতৃত্ব গভীর দ্বিধায় পড়ে যায়। জাপানি সংস্কৃতিতে সম্রাট শুধু রাষ্ট্রপ্রধান নন—তিনি জাতির প্রতীক। তাই এই অস্পষ্টতা জাপানের আত্মসমর্পণ সিদ্ধান্তকে আরও জটিল করে তোলে।
৩. ‘বিগ সিক্স’—জাপানের ভিতরের যুদ্ধ
জাপানের supreme ওয়ার কাউন্সিল, যাকে বলা হতো Big Six, দেশকে যুদ্ধ বা শান্তির পথে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিত।
এই ছয়জন হলেন:
-
প্রধানমন্ত্রী সুজুকি কান্তারো
-
পররাষ্ট্রমন্ত্রী শিগেনরি টোগো
-
নৌমন্ত্রী মিতসুমাসা ইয়োনাই
-
যুদ্ধমন্ত্রী জেনারেল কোরেচিকা আনামি
-
আর্মি চিফ অব স্টাফ জেনারেল উমেজু
-
নেভি চিফ অব স্টাফ অ্যাডমিরাল সোএমু টোয়োদা
এই ছয়জন দুই ভাগে বিভক্ত ছিলেন—
শান্তিপন্থী গোষ্ঠী (Suzuki–Togo–Yonai)
তারা বুঝে গিয়েছিলেন জাপানের আর যুদ্ধ জেতার ক্ষমতা নেই।
তাদের বিশ্বাস—যুদ্ধ চললে পুরো দেশ ধ্বংস হয়ে যাবে।
তারা সম্রাটের সঙ্গে পরামর্শ করে সোভিয়েত ইউনিয়নের মাধ্যমে একটি শান্তিচুক্তির পথ খুঁজছিলেন।
যুদ্ধপন্থী গোষ্ঠী (Anami–Umezu–Toyoda)
তাদের অবস্থান ছিল অনেক কঠোর।
তাদের যুক্তি ছিল:
-
জাপান কখনও পরাজয় স্বীকার করেনি
-
আত্মসমর্পণ মানে জাতির অপমান
-
আমেরিকানরা যদি জাপানে আক্রমণ করে, জাপান ভয়ংকর casualty সৃষ্টি করতে পারবে
-
এতে আমেরিকা হয়তো আরও নরম শর্ত দেবে
এই বিশ্বাস ছিল জাপানের সামরিক ঐতিহ্য ও ১৯০৫ সালের রুশ–জাপান যুদ্ধের স্মৃতি থেকে আসা—যেখানে শেষ মুহূর্তের লড়াই জাপানকে আলোচনার টেবিলে শক্ত অবস্থান দিয়েছিল।
৪. শান্তির ভুল আশা—সোভিয়েত ইউনিয়ন কি মধ্যস্থতা করবে?
জুন ১৯৪৫ থেকে জাপানের শীর্ষ নেতৃত্ব একটি কৌশলে ভরসা করেছিল—
সোভিয়েত ইউনিয়নকে neutral mediator হিসেবে ব্যবহার করে একটি সম্মানজনক শান্তিচুক্তি করা।
কিন্তু এই কৌশলের দুটি বড় সমস্যা ছিল:
-
জাপান সোভিয়েত ইউনিয়নকে স্পষ্ট শর্ত দেয়নি
-
তারা জানত না সোভিয়েত নেতৃত্ব আগেই আমেরিকার সঙ্গে গোপনে চুক্তি করেছে জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যোগ দেওয়ার
অর্থাৎ, জাপান যাকে mediator ভাবছিল, সেই শক্তিই কয়েক সপ্তাহ পর তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে চলেছিল।
৫. ৬ আগস্ট: হিরোশিমা—কিন্তু টোকিও এখনও সিদ্ধান্ত নিতে পারে না
৬ আগস্ট ১৯৪৫ সকাল ৮টা ১৫। হিরোশিমার আকাশে একটি অদ্ভুত আলো। আর কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই একটি পুরো শহর ধ্বংস।
কিন্তু জাপানের top leadership প্রথম ২৪ ঘণ্টা নিশ্চিত হতে পারেনি এটি আসলেই atomic bomb কি না।
কারণ আমেরিকা আগেও atomic attack দাবি করেছিল যা পরবর্তীতে ভুল প্রমাণিত হয়েছিল।
যুদ্ধপন্থী গোষ্ঠীর জেনারেলরা তখনও বলছিলেন:
“This is not decisive. We continue the war.”
৬. ৯ আগস্ট: সোভিয়েত আক্রমণ ও নাগাসাকি—জাপানের কৌশল ভেঙে পড়ে
৯ আগস্টের ভোরে সোভিয়েত ইউনিয়ন জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে এবং মাঞ্চুরিয়ায় তীব্র আক্রমণ শুরু করে।
এই আঘাত ছিল আরও ভয়ংকর। কারণ:
-
সোভিয়েত আক্রমণ মানে আর কোনো কূটনৈতিক escape নেই
-
জাপানের সেরা সেনাবাহিনী মাঞ্চুরিয়ায় ছিল, এবং তারা ভেঙে পড়ছিল দ্রুত
-
আমেরিকা একদিকে, সোভিয়েত আরেকদিকে—দুই ফ্রন্টের যুদ্ধ জাপানের পক্ষে অসম্ভব
শান্তিপন্থীদের যুক্তি তখন আরও শক্তিশালী হলো:
“এই যুদ্ধ চালানো আর সম্ভব নয়।”
৭. ৯–১০ আগস্ট রাত: ঐতিহাসিক বৈঠক এবং ভয়ংকর অচলাবস্থা
আগস্ট ৯-এর রাতে Big Six বৈঠকে বসে।
টেবিলের দুই পাশে দুই বিপরীত অবস্থান:
যুদ্ধমন্ত্রী আনামি এবং সামরিক প্রধানদের দাবি—চার শর্ত
-
জাপান নিজেরাই সেনাবাহিনী নিরস্ত্র করবে
-
জাপান নিজেরাই যুদ্ধাপরাধ বিচার করবে
-
জাপানের ভূখণ্ডে কোনো বিদেশি বাহিনী ঢুকতে পারবে না
-
সম্রাটের পূর্ণ ক্ষমতা অক্ষুণ্ণ থাকবে
এই শর্তগুলো মিত্রশক্তির কাছে প্রায় অগ্রহণযোগ্য।
শান্তিপন্থীদের প্রস্তাব—একটি শর্ত
জাপান পটসডাম ঘোষণায় সম্মতি দেবে,
কিন্তু সম্রাটকে রেখে দিতে হবে।
ফল হলো ৩–৩ deadlock।
কেউ কাউকে মানতে প্রস্তুত নয়।
৮. গভীর রাত ২টা: সম্রাট হিরোহিতোর অভূতপূর্ব সিদ্ধান্ত
জাপানের ইতিহাসে সম্রাট সাধারণত রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে সরাসরি কথা বলেন না।
কিন্তু সেই রাতে তিনি সভায় ঢুকে বলেন:
“আমি জাপানের বর্তমান অবস্থা, মানুষের দুঃখ, এবং ভবিষ্যৎ বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নিয়েছি—আমরা পটসডাম ঘোষণার শর্ত মেনে নেব। আমাদের শুধুমাত্র একটি শর্ত—সম্রাট ব্যবস্থা অব্যাহত থাকবে।”
এই বক্তব্য ছিল সরাসরি imperial order।
এই আদেশ অমান্য করা treason—রাষ্ট্রদ্রোহ।
যুদ্ধপন্থীরা এতে স্তব্ধ হয়ে যায়।
আনামি মনে মনে কষ্ট পেলেও সম্রাটের বিরুদ্ধে যেতে পারলেন না।
৯. ১০ আগস্ট: জাপানের শর্তযুক্ত আত্মসমর্পণের বার্তা
জাপান মিত্রশক্তিকে জানায়:
“We accept the Potsdam Declaration, provided the prerogative of His Majesty as Sovereign is preserved.”
অর্থাৎ সম্রাট শুধু বেঁচে থাকবেন নয়—তাকে sovereign ruler হিসেবেও মানতে হবে।
এটি মিত্রশক্তির কাছে কঠিন দাবি।
১০. আমেরিকার অস্পষ্ট উত্তর—একটি কূটনৈতিক চাল
যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট সেক্রেটারি জেমস বার্নস জবাব পাঠালেন:
সম্রাট এবং জাপানের সরকার surrender করার মুহূর্ত থেকে Supreme Commander of Allied Powers-এর অধীন থাকবে।
এই ভাষা চতুরভাবে অস্পষ্ট।
জাপান বুঝল:
-
সম্রাটকে হত্যা করা হবে না
-
হয়তো তাকে প্রতীকী রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে রাখা হবে
হিরোহিতো এই উত্তরে স্বস্তি পেলেন।
তিনি মনে করলেন—আত্মসমর্পণ করলে সম্রাট ব্যবস্থা টিকে যাবে।
১১. ১৪ আগস্ট: অভ্যুত্থানের চেষ্টা—Kyūjō Incident
যুদ্ধপন্থী কিছু অফিসার বিশ্বাস করছিলেন সম্রাটকে ভুল তথ্য দেওয়া হয়েছে।
তারা আত্মসমর্পণ ঠেকাতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়।
১৪ আগস্ট রাত।
কয়েকজন উগ্র সৈন্য এবং অফিসার
-
ইম্পেরিয়াল প্যালেসে ঢুকে
-
সম্রাটের রেকর্ড করা surrender speech খুঁজে
-
জেনারেল মোরিকে হত্যা করে
-
সম্রাটকে effectively বন্দি করার চেষ্টা করে
তারা চেয়েছিল সকালবেলার radio broadcast বন্ধ করতে।
যদি মানুষ বার্তা না শোনে, যুদ্ধ চলবে।
কিন্তু তাদের আশা ভেঙে যায়:
-
Eastern Army তাদের সমর্থন করে না
-
আনামি সাহায্য করেন না
-
অভ্যুত্থান ভেঙে পড়ে
-
ষড়যন্ত্রকারীরা ritual suicide করে
১২. ১৫ আগস্ট: সম্রাটের কণ্ঠে অবশেষে শান্তি
১৫ আগস্ট দুপুর।
রেডিওতে টোকিওর মানুষ এক অচেনা কণ্ঠ শুনল—সম্রাটের কণ্ঠ।
তিনি বললেন:
“War situation has developed not necessarily to Japan’s advantage...”
ঐতিহাসিক, কাব্যিক ভাষায় তিনি ঘোষণা করলেন জাপান পটসডাম ঘোষণার শর্ত মেনে নিচ্ছে।
১৩. কেন ৬ আগস্টেই আত্মসমর্পণ হলো না?
অনেকেই মনে করেন atomic bomb–ই আত্মসমর্পণের কারণ।
কিন্তু ইতিহাস বলে—
কারণ ১: হিরোশিমার ক্ষয়ক্ষতি তাৎক্ষণিকভাবে নিশ্চিত ছিল না
জাপান প্রথমে বিশ্বাসই করেনি এটি atom bomb।
কারণ ২: সোভিয়েত আক্রমণ ছিল আরও ভয়ংকর ধাক্কা
জাপানের পুরো কূটনৈতিক কৌশল ভেঙে গেল।
কারণ ৩: ভিতরের রাজনৈতিক বিভক্তি
Big Six-এর deadlock ভাঙতে সময় লেগেছে।
১৪. ইতিহাসের শিক্ষা
এই পুরো নাটকীয় বাস্তবতা আমাদের তিনটি সত্য শেখায়:
-
জাপানের আত্মসমর্পণ ছিল এক জটিল, বহুস্তরীয় রাজনৈতিক সংগ্রাম, কোনো সরল সিদ্ধান্ত নয়।
-
সম্রাটের ভবিষ্যৎ নিয়ে অস্পষ্টতা ছিল পুরো আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু।
-
সোভিয়েত আক্রমণ এবং সম্রাটের ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত—এই দুটি ঘটনা ইতিহাস বদলে দেয়।
আর একটি সত্য—
যুদ্ধের শেষ দিনগুলোতেও জাপানের সামরিক নেতৃত্ব শান্তির পথকে বাধা দিতে চেষ্টা করেছিল।
কিন্তু সময়, বাস্তবতা এবং সম্রাটের সিদ্ধান্ত তাদের থামিয়েছে।
