![]() |
| ১৯৬২ সালের রেজাং লা যুদ্ধে ভারতীয় সেনাদের অদম্য প্রতিরোধ। |
রেজাং লা যুদ্ধ: ভারতীয় বীরত্ব ও আত্মত্যাগের এক অনন্য অধ্যায়
লাদাখের চুষুল উপত্যকা। চারদিকে বরফে ঢাকা পাহাড়, জনশূন্য নীরবতা, আর কাঁপিয়ে দেওয়া ঠাণ্ডা হাওয়া। ১৮ নভেম্বর ১৯৬২—সূর্য ওঠার আগের সেই অন্ধকার ভোরে, ১৬,০০০ ফিট উচ্চতার রেজাং লা পাসের নীরবতা যেন নিজেই যুদ্ধের গন্ধে ভারী হয়ে উঠেছিল।
সেই সকালেই ইতিহাস লিখেছিল ১৩ কুমাওন রেজিমেন্টের ১২০ জন ভারতের জওয়ান, আর তাদের অদম্য নেতা—মেজর শইতান সিং ভাটি।
আজকের রেজাং লা শুধু একটি যুদ্ধক্ষেত্র নয়—এ এক প্রতীক। সাহস, আত্মত্যাগ, আর Duty-এর প্রতি চূড়ান্ত নিষ্ঠার প্রতীক।
১. যুদ্ধের পটভূমি: এক অস্থির সীমান্ত, দুই দেশের সংঘাত
১৯৬২—ভারত ও চীনের সম্পর্ক তখন উত্তেজনার চূড়ায়। সীমান্তের লাইন অফ অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোল (LAC) নিয়ে বিরোধ তীব্র। বিশেষ করে অক্সাই চিন, যেখানে চীন গোপনে একটি Strategic Highway নির্মাণ করে ফেলেছিল—যা ভারতকে অস্বস্তিতে ফেলে দেয়।
কূটনৈতিক আলোচনা ব্যর্থ হলে, ২০ অক্টোবর ১৯৬২ চীন আকস্মিক আক্রমণ চালায় লাদাখ ও NEFA—আজকের অরুণাচল প্রদেশ—দুই দিক থেকেই।
এই বৃহৎ সংঘাতের মধ্যেই সামনে আসে চুষুল উপত্যকা—যেখানে ছোট্ট একটি airstrip ছিল ভারতের জন্য জীবনরেখা। এখান থেকেই লেহ শহরকে রক্ষা করা সম্ভব ছিল।
এ কারণেই চুষুল রক্ষা করা ছিল ভারতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আর চুষুলের সেই দরজা পাহারা দিচ্ছিল রেজাং লা।
২. রেজাং লা: যেখানে যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে উঠেছিল
রেজাং লা প্রায় ১৬,০০০ ফিট উচ্চতায়—মানব বসতির অনেক উপরে। সেখানে শ্বাস নেওয়া কষ্টকর, চলাফেরা কষ্টকর, অস্ত্র বহন করা আরও কষ্টকর।
এই দুর্গম এলাকায় দাঁড়িয়ে ছিল ১৩ কুমাওন রেজিমেন্টের চার্লি কোম্পানি, মোট ১২০ জন।
তাদের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন এক দৃঢ়চেতা, অনন্য ব্যক্তিত্ব—মেজর শইতান সিং।
তিনি জানতেন—চুষুল বাঁচাতে হলে রেজাং লা ধরে রাখতেই হবে।
তবে অবস্থানগত দুর্বলতা ছিল বড়। রেজাং লা ছিল Crested Position—মানে নিচের চীনা পজিশন স্পষ্ট দেখা যেত না, ফলে ভারতীয় Artillery তাদের সাহায্য করতে পারত না।
যুদ্ধের সময় তারা পাবেন শুধু rifles, light machine guns আর mortars—এটাই সব।
একটি Company দিয়ে কয়েক হাজার শত্রুর মোকাবিলা—এ যুদ্ধের শুরুতেই যেন ফলাফল লিখে দেওয়া ছিল।
কিন্তু ইতিহাস জানে—সংখ্যা নয়, ইচ্ছাশক্তিই অনেক সময় যুদ্ধের ফল নির্ধারণ করে।
৩. প্রতিরক্ষা প্রস্তুতি: তিনটি প্লাটুন, এক অদম্য নেতা
চার্লি কোম্পানির তিনটি প্লাটুন তখন রেজাং লায় মোতায়েন ছিল—
-
প্লাটুন ৭ — জেমাদার সুরজা রাম
-
প্লাটুন ৮ — জেমাদার হরি রাম
-
প্লাটুন ৯ — জেমাদার রামচন্দ্র
-
Headquarters ছিল প্লাটুন ৯–এর নিকটে।
চার দিক বরফে ঢাকা, হাড় কাঁপানো ঠাণ্ডা। কোনো Cover নেই, কোনো Heavy weapon নেই।
তবুও জওয়ানরা trenches খুঁড়ে, অস্ত্র গুছিয়ে, নিঃশব্দে অপেক্ষা করছিল—কারণ তারা জানত যুদ্ধ আসবে।
এটাই ছিল রেজাং লার আগের রাত।
৪. ভোরের অন্ধকার আর প্রথম শত্রুর ছায়া
১৮ নভেম্বর, ভোরের ঠিক আগে ০৪:০০ ঘন্টা।
নিচের উপত্যকা থেকে অস্বাভাবিক শব্দ আসতে শুরু করল—তারপর দেখা গেল কালো ঢেউয়ের মতো শত্রুর নড়াচড়া। চীনা সেনারা advancing করছে।
মেজর শইতান সিং দ্রুত পোস্ট থেকে পোস্টে ছুটে গিয়ে জওয়ানদের বললেন—
"Hold your fire… let them come close."
কারণ গোলাবারুদ ছিল সীমিত। তাদের গুলি নষ্ট করার কোনো সুযোগ নেই।
৫০ গজে শত্রু আসলে তবেই ফায়ার করার নির্দেশ দেওয়া হয়।
চার্লি কোম্পানির ১২০ জন জওয়ান সেই নির্দেশ মানল নিঃশব্দে, অনড়ভাবে।
৫. প্রথম আঘাত: প্লাটুন ৭–এর প্রতিরোধ
চীনা আক্রমণ শুরু হলো হঠাৎ—machine gun fire, mortars, আর চিৎকারে পাহাড় কেঁদে উঠল।
প্রথম ধাক্কা সামলালো প্লাটুন ৭। জেমাদার সুরজা রাম দ্রুত section তিনকে alternate position-এ পাঠালেন।
সেই নেতৃত্বে নাইক সাহি রাম তার LMG দিয়ে প্রথম আক্রমণকারীদের উপর devastating fire চালালেন।
শত্রুর প্রথম wave ভেঙে পড়ে।
কিন্তু শত্রুর সংখ্যা ছিল হাজারের উপরে। তারা নতুন wave পাঠাতে লাগল।
রেজাং লার নীরবতা তখন বদলে গেছে যুদ্ধক্ষেত্রে।
৬. দ্বিতীয় ও তৃতীয় আক্রমণ: গোলাবারুদ কমছে, কিন্তু মনোবল নয়
চীনা সেনারা পরপর wave আকারে পাহাড় বেয়ে উঠতে থাকে।
১৩ কুমাওনের জওয়ানরা rifles, grenades, LMG—যা আছে সব ব্যবহার করে প্রতিরোধ করে যায়।
কিন্তু সমস্যা হল—অস্ত্র বদলানো যাচ্ছে না, resupply নেই, Artillery নেই।
একপাশে কাঁপানো ঠাণ্ডা, অন্যপাশে হাজার শত্রু।
মেজর শইতান সিং আবারও forward posts-এ ছুটে গিয়ে বলেন—
"You are fighting for the motherland. Hold your ground."
তার কথা জওয়ানদের মনোবল আরও বাড়িয়ে দেয়।
চীনারা চমকে যায়—এক Company কিভাবে এতটা প্রতিরোধ দিচ্ছে?
৭. গোলাবারুদ শেষ: শুরু হলো হাতাহাতি যুদ্ধ
যখন চীনের চতুর্থ wave আসে, তখন ammunition প্রায় শেষ।
সেই সময় শুরু হলো hand-to-hand combat।
রifle butt, bayonet, grenade—জওয়ানরা যা পেয়েছে, তাই দিয়ে প্রতিহত করছে।
মৃতদেহের উপর পা দিয়ে উঠে আসছে শত্রু, আর তার উপর দাঁড়িয়ে লড়ছে ভারতীয় জওয়ানরা।
কিছু জওয়ান শেষ গুলি নিজের হাতেই রেখেছিলেন—শেষ পর্যন্ত লড়াই চালানোর জন্য।
এ ছিল বীরত্বের সীমার বাইরে, মৃত্যুকে বদলি করার গল্প।
৮. মেজর শইতান সিং–এর শেষ যুদ্ধ
মেজর শইতান সিং তখনও ঘুরে ঘুরে নির্দেশ দিচ্ছিলেন।
একটি চীনা bullet তার শরীরে লাগে, তারপর আরেকটি।
সহযোদ্ধারা তাকে পেছনে নিয়ে যেতে চাইলে তিনি বলেন—
"Leave me… go and continue your fight."
কিন্তু তার জওয়ানরা তাকে একা ফেলে যেতে চায়নি।
দু’জন জওয়ান তাকে একটি বড় পাথরের আড়ালে নিয়ে যায়, যেখানে তিনি চরম ঠাণ্ডায় ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে পড়েন।
তিনি মারা যাওয়ার আগ পর্যন্ত শুধু একটি কথাই বলেছিলেন—
"Keep fighting… don’t give up."
এটাই ছিল তার শেষ নির্দেশ।
৯. বিকেলের পর যুদ্ধ শেষ—রেজাং লা রক্তে লাল
যখন যুদ্ধ শেষ হয়, তখন রেজাং লা নিস্তব্ধ।
১২০ জনের মধ্যে ১১০+ জওয়ান শহীদ—শুধু কয়েকজনই জীবিত রয়ে গিয়েছিলেন, যারা গুরুতর আহত অবস্থায় শুয়ে ছিলেন।
মৃতদেহগুলো পরে ১৯৬৩ সালের বসন্তে উদ্ধার করা হয়।
অনেক জওয়ান অস্ত্র হাতে নিয়েই শহীদ হয়েছিলেন—শত্রুর দিকে মুখ করে।
যে সাহসের গল্প বইয়ে লেখা যায় না, মানুষের স্মৃতিতেই বেঁচে থাকে—রেজাং লা সেই স্মৃতি।
১০. শত্রুর ক্ষয়ক্ষতি: হাজারের উপর হতাহত
চীনা সেনাদের casualty ছিল ভয়াবহ—
-
ভারতীয় অনুমান অনুযায়ী ১,০০০–১,৫০০ চীনা সেনা মারা যায়
-
কিছু রিপোর্ট বলে ১,৩১০ চীনা হতাহত
এ ছিল এক Company-এর হাতে শত্রুর সবচেয়ে বড় ক্ষতির ঘটনা।
চীনারা চুষুল উপত্যকায় আর এগোতে পারেনি।
রেজাং লার এই বীরত্বই চীনের গতি থামিয়ে দেয়।
১১. তিন দিনের মধ্যে যুদ্ধবিরতি—রেজাং লার প্রভাব
চীন ২১ নভেম্বর ঘোষণা করে unilateral ceasefire।
১৮ নভেম্বরের রেজাং লা যুদ্ধ তাদের মনোবল ভেঙে দিয়েছিল।
হাজার হাজার জীবনের ক্ষয়ক্ষতি, কঠিন প্রতিরোধ—তারা বুঝেছিল চুষুল অতিক্রম করা অসম্ভব হবে।
যদিও ১৯৬২ সালের যুদ্ধের সামগ্রিক ফলাফল ভারতের পক্ষে ছিল না, রেজাং লা ছিল এক tactical victory—এক Company শত্রুকে থামিয়ে দিয়েছে, দেরি করিয়েছে, আর চুষুলকে বাঁচিয়েছে।
১২. মেজর শইতান সিং: পরম বীর চক্র প্রাপ্ত বীর
মেজর শইতান সিং পেয়েছিলেন পরম বীর চক্র—ভারতের সর্বোচ্চ gallantry award।
তার বীরত্ব শুধু সেদিনের যুদ্ধেই শেষ হয়নি; তিনি আজও ভারতের সামরিক ইতিহাসের এক কিংবদন্তি।
তিনি প্রমাণ করেছিলেন—
"Leadership is not about giving orders. It is about standing with your men till the last breath."
তার Company আজও তাকে “Saab” বলে স্মরণ করে।
১৩. রেজাং লা ওয়ার মেমোরিয়াল: স্মৃতির পাহাড়
চুষুল উপত্যকার উচ্চতায় আজ দাঁড়িয়ে আছে রেজাং লা ওয়ার মেমোরিয়াল—সাদা রঙের একটি স্মৃতিস্তম্ভ, শহীদদের নাম খোদাই করা।
সেখানে লেখা একটি লাইন আজও ভারতের বীরত্বের প্রতীক—
“How can a man die better
Than facing fearful odds…”
এই লাইন শুধু লেখা নয়—এ যুদ্ধের আত্মা।
১৪. আজকের রেজাং লা: ইতিহাস নয়, অনুপ্রেরণা
রেজাং লা আজ ভারতীয় সেনার training, strategy, এবং morale-এর অংশ।
যারা চুষুল বা প্যাংগংয়ের দিক দিয়ে যান, তারা জানেন—এই পাহাড় শুধু একটি স্থান নয়, এটি একটি emotion।
১৩ কুমাওনের ১২০ জন জওয়ান—“Shaitan Singh ke 120 Bahadur”—আজও ভারতীয় সেনার হৃদয়ে বেঁচে আছেন।
কারণ তারা দেখিয়েছিলেন—
বাঁচার জন্য নয়, Duty-র জন্য মানুষ কত দূর পর্যন্ত যেতে পারে।
রেজাং লা তাই সামরিক ইতিহাস নয়; এটি সাহসের, আত্মমর্যাদার, আর দেশের প্রতি ভালোবাসার জীবন্ত প্রতীক।
