![]() |
| বাংলাদেশের ইউরোফাইটার কেনা: আধুনিকীকরণ নাকি কৌশলগত ঝুঁকি? |
বাংলাদেশের ইউরোফাইটার কেনা: ‘বড় ভুল’ দাবি কতটা বাস্তব, কতটা প্রচার?
বাংলাদেশ ১৬টি ইউরোফাইটার টাইফুন যুদ্ধবিমান কিনে প্রায় ৩ বিলিয়ন ডলার খরচ করছে—এবং এই সিদ্ধান্ত নাকি একটি “বিশাল ভুল”, কারণ ভারতীয় ব্রহ্মোস মিসাইলের সামনে এই বিমানগুলো হবে “সিটিং ডাক”। সাম্প্রতিক সময়ে এই দাবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও কিছু ভারতীয়-বাংলাদেশি বিশ্লেষণ মহলে জোরালোভাবে ছড়িয়েছে।
কিন্তু বাস্তবতা কি সত্যিই এতটা সরল? নাকি এখানে সত্য, অর্ধসত্য ও কৌশলগত অতিরঞ্জন একসঙ্গে মিশে গেছে?
এই লেখায় আমরা আবেগ বা স্লোগানের বদলে তথ্য, সামরিক বাস্তবতা ও আঞ্চলিক শক্তির ভারসাম্যের আলোকে পুরো বিষয়টি বিশ্লেষণ করব।
বাংলাদেশের ইউরোফাইটার কেনা কোনো “গেম-চেঞ্জার” নয়, তবে এটিকে নিছক বড় ভুল বলাও অতিরঞ্জন। এই চুক্তি বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর পুরোনো MiG-29 ও F-7 বহর আধুনিক করার একটি প্রয়াস। ভারতের ব্রহ্মোস মিসাইল সব নন-স্টেলথ বিমানের জন্যই হুমকি—ইউরোফাইটার এর ব্যতিক্রম নয়, কিন্তু এটি বাংলাদেশের বর্তমান সক্ষমতার তুলনায় স্পষ্ট উন্নতি।
চুক্তিটি আসলে কী: বাস্তব তথ্য বনাম গুজব
প্রথমেই একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় পরিষ্কার করা জরুরি—বাংলাদেশ এখনো ইউরোফাইটার কেনার চূড়ান্ত চুক্তি করেনি।
কী হয়েছে এখন পর্যন্ত?
-
৯ ডিসেম্বর ২০২৫: বাংলাদেশ ইতালির প্রতিরক্ষা সংস্থা Leonardo-র সঙ্গে একটি Letter of Intent (LoI) স্বাক্ষর করেছে
-
LoI মানে চুক্তি নয়; এটি কেবল আনুষ্ঠানিক আলোচনা শুরু করার ঘোষণা
-
সম্ভাব্য প্যাকেজ: ১২–১৬টি Eurofighter Typhoon
-
সম্ভাব্য মোট খরচ: ৩–৪ বিলিয়ন ডলার
এই খরচের মধ্যে শুধু বিমান নয়, অন্তর্ভুক্ত রয়েছে—
-
পাইলট ও গ্রাউন্ড ক্রু প্রশিক্ষণ
-
স্পেয়ার পার্টস
-
সিমুলেটর
-
অস্ত্র ও সফটওয়্যার ইন্টিগ্রেশন
-
দীর্ঘমেয়াদি রক্ষণাবেক্ষণ সাপোর্ট
প্রতি বিমানের কাঁচা দাম আনুমানিক ১১৭–১৫০ মিলিয়ন ডলার, কিন্তু পূর্ণ প্যাকেজে বিমানমূল্য দাঁড়ায় প্রায় ১.৯–২.৪ বিলিয়ন ডলার।
বিকল্প অপশন খোলা রয়েছে
একই সঙ্গে বাংলাদেশ চীনের J-10C যুদ্ধবিমানও বিবেচনা করছে:
-
২০টি বিমান
-
আনুমানিক খরচ ২.২ বিলিয়ন ডলার
-
অর্থাৎ ইউরোফাইটারের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে সস্তা
এখানেই প্রথম বড় ভুল ধারণা ভেঙে যায়—বাংলাদেশ এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়নি।
| বিষয় | Eurofighter Typhoon | Chengdu J-10C |
|---|---|---|
| প্রজন্ম | 4.5 Generation | 4.5 Generation |
| সম্ভাব্য সংখ্যা | 12–16 টি | 20 টি |
| মোট খরচ | $3–4 বিলিয়ন | $2.2 বিলিয়ন |
| প্রতি বিমানের আনুমানিক দাম | $117–150 মিলিয়ন | $110 মিলিয়ন |
| রাডার | Captor-E AESA | AESA (চীনা) |
| মিসাইল | Meteor, AMRAAM | PL-15, PL-10 |
| সাপ্লাই চেইন | UK + Germany + Italy + Spain | শুধু চীন |
| অপারেটিং খরচ | খুব বেশি | তুলনামূলক কম |
| ভূরাজনৈতিক ঝুঁকি | ইউরোপীয় রাজনৈতিক চাপ | চীন নির্ভরতা |
| বাংলাদেশের জন্য বাস্তবতা | উন্নত কিন্তু ব্যয়বহুল | কম খরচে কার্যকর |
আর্থিক দিক: ৩ বিলিয়ন ডলার কি সত্যিই “বড় ভুল”?
বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা বাজেটের বাস্তবতা
-
FY 2025–26 প্রতিরক্ষা বাজেট: প্রায় ৪০,৬৯৮ কোটি টাকা (~৫ বিলিয়ন ডলার)
-
এর প্রায় ৬০% যায়:
-
বেতন
-
পেনশন
-
রক্ষণাবেক্ষণ
-
দৈনন্দিন অপারেশন
-
অর্থাৎ উন্নয়ন ও নতুন অস্ত্র কেনার জন্য হাতে থাকে সীমিত অর্থ।
কিন্তু এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় প্রায়ই উপেক্ষিত হয়—
বড় অস্ত্র কেনা এক বছরে হয় না
-
এই ধরনের বিমান চুক্তি সাধারণত ১০–১৫ বছরে ধাপে ধাপে অর্থ পরিশোধে হয়
-
বিদেশি ক্রেডিট লাইন, সফট লোন, বা ডিফার্ড পেমেন্ট ব্যবস্থাও থাকে
-
বাংলাদেশ আগেও এভাবে বিমান কিনেছে, যেমন:
-
Yak-130 ট্রেনার বিমান (রাশিয়ান ক্রেডিটে)
-
অতএব “একসঙ্গে ৩ বিলিয়ন ডলার ঢেলে দেওয়া”—এই বর্ণনাটি বাস্তবসম্মত নয়।
বাংলাদেশ কি আদৌ আধুনিক যুদ্ধবিমান দরকার?
এই প্রশ্নের উত্তর দিতে হলে বর্তমান বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর অবস্থা দেখতে হবে।
বর্তমান ফ্লিটের বাস্তবতা
-
প্রধানত:
-
MiG-29
-
F-7 (চীনা J-7-এর সংস্করণ)
-
-
অধিকাংশ বিমান:
-
২৫–৩০ বছরের পুরোনো
-
প্রযুক্তিগতভাবে ১৯৮০–৯০-এর দশকে আটকে
-
আধুনিক আকাশযুদ্ধে যেখানে—
-
AESA রাডার
-
নেটওয়ার্ক-সেন্ট্রিক ওয়ারফেয়ার
-
BVR (Beyond Visual Range) কমব্যাট
-
ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার
সেখানে এই বিমানগুলো কার্যত অপ্রচলিত।
Forces Goal 2030
বাংলাদেশ বহু আগেই ঘোষণা করেছে:
-
বিমানবাহিনী আধুনিকীকরণ
-
নৌ ও স্থলবাহিনীর সঙ্গে সমন্বিত যুদ্ধক্ষমতা
এই প্রেক্ষাপটে নতুন যুদ্ধবিমান কেনা ঐচ্ছিক নয়, বরং অনিবার্য।
ইউরোফাইটার: শক্তি ও সীমাবদ্ধতা
কেন ইউরোফাইটার?
Eurofighter Typhoon একটি ৪.৫ প্রজন্মের মাল্টিরোল ফাইটার, ব্যবহৃত হচ্ছে:
-
যুক্তরাজ্য
-
জার্মানি
-
ইতালি
-
স্পেন
-
সৌদি আরব
-
কাতার
এর প্রধান শক্তি:
-
Captor-E AESA রাডার
-
উন্নত Defensive Aids Sub-System (DASS)
-
Meteor এয়ার-টু-এয়ার মিসাইল
-
উচ্চ গতি ও চমৎকার ম্যানুভারেবিলিটি
বাংলাদেশের বর্তমান MiG-29-এর তুলনায় এটি এক বিশাল প্রযুক্তিগত লাফ।
কিন্তু সমস্যা কোথায়?
এখানেই “বড় ভুল” দাবি আংশিকভাবে যুক্তিসংগত হয়।
-
চার দেশের সাপ্লাই চেইন
-
ইউরোফাইটার মানে:
-
UK, Germany, Italy, Spain
-
-
যেকোনো কূটনৈতিক টানাপোড়েনে স্পেয়ার আটকে যেতে পারে
-
ভারত নিজেই ২০১২ সালে এই জটিলতার কারণে ইউরোফাইটার বাদ দেয়
-
-
উচ্চ অপারেটিং কস্ট
-
প্রতি ঘণ্টা ফ্লাইট খরচ MiG-29 বা J-10C থেকে অনেক বেশি
-
-
নন-স্টেলথ সীমাবদ্ধতা
-
আধুনিক SAM ও ক্রুজ মিসাইল যুগে বড় রাডার সিগনেচার সমস্যা
-
ব্রহ্মোস বনাম ইউরোফাইটার: বাস্তবতা বনাম আতঙ্ক
ব্রহ্মোস কী?
-
গতি: Mach 2.8–3.0
-
পাল্লা: ২৯০–৮০০+ কিমি
-
ওয়ারহেড: ২০০–৩০০ কেজি
-
উৎক্ষেপণ:
-
নৌজাহাজ
-
সাবমেরিন
-
স্থলভিত্তিক লঞ্চার
বিশ্বের অন্যতম ভয়ংকর সুপারসনিক ক্রুজ মিসাইল।
“সিটিং ডাক” দাবি কতটা সত্য?
আংশিক সত্য, পুরোটা নয়।
সত্যের অংশ:
-
নন-স্টেলথ বিমান:
-
দূর থেকে ধরা পড়ে
-
-
সুপারসনিক ক্রুজ মিসাইল:
-
প্রতিহত করা অত্যন্ত কঠিন
-
-
ব্রহ্মোসের লো-অল্টিটিউড প্রোফাইল বড় চ্যালেঞ্জ
অতিরঞ্জন:
-
ইউরোফাইটার পুরোপুরি অসহায় নয়
-
এতে রয়েছে:
-
ইলেকট্রনিক জ্যামিং
-
মিসাইল ওয়ার্নিং সিস্টেম
-
চ্যাফ/ফ্লেয়ার
-
-
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ:
-
বাংলাদেশের বর্তমান MiG-29 আরও বেশি অসহায়
-
অর্থাৎ প্রশ্নটি “ইউরোফাইটার নিরাপদ কি না” নয়, বরং—
ইউরোফাইটার কি বর্তমান অবস্থার চেয়ে ভালো?
এর উত্তর: হ্যাঁ।
আঞ্চলিক শক্তির ভারসাম্য: বাস্তব চিত্র
ভারতের অবস্থান
বাংলাদেশের অবস্থান
-
১৬টি নতুন বিমান এলেও:
-
আকাশে ভারতের আধিপত্য অপরিবর্তিত
-
-
কোনো S-400 সমমানের এয়ার ডিফেন্স নেই
-
সীমিত স্ট্র্যাটেজিক ডেপথ
এখানে একটি বিষয় স্পষ্ট—
বাংলাদেশের এই কেনাকাটা আক্রমণাত্মক নয়, আত্মরক্ষামূলক।
ভারতের দৃষ্টিতে এটি কৌশলগত হুমকি নয়, বরং “মাইনর নোট”।
J-10C: বাস্তবসম্মত বিকল্প?
চীনের J-10C কেন অনেক বিশ্লেষক বেশি যুক্তিযুক্ত মনে করছেন?
-
কম দাম
-
একক সাপ্লাই চেইন
-
পাকিস্তানে পরীক্ষিত
-
চীনা লজিস্টিক সিস্টেমে বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা
তবে এরও ঝুঁকি আছে—
-
অতিরিক্ত চীন নির্ভরতা
-
পশ্চিমা অস্ত্র ইকোসিস্টেম থেকে বিচ্ছিন্নতা
চূড়ান্ত মূল্যায়ন: বড় ভুল, নাকি প্রয়োজনীয় আধুনিকীকরণ?
যেখানে “বড় ভুল” যুক্তিসংগত
-
উচ্চ খরচ
-
অপারেশনাল জটিলতা
-
নন-স্টেলথ সীমাবদ্ধতা
-
ভারত নিজে এই বিমান নেয়নি
যেখানে “বড় ভুল” অতিরঞ্জন
-
আধুনিকীকরণের প্রয়োজন উপেক্ষা
-
MiG-29-এর দুর্বলতা উপেক্ষা
-
ব্রহ্মোস আতঙ্ককে একমাত্র মানদণ্ড বানানো
-
এখনো চুক্তি হয়নি—এই বাস্তবতা উপেক্ষা
উপসংহার
বাংলাদেশের বিমানবাহিনী আধুনিকীকরণ অপরিহার্য। ইউরোফাইটার সেই আধুনিকীকরণ এনে দিতে পারে, তবে উচ্চ মূল্য ও জটিলতা নিয়ে। J-10C অর্থনৈতিকভাবে যুক্তিসংগত বিকল্প।
যে বিমানই আসুক—
-
ভারতের সামরিক আধিপত্য বদলাবে না
-
ব্রহ্মোস হুমকি থেকেই যাবে
-
তবে বর্তমান অবস্থার চেয়ে বাংলাদেশ কিছুটা হলেও নিরাপদ হবে
এটি কোনো “গেম-চেঞ্জার” নয়, বরং একটি “সারভাইভাল আপগ্রেড”।
