জয়শঙ্করের ইসরায়েল সফর: সন্ত্রাসবাদ, কৌশল ও নতুন ভূরাজনীতি

ভারতের বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর ইসরায়েল সফরে প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গে বৈঠক করছেন, ভারত-ইসরায়েল কৌশলগত সম্পর্ক ২০২৫

কেন গুরুত্বপূর্ণ এস. জয়শঙ্করের ইসরায়েল সফর

ভারতের বিদেশমন্ত্রী এস. জয়শঙ্করের ১৫ ডিসেম্বর ২০২৫-এর ইসরায়েল সফর কোনও সাধারণ কূটনৈতিক সফর নয়। এই সফর ভারতের বর্তমান বৈদেশিক নীতির এক স্পষ্ট বার্তা বহন করে—ভারত এখন শুধু প্রতিক্রিয়া জানানো দেশ নয়, বরং বৈশ্বিক নিরাপত্তা ও কৌশলগত সিদ্ধান্তে সক্রিয় অংশগ্রহণকারী শক্তি।

এই সফরের সময়সূচি বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। ইসরায়েল যাওয়ার ঠিক আগে জয়শঙ্কর সংযুক্ত আরব আমিরশাহিতে (UAE) উচ্চপর্যায়ের বৈঠক করেছেন। তার একদিন আগেই অস্ট্রেলিয়ার সিডনির বন্ডি বিচে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলা ঘটে। এই ধারাবাহিক ঘটনাগুলো দেখায়, ভারত কীভাবে মধ্যপ্রাচ্য, ইন্দো-প্যাসিফিক ও পশ্চিমা গণতান্ত্রিক দেশগুলোর সঙ্গে একসঙ্গে নিরাপত্তা ও কৌশলগত সম্পর্ক গড়ে তুলছে।

ভারতের দৃষ্টিতে,

  • UAE হলো অর্থনীতি, জ্বালানি ও বাণিজ্যের কেন্দ্র

  • ইসরায়েল হলো প্রযুক্তি, প্রতিরক্ষা ও সন্ত্রাস-বিরোধী দক্ষতার অংশীদার

এই দুই স্তম্ভের উপর দাঁড়িয়ে ভারত একটি নতুন আঞ্চলিক নিরাপত্তা কাঠামো তৈরি করছে।

ইসরায়েলে সফরের সময় জয়শঙ্করের সাক্ষাৎ হওয়ার কথা রাষ্ট্রপতি আইজ্যাক হারজোগ, প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু এবং বিদেশমন্ত্রী গিডিয়ন সার-এর সঙ্গে। এই বৈঠকগুলোর মূল উদ্দেশ্য হলো—দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক আরও গভীর করা এবং মধ্যপ্রাচ্যের বর্তমান অস্থির পরিস্থিতিতে পারস্পরিক সহযোগিতা বাড়ানো।

Why is Jaishankar’s Israel visit important?

জয়শঙ্করের ইসরায়েল সফর ভারতের নতুন কৌশলগত নীতির প্রতীক। এই সফর দেখায় কীভাবে ভারত সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি, ইসরায়েলের সঙ্গে প্রতিরক্ষা ও প্রযুক্তিগত সহযোগিতা এবং অস্ট্রেলিয়া ও UAE-র মতো অংশীদারদের সঙ্গে সমন্বিত নিরাপত্তা কাঠামো গড়ে তুলছে।

এই সফরের আগেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও নেতানিয়াহুর মধ্যে ফোনে কথা হয়েছিল। দুই নেতা দ্রুত সাক্ষাৎ করার ব্যাপারেও সম্মত হন। এতে স্পষ্ট যে ভারত-ইসরায়েল সম্পর্ক এখন কেবল কাগজে-কলমে নয়, বাস্তব কৌশলগত অংশীদারিত্বে রূপ নিচ্ছে।


ভারত-ইসরায়েল সম্পর্কের প্রাতিষ্ঠানিক সম্প্রসারণ

২০২৫ সালের নভেম্বর মাসে ভারত ও ইসরায়েল একটি গুরুত্বপূর্ণ সমঝোতা স্মারক (MoU) স্বাক্ষর করে। এই চুক্তির মূল লক্ষ্য ছিল—

  • প্রতিরক্ষা সহযোগিতা

  • যৌথ অস্ত্র ও সরঞ্জাম উৎপাদন

  • সামরিক প্রশিক্ষণ

  • কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI)

  • সাইবার নিরাপত্তা

এই চুক্তির কেন্দ্রে ছিল “সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যৌথ লড়াই”

ইসরায়েলের প্রযুক্তিগত দক্ষতা এবং ভারতের বড় শিল্প ও উৎপাদন ক্ষমতা একসঙ্গে কাজ করলে তা দুই দেশের জন্যই শক্তিশালী সমন্বয় তৈরি করে। জয়শঙ্করের সফর মূলত এই নতুন চুক্তিকে বাস্তব রূপ দেওয়ারই একটি অংশ।


অস্ট্রেলিয়ার বন্ডি বিচ হামলা ও বদলে যাওয়া বৈশ্বিক বাস্তবতা

১৩-১৪ ডিসেম্বর ২০২৫-এ অস্ট্রেলিয়ার সিডনির বন্ডি বিচে এক ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলা ঘটে। হানুকা উৎসব উদযাপনের সময় ইহুদি সম্প্রদায়কে লক্ষ্য করে এই হামলায়—

  • ১৬ জন নিহত

  • ২৯ জন আহত

এই ঘটনা শুধু অস্ট্রেলিয়ার জন্য নয়, গোটা বিশ্বের জন্য একটি সতর্কবার্তা।

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দ্রুত এবং স্পষ্ট প্রতিক্রিয়া জানান। তিনি বলেন—

“সিডনির বন্ডি বিচে হানুকা উৎসব উদযাপনকারীদের উপর এই জঘন্য সন্ত্রাসী হামলার তীব্র নিন্দা জানাই। ভারত সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে শূন্য সহনশীলতা নীতিতে বিশ্বাস করে।”

এই বক্তব্য কেবল শোকবার্তা ছিল না। এর মধ্যে ছিল কৌশলগত বার্তা। ভারত স্পষ্ট করে জানিয়ে দেয় যে—

  • সন্ত্রাসবাদ কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যা নয়

  • এটি একটি বৈশ্বিক হুমকি

  • গণতান্ত্রিক দেশগুলিকে একসঙ্গে এর মোকাবিলা করতে হবে

এই হামলার লক্ষ্যবস্তু ছিল একটি ধর্মীয় সংখ্যালঘু গোষ্ঠী—যা ভারতের জন্য নতুন কিছু নয়। কাশ্মীরে দীর্ঘদিন ধরেই এমন সন্ত্রাস ভারতের অভিজ্ঞতা।


অপারেশন সিন্দুর: ভারতের ‘শূন্য সহনশীলতা’ নীতির বাস্তব রূপ

২০২৫ সালের এপ্রিল মাসে কাশ্মীরের পাহালগামে সন্ত্রাসী হামলায় ২৬ জন নিরীহ মানুষ নিহত হন। এই ঘটনার জবাবে ভারত চালায় অপারেশন সিন্দুর

এই অভিযান ছিল—

  • সীমিত সময়ের

  • নির্দিষ্ট লক্ষ্যভিত্তিক

  • শুধুমাত্র সন্ত্রাসী ঘাঁটি লক্ষ্য করে

মাত্র ২৫ মিনিটে ভারত ২৪টি নির্ভুল ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করে পাকিস্তান ও পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরে থাকা ৯টি সন্ত্রাসী ঘাঁটি ধ্বংস করে।

ভারত ইচ্ছাকৃতভাবে সাধারণ নাগরিক বা সামরিক ঘাঁটিতে আঘাত করেনি। এর ফলে আন্তর্জাতিক মহলে ভারতের অবস্থান শক্তিশালী হয়।

এই অভিযানের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই পাকিস্তান ডিরেক্টর জেনারেল মিলিটারি অপারেশনস (DGMO) হটলাইনের মাধ্যমে যুদ্ধবিরতির অনুরোধ জানায়। এতে বোঝা যায়, ভারতের বার্তা স্পষ্টভাবে পৌঁছে গেছে।


ভারত-ইসরায়েল কৌশলগত সহযোগিতার বিস্তার

একসময় ভারত-ইসরায়েল সম্পর্ক ছিল নীরব ও গোপন। এখন তা প্রকাশ্য, শক্তিশালী ও বহুস্তরীয়।

প্রতিরক্ষা সহযোগিতা

ইসরায়েল বর্তমানে ভারতের চতুর্থ বৃহত্তম অস্ত্র সরবরাহকারী দেশ

সহযোগিতার ক্ষেত্রগুলো হলো—

  • ড্রোন প্রযুক্তি

  • ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা

  • রাডার ব্যবস্থা

  • সাইবার নিরাপত্তা

  • AI-ভিত্তিক সামরিক প্রযুক্তি

ভারতের মিশন সুদর্শন চক্র-এ ইসরায়েলের প্রযুক্তি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এই প্রকল্পের লক্ষ্য হলো—

  • পাকিস্তানের ড্রোন হামলা প্রতিহত করা

  • বহুস্তরীয় আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা


অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক

২০২৫ সালের নভেম্বরেই ভারত ও ইসরায়েল একটি ফ্রি ট্রেড অ্যাগ্রিমেন্ট (FTA)-এর রূপরেখা চূড়ান্ত করে।

এই চুক্তির লক্ষ্য—

  • বাণিজ্য বাড়ানো

  • বিনিয়োগ সহজ করা

  • প্রযুক্তি স্থানান্তর

  • পরিষেবা খাত উদারীকরণ

এই FTA ধাপে ধাপে কার্যকর হবে, যাতে দ্রুত ব্যবসায়িক সুবিধা পাওয়া যায়।

ইসরায়েলি কোম্পানিগুলি ইতিমধ্যেই ভারতে বড় বিনিয়োগ করছে। উদাহরণস্বরূপ—

  • কর্ণাটকে ভারতের প্রথম সেমিকন্ডাক্টর কারখানা

  • ৩ বিলিয়ন ডলারের প্রকল্প

  • ইসরায়েল, UAE ও ভারতের যৌথ উদ্যোগ


কৃষি ও প্রযুক্তি সহযোগিতা

ভারতে বর্তমানে ৩০টি ইসরায়েলি সেন্টার অফ এক্সেলেন্স কাজ করছে।

এই কেন্দ্রগুলোর লক্ষ্য—

  • আধুনিক সেচ

  • ফলন বৃদ্ধি

  • কৃষকের আয় বাড়ানো

ড্রিপ ইরিগেশন, জল সংরক্ষণ ও আধুনিক চাষ পদ্ধতিতে ইসরায়েলের অভিজ্ঞতা ভারতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।


ভারত-মধ্যপ্রাচ্য-ইউরোপ করিডোর

এই করিডোর ভারত, UAE ও ইসরায়েলকে যুক্ত করে ইউরোপ পর্যন্ত বাণিজ্য পথ তৈরি করবে।

এই করিডোরে—

  • ভারতের উৎপাদন ক্ষমতা

  • UAE-র অর্থনীতি ও লজিস্টিকস

  • ইসরায়েলের প্রযুক্তি

একসঙ্গে কাজ করবে।

এটি শুধু বাণিজ্য নয়, ভূরাজনৈতিক শক্তির ভারসাম্যও বদলে দেবে।


পাকিস্তানের ‘মিডিয়া ওয়ার’ ও তথ্য যুদ্ধ

অপারেশন সিন্দুরের পর পাকিস্তান বুঝে যায়, সামরিকভাবে ভারতের সঙ্গে টেকা সম্ভব নয়। তাই তারা শুরু করে তথ্য যুদ্ধ

এই তথাকথিত ‘মিডিয়া ওয়ার’-এর মধ্যে ছিল—

  • ভুয়া ভিডিও

  • AI-তৈরি ছবি

  • সোশ্যাল মিডিয়া বট

  • মিথ্যা দাবি

পাকিস্তানি মিডিয়া দাবি করে—

  • ভারতের বিমান ভেঙে ফেলা হয়েছে

  • ভারতীয় পাইলট ধরা পড়েছে

  • ভারতের বিদ্যুৎ ব্যবস্থা ধ্বংস হয়েছে

পরবর্তীতে এগুলো সবই মিথ্যা প্রমাণিত হয়।


তথ্য যুদ্ধ: আধুনিক ভূরাজনীতির নতুন অস্ত্র

এই সংঘাত দেখিয়ে দিয়েছে, আধুনিক যুদ্ধে শুধু বন্দুক নয়—

  • তথ্য

  • ছবি

  • ভিডিও

  • অ্যালগরিদম

সবই অস্ত্র।

ভুয়া খবর বাস্তব যুদ্ধকে আরও বিপজ্জনক করে তোলে। দুটি পরমাণু শক্তিধর দেশের মধ্যে ভুল তথ্য বড় যুদ্ধের কারণ হতে পারে।


বৈশ্বিক মঞ্চে ভারতের উত্থান

লোই ইনস্টিটিউটের Asia Power Index 2025-এ ভারতকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

ভারতের শক্তির মূল স্তম্ভ—

  • কূটনীতি

  • প্রতিরক্ষা

  • ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক সম্ভাবনা

ভারত একই সঙ্গে—

  • Quad

  • BRICS

  • G20

  • SCO

সব জায়গায় সক্রিয়, কিন্তু কারও অধীন নয়।


উপসংহার

জয়শঙ্করের ইসরায়েল সফর আসলে ভারতের বৃহত্তর কৌশলের অংশ।

এই কৌশলের তিনটি স্তম্ভ—

  1. নিরাপত্তা ও সন্ত্রাস দমন

  2. অর্থনৈতিক বৃদ্ধি ও প্রযুক্তি

  3. বৈশ্বিক নেতৃত্ব ও বিশ্বাসযোগ্যতা

সিডনি হামলা দেখিয়ে দিয়েছে, সন্ত্রাসবাদ এখন বৈশ্বিক সমস্যা। আর ভারত এখন কেবল ভুক্তভোগী নয়—সমাধানের অংশ।

এই নতুন ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায় ভারত ধীরে ধীরে একটি দায়িত্বশীল, শক্তিশালী ও বিশ্বাসযোগ্য বিশ্বশক্তি হিসেবে উঠে আসছে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

যদি আপনার কোনও বিষয়ে ডাউট থাকে বা কোনও বিষয় suggest করতে চান তাহলে মেল করুন!

নবীনতর পূর্বতন

banglafacts 4