সেন রাজবংশ : বাংলার হিন্দু নবজাগরণ (প্রায় ১০৯৫–১২৬০ খ্রি.)
সেন রাজবংশের শাসনকাল মধ্যযুগীয় ভারতীয় ইতিহাসে এক বিশেষ সন্ধিক্ষণ—যে সময় বাংলায় গভীর সাংস্কৃতিক, সামাজিক এবং ধর্মীয় রূপান্তর ঘটেছিল। বৌদ্ধধর্ম-প্রভাবিত পাল সাম্রাজ্যের পতনের পর বাংলায় উদিত হয় এক শক্তিশালী হিন্দু সাম্রাজ্য, যা মুসলিম শাসনের আগমনের পূর্বে শেষ স্বাধীন হিন্দু শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়। তাদের শাসনকালে বাংলা শুধু রাজনৈতিকভাবে নয়, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় ক্ষেত্রেও ব্যাপক পুনর্জাগরণ দেখেছিল।
সেন রাজবংশ — দ্রুত উত্তর (Featured Snippet)
সংক্ষিপ্ত উত্তর: সেন রাজবংশ (প্রায় ১০৯৫–১২৬০ খ্রি.) ছিল বাংলার শেষ স্বাধীন হিন্দু রাজবংশ — পালদের পতন, ব্রাহ্মণ্য পুনর্জাগরণ, কুলিন ব্যবস্থার প্রবর্তন এবং লক্ষ্মণ ও বল্লাল সেনদের সময়সূচ্য করে সাংস্কৃতিক স্বর্ণযুগের জন্য পরিচিত; ১২০৩ খ্রিস্টাব্দে বখতিয়ার খলজির আক্রমণে তারা পতিত হন।
- প্রতিষ্ঠা: ≈ ১০৯৫ খ্রি. (হেমন্ত/বিজয় সেন)
- প্রধান শাসক: বল্লাল সেন, লক্ষ্মণ সেন
- সামাজিক বদল: কুলিন প্রথার সংহতকরণ
- সাহিত্য: লক্ষ্মণ সেনের দরবারে জয়দেব (গীতগোবিন্দ) সহ পঞ্চরত্ন
- পরাজয়: ১২০৩ খ্রি. — বখতিয়ার খলজি
দ্রুত জানতে: পোস্টের সব বিশদ ও ইতিহাস পড়তে পুরো নিবন্ধটি পড়ুন »
পালদের পতন ও সেন শাসনের উত্থান
সেন রাজবংশের আবির্ভাব আকস্মিক ছিল না। এটি ছিল পাল সাম্রাজ্যের দীর্ঘদিনের দুর্বলতা, অন্তর্দ্বন্দ্ব ও ফিউডাল ভাঙনের স্বাভাবিক পরিণতি।
সামন্ত সেন: ভিত্তি নির্মাতা
প্রথমদিকে সামন্ত সেন (রঃ ১০৭০–১০৯৫) ছিলেন দুর্বল পাল শাসকদের অধীনস্থ এক সামন্তপ্রভু। পাল সাম্রাজ্যের প্রভাব ক্রমশ ক্ষয়প্রাপ্ত হওয়ায় তিনি অঞ্চলে নিজের প্রভাব বাড়াতে শুরু করেন এবং ভবিষ্যৎ সেন শক্তির ভিত্তি স্থাপন করেন।
হেমন্ত সেন: স্বাধীনতার ঘোষণা
হেমন্ত সেন (রঃ ১০৯৫–১০৯৬) তাঁর পিতার বিস্তৃত অঞ্চলের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে পালদের ক্ষমতা থেকে মুক্তি ঘোষণা করেন। প্রায় ১০৯৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি নিজেকে স্বাধীন রাজা ঘোষণা করেন। এই ঘটনা বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি বড় মোড় আনল–যেখানে পালদের বহু শতাব্দীর ঐতিহ্যবাহী আধিপত্য ভেঙে গিয়ে জন্ম নিল সেনদের স্বাধীন সাম্রাজ্য।
বিজয় সেন: প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা ও সম্রাট
সেন রাজবংশের প্রকৃত উত্থান ঘটে বিজয় সেনের (রঃ ১০৯৬–১১৫৯) দীর্ঘ ৬০ বছরের শাসনে। তিনি দুর্বল পাল শাসক মদনপালকে ১১৫২–৫৩ খ্রিস্টাব্দে পরাজিত করেন এবং বাংলার রাজনৈতিক মানচিত্র থেকে পালদের নাম একেবারেই মুছে দেন।
তিনি বিজয়পুর নগর প্রতিষ্ঠা করেন এবং নবদ্বীপকে রাজধানী করেন। তাঁর শাসনেই বাংলার বহু অঞ্চল, বিহারসহ, একীভূত হয়ে সেন সাম্রাজ্যে যুক্ত হয়।
সেন সাম্রাজ্যের শিখর: বল্লাল সেন ও লক্ষ্মণ সেন
বল্লাল সেন (রঃ ১১৫৯–১১৭৯): শক্তি, কূটনীতি ও সামাজিক সংস্কার
বল্লাল সেন ছিলেন সেন রাজ্যের সর্বোচ্চ ক্ষমতার সময়ের সম্রাট। তিনি গৌড় দখল করে সমগ্র বঙ্গ ডেল্টার শাসক হন। তাঁর দক্ষিণ ভারতের চালুক্য সাম্রাজ্যের রাজকুমারী রমাদেবীর সঙ্গে বিবাহ ছিল রাজনৈতিক কূটনীতির এক অনন্য উদাহরণ।
এই বিবাহ সেন সাম্রাজ্যের মর্যাদা ও প্রভাব বহির্বিশ্বে প্রতিষ্ঠা করে।
লক্ষ্মণ সেন (রঃ ১১৭৯–১২০৬): সর্ববৃহৎ সেন সাম্রাজ্য এবং সাংস্কৃতিক শিখর
লক্ষ্মণ সেনের শাসনে সেন সাম্রাজ্য সর্বোচ্চ বিস্তৃতি পায়। তাঁর রাজত্ব অন্তর্ভুক্ত করেছিল—
- গৌড়
- কামরূপ
- কলিঙ্গ
- মগধ
-কাশী
তিনি ছিলেন গভীরভাবে বৈষ্ণব ধর্মানুরাগী এবং ‘পরমবৈষ্ণব’, ‘পরমনারসিংহ’ প্রভৃতি উপাধিতে ভূষিত হন। তাঁর দরবার ছিল মধ্যযুগীয় ভারতের এক উজ্জ্বলতম সাহিত্য-কেন্দ্র।
হিন্দু ধর্মীয় পুনর্জাগরণ ও ব্রাহ্মণ্যবাদ পুনঃপ্রতিষ্ঠা
সেনদের রাজত্বে বাংলায় দীর্ঘদিনের বৌদ্ধ আধিপত্যের অবসান ঘটিয়ে হিন্দুধর্ম ও ব্রাহ্মণ্য ভাবধারার ব্যাপক পুনর্জাগরণ ঘটে।
মন্দির-নির্মাণ ও ধর্মীয় কার্যক্রম
সেন শাসকরা শিব, বিষ্ণু ও শক্তি–এই তিন প্রধান হিন্দু দেউলগুলির প্রতি বিশেষ ভক্তি প্রদর্শন করেন।
- ঢাকার ঢাকেশ্বরী মন্দির সেনদের অন্যতম স্মরণীয় দান, যা আজও ঢাকার ধর্মীয়–ঐতিহাসিক পরিচয়ের কেন্দ্রবিন্দু।
- বিভিন্ন স্থানে শৈব, বৈষ্ণব ও শক্ত উপাসনার জন্য বহু মন্দির নির্মাণ করা হয়।
মন্দিরগুলি শুধু উপাসনারই কেন্দ্র ছিল না—সেগুলি হয়ে ওঠে সাংস্কৃতিক শিক্ষার কেন্দ্রস্থল।
বেদীয় অনুষ্ঠান ও ব্রাহ্মণ্য শাস্ত্রের পুনর্জাগরণ
সেনরা বেদ, উপনিষদ, পুরাণ প্রভৃতির চর্চা বাড়ান। বহু শতাব্দী পর বাংলায় ব্রাহ্মণ্যবাদের পুনঃপ্রতিষ্ঠা ঘটে।
এ সময়েই জাতিভেদ ও সামাজিক কাঠামো নতুনভাবে সুসংহত হয়।
কুলিন ব্যবস্থা: বল্লাল সেনের সামাজিক পুনর্গঠন
বল্লাল সেনের এক গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল কুলিন প্রথা।
মূল বৈশিষ্ট্য
- ব্রাহ্মণ, কৈবর্ত, বৈদ্য প্রভৃতি জাতিকে বংশগত মর্যাদার ভিত্তিতে শ্রেণিবদ্ধ করা হয়।
- কুল ও বংশের বিশুদ্ধতার ওপর টিকেছিল সামাজিক মর্যাদা।
- বিবাহ সম্পন্ন হত মূলত উচ্চকুলের পরিবারগুলির সঙ্গে।
প্রভাব
কুলিনতন্ত্র একদিকে সেনদের রাজনীতি ও সমাজকে সুসংহত করেছিল, অন্যদিকে উঁচু–নিচু জাত-বিভাজনকে অনেক বেশি কঠোর করে তুলেছিল।
ব্রিটিশ আমল পর্যন্ত এই কুলিন প্রথা বাংলার সমাজে গভীর প্রভাব বিস্তার করে থাকে।
সাহিত্য, সংস্কৃতি ও সংস্কৃত শিক্ষার স্বর্ণযুগ
সেন দরবার বিশেষত লক্ষ্মণ সেনের শাসনে মধ্যযুগীয় ভারতের সর্বোত্তম সাহিত্য কেন্দ্রগুলির একটি হয়ে ওঠে।
পঞ্চরত্ন: পাঁচ রত্নের সভা
লক্ষ্মণ সেনের রাজসভায় পাঁচজন বিশিষ্ট কবি ও পণ্ডিত ছিলেন, যারা ‘পঞ্চরত্ন’ নামে পরিচিত—
- জয়দেব: গীতগোবিন্দ রচয়িতা। ভক্তি ও রসের অতুলনীয় মিশ্রণে রচিত এই গ্রন্থ ভারতীয় সাহিত্যের এক অমর রত্ন।
- ধোয়ী: পবনদূত কাব্যের রচয়িতা।
- অন্যান্য পণ্ডিতরা সংস্কৃত সাহিত্যকে নতুনমাত্রা দেন।
লক্ষ্মণ সেন স্বয়ং অদ্ভুতসাগর গ্রন্থ রচনার কাজ সমাপ্ত করেছিলেন, যা তাঁর পিতার অসমাপ্ত রচনা ছিল।
স্থাপত্যকলায় সেনদের অবদান
সেন স্থাপত্যে দেখা যায়—
- উত্তর ভারতীয় শৈলীর প্রভাব
- বাংলার নিজস্ব পোড়ামাটির অলংকরণ
- সূক্ষ্ম কারুকাজ ও ভাস্কর্যের সমন্বয়
নদীয়া, বিক্রমপুর, গৌড়সহ বহু অঞ্চলে তাদের নির্মিত মন্দির, প্রতিমা ও স্থাপত্যকীর্তি শতাব্দীর পর শতাব্দী বাংলার শিল্প-সংস্কৃতিকে প্রভাবিত করেছে।
তুর্কি আক্রমণ ও সেন সাম্রাজ্যের পতন
১৩শ শতকের শুরুতে তুর্কি সামরিক শক্তি পুনঃসংগঠিত হয়ে পূর্ব ভারতে অভিযান শুরু করে।
বখতিয়ার খলজির আকস্মিক আক্রমণ
১২০৩ খ্রিস্টাব্দে মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খলজি মাত্র ১৮ জন অশ্বারোহী নিয়ে নবদ্বীপে হঠাৎ আক্রমণ চালান।
তাবকাত-ই-নাসিরি অনুসারে আক্রমণ এত দ্রুত ছিল যে—
- বয়োবৃদ্ধ লক্ষ্মণ সেন তখন ভোজসভায় ছিলেন
- আক্রমণকারীরা ঘোড়া ব্যবসায়ীর ছদ্মবেশে শহরে প্রবেশ করেন
- রাজা পিছনের দরজা দিয়ে পালাতে বাধ্য হন
পরবর্তী পরিণতি
- বখতিয়ার গৌড় দখল করেন
- সেনরা পূর্ববঙ্গে (বিক্রমপুর) সরে যান
- লক্ষ্য: বিশ্বরূপ সেন ও কেশব সেন কেবল ছোটখাটো ভূখণ্ড শাসন করেন
- ১২৬০ খ্রিস্টাব্দের দিকে সেনদের রাজনৈতিক অস্তিত্ব পুরোপুরি লোপ পায়
এই ঘটনা বাংলায় মুসলিম শাসনের সূচনা এবং হিন্দু স্বাধীন সাম্রাজ্য যুগের সমাপ্তি নির্দেশ করে।
সেন সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকার: ইতিহাসে তাদের গুরুত্ব
যদিও সেন শাসনকাল মাত্র দেড় শতকের মতো স্থায়ী ছিল, তবু তাদের প্রভাব অনন্তকালের।
ধর্ম ও সমাজে সেনদের অবদান
- ব্রাহ্মণ্যবাদ পুনরুজ্জীবিত করে বাংলা সমাজকে নতুন কাঠামো দেন
- কুলিন-ব্যবস্থা কয়েক শতাব্দী ধরে বাঙালি সমাজকে নিয়ন্ত্রণ করে
- মন্দির, ধর্মীয় রীতি, পুরাণ চর্চা—সবই নতুন মাত্রা পায়
সাহিত্য ও সংস্কৃতিক্ষেত্রে স্বর্ণযুগ
সেন দরবারে রচিত সাহিত্য মধ্যযুগীয় ভারতের শ্রেষ্ঠতম সংস্কৃত ঐতিহ্যের অন্যতম অংশ। জয়দেবের গীতগোবিন্দ বিশ্বসাহিত্যের অন্যতম রত্ন।
স্থাপত্য ও শিল্পকলা
বাংলার পোড়ামাটির শিল্প, অলংকরণ, ভাস্কর্য—এই ধারা পরবর্তী শতাব্দীগুলোর স্থাপত্যকেও গভীরভাবে প্রভাবিত করে।
ইতিহাসের দৃষ্টিতে সেনদের পতন
সেনদের দ্রুত পতন ভারতীয় উপমহাদেশের সাধারণ বাস্তবতাকে তুলে ধরে—
- সাংস্কৃতিকভাবে সমৃদ্ধ হলেও
- সামরিকভাবে তৎকালীন তুর্কি বাহিনীর দ্রুতগতির অশ্বারোহী কৌশল ও সংগঠনের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারেনি
এটি পরবর্তী বহু হিন্দু রাজ্যের ক্ষেত্রেও পুনরাবৃত্তি হতে দেখা যায়।
তুলনা: সেন রাজবংশ বনাম পাল সাম্রাজ্য
নীচের টেবিল ও সংক্ষিপ্ত পয়েন্টগুলো ব্লগে বর্ণিত তথ্য অনুসারে দুই বাহিনী-কালীন মূল পার্থক্য ও সাদৃশ্য সংক্ষেপে উপস্থাপন করে।
| বিশেষতা | সেন রাজবংশ (≈ ১০৯৫–১২৬০) | পাল সাম্রাজ্য (≈ ৭৫০–১১৭৪) |
|---|---|---|
| রাজনৈতিক সময়কাল ও কেন্দ্র | লায়নের মতো ~১৬০ বছর; কেন্দ্র: নবদ্বীপ/নদীয়া (পরে গৌড় ও বিক্রমপুরে শরণ) | প্রায় ৪০০ বছর বা তারও বেশি; কেন্দ্র: বংশাল/পাটলিপুত্র-প্রায়কালে বিস্তৃত বিহার-বাংলা অঞ্চলে |
| ধর্মীয় প্রভাব | ব্রাহ্মণ্য পুনর্জাগরণ; বৈষ্ণব ও শৈব উপাসনা; কুলিন প্রথা প্রতিষ্ঠা | বৌদ্ধ ধর্মের উত্থান ও সমৃদ্ধি; মহায়ান বৌদ্ধ সাঙ্গঠনিক ও শিক্ষাগত কেন্দ্র হিসেবে খ্যাত |
| সামাজিক নীতি ও সংস্কার | কুলিনতন্ত্র—বংশগত সামাজিক শ্রেণিবিন্যাস শক্ত করা; ব্রাহ্মণ ও কায়স্থ প্রভৃতির মর্যাদা বাড়ে | বৌদ্ধিক ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান সমাজে প্রভাবশালী; ভিক্ষুসংঘ ও বিখ্যাত বৌদ্ধ বিহার (নালন্দা/বোধগয়া-প্রসিদ্ধ সময়ের প্রারম্ভিক) |
| সাহিত্য ও শিক্ষাব্যবস্থা | সেন্সরে সংস্কৃত সাহিত্য–লক্ষ্মণ সেনের দরবারে পঞ্চরত্ন; গীতগোবিন্দের প্রভাব | বৌদ্ধ পাঠশালা, পালি ও সংস্কৃত বিদ্যা; বিশ্ববিখ্যাত ব্যাক্তিত্ব ও ধর্মীয় গ্রন্থের সংরক্ষণ |
| স্থাপত্য ও শিল্পকলার বৈশিষ্ট্য | টেরাকোটা শিল্প, মন্দিরভিত্তিক শৈলী—ঢাকেশ্বরী ও নক্সিকন্ঠীয় মন্দিরাধর্মী কাজ | বৌদ্ধ স্থাপত্য—বৌদ্ধ স্তূপ, বিহার ও মঠ; বড় বড় মন্দির ও শিক্ষা কেন্দ্র |
| প্রধান বাইরে আক্রমণ ও পতন | ১২০৩ খ্রিস্টাব্দে বখতিয়ার খলজির আক্রমণ; দ্রুত রাজনৈতিক নির্জন হয়ে যায় | বহু বাহিনীর চাপ ও আভ্যন্তরীণ দুর্বলতা—শেকড়ে অবক্ষয় এবং পরে স্থানীয় শক্তিগুলোর উত্থান |
| ঐতিহাসিক ভূমিকা (সংক্ষেপ) | বাংলার শেষ স্বাধীন হিন্দু সাম্রাজ্য; ধর্মীয় ও সামাজিক পুনর্গঠনে বৃহৎ প্রভাব | বৌদ্ধ শিক্ষার প্রসারে যুগান্তকারী; পূর্ব-মধ্যযুগীয় উপমহাদেশে বৃহৎ সাংস্কৃতিক প্রভাব |
- পাল রাজবংশ ছিল বৌদ্ধ-সংস্কৃতির প্রবল পক্ষে; সেনরা সেই শূন্যস্থান পূরণ করে ব্রাহ্মণ্য ও হিন্দু সংস্কৃতি পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে।
- পালরা দীর্ঘস্থায়ী শিক্ষা ও বৌদ্ধ প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিল; সেনরা সাহিত্য ও মন্দিরশিল্পে নতুন জীবন প্রবাহিত করেছেন।
সংক্ষেপে সেন রাজবংশের গুরুত্ব
- বাংলার শেষ বৃহৎ স্বাধীন হিন্দু সাম্রাজ্য
- ব্রাহ্মণ্যবাদ, বেদীয় রীতি, মন্দির সংস্কৃতির পুনর্জাগরণ
- কুলিন ব্যবস্থা—বাংলার সমাজে যুগান্তকারী পরিবর্তন
- সংস্কৃত সাহিত্য ও শিল্পকলার স্বর্ণযুগ
- মুসলিম শাসনের সূচনার পূর্ববর্তী ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণ
সেন রাজবংশ তাই একইসঙ্গে বাংলার হিন্দু সাংস্কৃতিক মহিমার চূড়ান্ত বিকাশ ও স্বাধীন হিন্দু শাসনের শেষ অধ্যায়।
Important Links banglapedia.org
People Also Ask (FAQ)
সেন রাজবংশ বাংলায় ব্রাহ্মণ্যধর্মের পুনর্জাগরণ, কুলিন প্রথার প্রবর্তন, গীতগোবিন্দসহ সংস্কৃত সাহিত্যের স্বর্ণযুগ এবং শক্তিশালী প্রশাসনিক শাসনের জন্য বিখ্যাত।
বল্লাল সেন কুলিন প্রথা চালু করে ব্রাহ্মণ, বৈদ্য ও কায়স্থ সম্প্রদায়কে বংশগত বিশুদ্ধতার ভিত্তিতে শ্রেণিবিন্যাস করেছিলেন, যা বাংলার সমাজে দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ফেলেছিল।
লক্ষ্মণ সেনের দরবারে জয়দেব, ধোয়ীসহ বিখ্যাত পাঁচ কবির ‘পঞ্চরত্ন’ সভা ছিল, যা মধ্যযুগীয় ভারতের অন্যতম বৃহৎ সাহিত্যকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত।
১২০৩ খ্রিস্টাব্দে বখতিয়ার খলজির আকস্মিক নবদ্বীপ আক্রমণে সেন সাম্রাজ্য দুর্বল হয়ে পড়ে এবং কয়েক দশকের মধ্যেই সম্পূর্ণ পতন ঘটে।
ধর্মীয় পুনর্জাগরণ, প্রশাসনিক স্থিতি, কুলিনতন্ত্র, মন্দির স্থাপত্য ও কবিতাশিল্পের বিকাশ—এই পাঁচটি ক্ষেত্রে সেনদের অবদান সবচেয়ে স্মরণীয়।
📘 গুরুত্বপূর্ণ পরিভাষা (Glossary)
সেন রাজবংশ সম্পর্কিত ইতিহাস বোঝার জন্য কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পদ ও ধারণার সহজ ব্যাখ্যা নিচে দেওয়া হলো।
বল্লাল সেন প্রবর্তিত একটি সামাজিক শ্রেণিবিন্যাস ব্যবস্থা, যেখানে ব্রাহ্মণ, বৈদ্য ও কায়স্থ সম্প্রদায়কে বংশগত বিশুদ্ধতার ভিত্তিতে উচ্চ–নীচ শ্রেণিতে ভাগ করা হয়।
লক্ষ্মণ সেনের দরবারে থাকা পাঁচজন বিখ্যাত কবি—জয়দেব, ধোয়ীসহ অন্যান্য পণ্ডিতদের বোঝানো হয়, যারা মধ্যযুগীয় বাংলার সাংস্কৃতিক স্বর্ণযুগ সৃষ্টি করেন।
কবি জয়দেবের রচিত বৈষ্ণব ভক্তিমূলক ও রসাত্মক মহাকাব্য, যা ভারতীয় সাহিত্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ কীর্তি হিসেবে গণ্য হয়।
সেন রাজাদের রাজধানী, সাহিত্য, শিক্ষা ও ধর্মীয় চর্চার গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। এখানেই বখতিয়ার খলজির আকস্মিক আক্রমণ ঘটে।
বাংলার ঐতিহাসিক নগরী এবং পাল ও সেন—উভয় যুগেই গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক কেন্দ্র। পরে এখানেই তুর্কি শাসন শুরু হয়।
ঢাকার প্রাচীন মন্দির, যা সেন যুগে নির্মিত বলে ধারণা করা হয়। বাংলার হিন্দু স্থাপত্য ও ধর্মীয় ইতিহাসে এর বিশেষ ভূমিকা রয়েছে।
তুর্কি সেনাপতি যিনি ১২০৩ খ্রিস্টাব্দে মাত্র ১৮ জন অশ্বারোহী নিয়ে নবদ্বীপ আক্রমণ করেন এবং সেন সাম্রাজ্যের পতনের সূচনা করেন।
সেনদের পূর্ববর্তী বৌদ্ধ-প্রধান সাম্রাজ্য, যা প্রায় চার শতাব্দী পূর্ব ভারত শাসন করে। এর পতনের পর সেনদের উত্থান ঘটে।
