প্রাচীন বঙ্গের ইতিহাসে গঙ্গারিডাই (Gangaridai) এমন এক শক্তিশালী কিন্তু রহস্যময় সভ্যতা, যার খ্যাতি সমগ্র প্রাচীন বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছিল মূলত গ্রিক ও রোমান ঐতিহাসিকদের বিবরণে। খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতক থেকে খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতক পর্যন্ত ভূমধ্যসাগরীয় বিশ্বের লেখাগুলোতে গঙ্গারিডাইকে বর্ণনা করা হয়েছে এক সুগঠিত সামরিক সাম্রাজ্য হিসেবে, যার শক্তি এতটাই প্রবল ছিল যে তা আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের পূর্বমুখী অগ্রযাত্রা থামিয়ে দিয়েছিল। বঙ্গোপসাগর-কেন্দ্রিক সামুদ্রিক বাণিজ্য, বিশাল যুদ্ধহস্তীর বাহিনী, উন্নত নগরায়ণ ও পরিশীলিত শিল্পচর্চা—সব মিলিয়ে গঙ্গারিডাই প্রাচীন যুগে ভারত উপমহাদেশের অন্যতম প্রভাবশালী শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
ভৌগোলিক বিস্তৃতি ও অবস্থান
গঙ্গারিডাই রাজ্য গড়ে উঠেছিল গঙ্গা ডেল্টার উর্বর অঞ্চলে—বর্তমান ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের বিশাল অংশ জুড়ে। গ্রিক ভূগোলবিদ টলেমি (Ptolemy) দ্বিতীয় শতকে উল্লেখ করেন যে গঙ্গারিডাই “গঙ্গার পাঁচটি মোহনার চারপাশের সমস্ত অঞ্চল” দখল করে রেখেছিল এবং এর রাজধানী ছিল নদীপথকেন্দ্রিক নগরী “গঙ্গে”।
এই ডেল্টা অঞ্চলটি প্রাচীনকালে কৌশলগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। পশ্চিমে ভাগীরথী-হুগলি নদী এবং পূর্বে পদ্মা নদীর মধ্যবর্তী এলাকা গঙ্গারিডাইয়ের মূল কেন্দ্র। বঙ্গোপসাগরের উপকূলে বিস্তৃত এই রাজ্য বাণিজ্যপথ নিয়ন্ত্রণ ও সামুদ্রিক নৌযুদ্ধ—উভয় ক্ষেত্রেই বিশাল সুবিধা লাভ করেছিল।
আধুনিক প্রত্নতাত্ত্বিকদের মতে, গঙ্গারিডাই সভ্যতার কেন্দ্র দুটি গুরুত্বপূর্ণ নগরীকে ঘিরে গড়ে উঠেছিল—
১. চন্দ্রকেতুগড় (পশ্চিমবঙ্গ, উত্তর ২৪ পরগনা)
২. ওয়াড়ি-বটেশ্বর (বাংলাদেশ, নরসিংদী)
এই দু’টি নগর থেকে প্রাপ্ত নিদর্শন গঙ্গারিডাই রাজ্যের উন্নত নগর পরিকল্পনা, বন্দর-নগরী, দুর্গপ্রাচীর ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যপথের সমৃদ্ধ ইতিহাস তুলে ধরে।
আলেকজান্ডারের ফিরে যাওয়া: গঙ্গারিডাইয়ের সামরিক শক্তির প্রমাণ
গঙ্গারিডাই সম্পর্কে সবচেয়ে বিখ্যাত ঐতিহাসিক তথ্য পাওয়া যায় আলেকজান্ডারের ভারত অভিযান থেকে। ৩২৬ খ্রিস্টপূর্বে পাঞ্জাবের বিয়াস নদী পর্যন্ত পৌঁছানোর পর তার সৈন্যরা আর পূর্বদিকে অগ্রসর হতে রাজি হয়নি। গ্রিক ইতিহাসবিদ ডিওডোরাস সিকুলাস লিখেছিলেন যে গঙ্গারিডাইয়ের সেনাবাহিনীতে ছিল—
- ৪,০০০ যুদ্ধহস্তী
যা সে সময় পৃথিবীর সবচেয়ে বড় যুদ্ধহস্তীর বাহিনী।
প্লুটার্ক আরও বিস্ময়কর সংখ্যা উল্লেখ করেছেন—
- ৮০,০০০ অশ্বারোহী
- ২,০০,০০০ পদাতিক সৈন্য
- ৮,০০০ রথযোদ্ধা
- ৬,০০০ যুদ্ধহস্তী
কুইন্টাস কার্টিয়াস রুফুস লিখেছেন যে গঙ্গারিডাইয়ের রাজা জ্যানড্রেমেস (Xandrames) বা অগ্রমেস (Agrammes) নিয়ন্ত্রণ করতেন—
- ২০,০০০ অশ্বারোহী
- ২,০০,০০০ পদাতিক
- ২,০০০ চারঘোড়া টানা রথ
- ৩,০০০ যুদ্ধহস্তী
গ্রিক সৈন্যরা এত বিশাল হাতির বাহিনী আগে কখনো দেখেনি। ক্লান্ত ও মনোবলহীন গ্রিক সৈন্যদের কাছে এটি মানসিকভাবে ধ্বংসাত্মক হয়ে দাঁড়ায়। ফলে আলেকজান্ডার বাধ্য হন ফিরে যেতে—যা ভারতীয় ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ মোড়বদল হিসেবে চিহ্নিত।
সমুদ্রবাণিজ্য ও নৌ-শক্তির প্রাধান্য
গঙ্গারিডাই শুধু স্থল-সামরিক শক্তি নয়; এটি ছিল প্রাচীন ভারতের অন্যতম প্রধান নৌ-শক্তি। মেগাস্থিনিসের বিবরণ অনুযায়ী, গঙ্গারিডাই ছিল ধনী ও জাহাজসমৃদ্ধ রাজ্য। গঙ্গা নদীর বিশাল জলপথ, বঙ্গোপসাগরের উপকূল, নদী-মোহনা ও গভীর সমুদ্রের সংযোগ—সব মিলিয়ে গঙ্গারিডাইয়ের নৌবাণিজ্য অত্যন্ত উন্নত হয়েছিল।
নিয়ারখাস, আলেকজান্ডারের নৌ-অধিনায়ক, তার ভ্রমণবৃত্তান্তে উল্লেখ করেছিলেন যে গঙ্গারিডাইয়ের জাহাজ স্থানীয় ভারতীয় জাহাজগুলোর তুলনায় বিশাল, সুদৃঢ় ও প্রযুক্তিগতভাবে অগ্রসর।
তাম্রলিপ্ত (তামলুক): প্রাচীন ভারতের বৃহত্তম বন্দর
তাম্রলিপ্ত ছিল গঙ্গারিডাইয়ের প্রধান বন্দর, যেখান থেকে বাণিজ্য চলত—
- দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া
- চীন
- রোমান সাম্রাজ্য
- শ্রীলঙ্কা
- আরব ও আফ্রিকা
চন্দ্রকেতুগড়ের খননে পাওয়া রোমান মুদ্রা, কাঁচের দ্রব্য, বিদেশি পুঁতি, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অলঙ্কার ইত্যাদি নির্দেশ করে যে গঙ্গারিডাই ছিল প্রাচীনকালের একটি আন্তর্জাতিক বাণিজ্যকেন্দ্র।
“এই ৬টি রাজ্যের দিকে কেউ নজর দেয়নি – বাংলার হারিয়ে যাওয়া রাজ্যগুলোর চমকপ্রদ কাহিনি!”
চন্দ্রকেতুগড়ের প্রত্নতত্ত্ব: প্রাচীন বঙ্গের জানালা
১৯০৫ সালে প্রথম খনন শুরু হলে চন্দ্রকেতুগড়ের বিশাল নগরায়ণ বিশ্বকে বিস্মিত করে। এখানে পাওয়া গেছে—
- উত্তর কৃষ্ণ পালিশিত মৃৎপাত্র (NBPW) — খ্রিস্টপূর্ব ৪০০–১০০
- বহু সংখ্যক টেরাকোটা মূর্তি ও ফলক — পুরাকালের সবচেয়ে সমৃদ্ধ সংগ্রহ
- মৌর্য যুগের মুদ্রা, পান্চমার্কড সিলভার কয়েন
- অর্ধমূল্যবান পাথরের দানা—কার্নেলিয়ান, আগেট, জ্যাসপার
- দুর্গপ্রাচীর, মাটির র্যাম্পার্ট, পরিখা
- হাতির দাঁত, হাড় ও কাঠের নিদর্শন
অর্থাৎ এটি ছিল একটি দুর্গনগরী, বাণিজ্যকেন্দ্র ও শিল্পচর্চার স্থান।
ওয়াড়ি-বটেশ্বর: আরও প্রাচীন নগর সভ্যতা
ওয়াড়ি-বটেশ্বর থেকে পাওয়া গেছে—
- ৬০০ x ৬০০ মিটার দুর্গঘেরা নগর
- ৬ কিলোমিটার দীর্ঘ বাইরের প্রাচীর
- ১৮ মিটার লম্বা, ৬ মিটার চওড়া পাকা রাস্তা
- খ্রিস্টপূর্ব ১১০০ সাল থেকে বসতি
- অগণিত পাথরের দানা—পুরো ভারতের মধ্যে সবচেয়ে বৈচিত্র্যময় সংগ্রহ
- দূরবর্তী অঞ্চলের বাণিজ্য-প্রমাণ
ওয়াড়ি-বটেশ্বর স্পষ্ট করে দেখায় যে গঙ্গারিডাই অঞ্চল হাজার হাজার বছরের পুরোনো নগরায়িত সভ্যতার উত্তরাধিকার বহন করে।
নন্দ ও মৌর্য্য সাম্রাজ্যের সঙ্গে সম্পর্ক
গঙ্গারিডাই রাজ্যের রাজনৈতিক পরিচয় নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে বিতর্ক থাকলেও অনেক আধুনিক গবেষকের মতে—
- গ্রিকরা যাকে “Gangaridai” এবং “Prasii” বলেছিল, তা মূলত নন্দ সাম্রাজ্যের পূর্বাঞ্চলীয় শাখা।
'Prasii' শব্দটি এসেছে Prachya (পূর্বাঞ্চল) থেকে, যা নন্দদের মগধ অঞ্চলের রাজ্যকে নির্দেশ করে। আর গঙ্গারিডাই সম্ভবত তাদের পূর্বাঞ্চলীয়, বঙ্গভিত্তিক শক্তিকেন্দ্র।
নন্দ সাম্রাজ্যের পতনের পর চন্দ্রগুপ্ত মौर্য গঙ্গারিডাই অঞ্চলকে মাগধ-ভিত্তিক মौर্য সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেন। এরপরেও চন্দ্রকেতুগড়, তাম্রলিপ্ত ও অন্যান্য নগর শুঙ্গ, কুষাণ ও গুপ্ত যুগেও সমৃদ্ধ থাকে।
অর্থনীতি ও বৈশ্বিক বাণিজ্য
গঙ্গারিডাই ছিল প্রাচীনকালে একটি ‘গ্লোবালাইজড অর্থনীতি’। এখানকার বাণিজ্য-সম্পর্ক বিস্তৃত ছিল—
- রোম ও ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল
- চীন
- দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া—সুন্দরবন থেকে জাভা, সুমাত্রা, মালয়
- শ্রীলঙ্কা
- আরব ও আফ্রিকা
প্রধান রপ্তানি পণ্য
- গঙ্গার মসলিন (Muslin)—বিশ্বের সবচেয়ে সূক্ষ্ম তুলা
- মালাবাথ্রাম—সুগন্ধি ও ওষুধ
- স্পাইকনার্ড
- মুক্তা
- নীল
- সোনা-রূপা
- তামা
- রত্নপাথর
- সিল্ক
বঙ্গ ভাগীরথী-পদ্মার মধ্যবর্তী অবস্থানের কারণে হিমালয় অঞ্চলের বহু পণ্যও এখানে এসে সমুদ্রপথে বিদেশে পাঠানো হতো।
টেরাকোটার শিল্প: গঙ্গারিডাইয়ের সাংস্কৃতিক পরিচয়
চন্দ্রকেতুগড়ের টেরাকোটা শিল্প প্রাচীন বাংলা ও গঙ্গারিডাই সভ্যতার সেরা সাংস্কৃতিক নিদর্শন। এটি বিখ্যাত—
- যক্ষী মূর্তি—অত্যন্ত সূক্ষ্ম অলংকার, পোশাক, চুলের বিন্যাস
- নিত্যজীবনের দৃশ্য—পরিবার, কৃষি, নৌযান, শিশুদের খেলনা
- সিল ও সীলমোহর—বাণিজ্যের প্রমাণ
- রথ, পশু-পাখি, শিশুদের খেলনা
বঙ্গের অ্যালুভিয়াল মাটিতে কাদামাটির প্রাচুর্য থাকলেও পাথরের অভাব ছিল; তাই টেরাকোটা শিল্প প্রাকৃতিকভাবে বিকশিত হয়েছিল। এর মধ্য দিয়ে সে সময়ের মানুষের পোশাক, ধর্ম, সামাজিক রীতি, রুচি, অর্থনীতি—সবই ফুটে ওঠে।
গঙ্গারিডাই: ইতিহাসে গুরুত্ব
গঙ্গারিডাই রাজ্যের তাৎপর্য বহুস্তরীয়—
১. আলেকজান্ডারের অগ্রযাত্রা থামিয়ে দেওয়া
এটি সামরিক দক্ষতা ও সংগঠনের এক অনন্য উদাহরণ।
২. বঙ্গের প্রথম দিকের নগরায়ণ
দুর্গ, পরিখা, রাস্তাঘাট, বন্দর—সবই উন্নত পরিকল্পনার পরিচয় দেয়।
৩. প্রাচীন ভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ নৌ-শক্তিগুলোর একটি
বাণিজ্য ও সামুদ্রিক ক্ষমতা গঙ্গারিডাইকে আন্তর্জাতিক প্রভাব এনে দেয়।
৪. বৈশ্বিক বাণিজ্য কেন্দ্র
রোমান সাম্রাজ্য থেকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া পর্যন্ত গঙ্গারিডাইয়ের রপ্তানিপণ্য ছড়িয়ে পড়েছিল।
৫. বাংলা সংস্কৃতির প্রাচীন শিকড়
চন্দ্রকেতুগড়, তাম্রলিপ্ত ও ওয়াড়ি-বটেশ্বর দেখিয়ে দেয় বাংলা একটি প্রাচীন, স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক অঞ্চল।
উপসংহার
গঙ্গারিডাই রাজ্য প্রাচীন বঙ্গের সেই বিস্মৃত মহাকাব্য, যার গল্প ভূগোলবিদ, ভ্রমণকারী, সেনাপতি ও বণিকদের বিবরণে বিশ্বজোড়া বিস্তৃত। এই রাজ্য ছিল—
- শক্তিশালী
- সমৃদ্ধ
- সাংস্কৃতিকভাবে জটিল
- এবং সামুদ্রিক ভারতীয় বাণিজ্যের প্রধান হাব
যদিও ভারতীয় শাস্ত্র বা সাহিত্য গঙ্গারিডাই নামটি খুব কম উল্লেখ করেছে, প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন ও গ্রিক-রোমান দলিলের মাধ্যমে আজ স্পষ্ট যে এটি এক অত্যন্ত শক্তিশালী ও উন্নত সভ্যতা ছিল, যা একসময় বিশ্বের সবচেয়ে ভয়ংকর যুদ্ধবাহিনীকে দাঁড় করিয়ে রেখেছিল।
আজ চন্দ্রকেতুগড়, ওয়াড়ি-বটেশ্বর, তাম্রলিপ্তের ধ্বংসাবশেষ ও বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে থাকা তাদের শিল্পকলার নিদর্শন প্রমাণ করে যে গঙ্গারিডাই ছিল প্রাচীন বাংলারই এক মহান সাম্রাজ্য, যার ইতিহাস এখনও গবেষণা, রহস্য ও বিস্ময়ের উৎস হয়ে আছে।
“এই ৬টি রাজ্যের দিকে কেউ নজর দেয়নি – বাংলার হারিয়ে যাওয়া রাজ্যগুলোর চমকপ্রদ কাহিনি!”


,_2016.jpg)