আদানি গড্ডা পাওয়ার প্ল্যান্ট, বাংলাদেশ বিদ্যুৎ চুক্তি ও রাজনৈতিক অস্থিরতা: নভেম্বর ২০২৫-এর পূর্ণাঙ্গ বিশ্লেষণ

বাংলাদেশ বিদ্যুৎ সংকট

দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতি ও জ্বালানি কূটনীতিতে নভেম্বর ২০২৫ একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড় এনে দিয়েছে। ভারতের আদানি পাওয়ার লিমিটেড পরিচালিত গড্ডা আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল থার্মাল পাওয়ার প্ল্যান্ট—যা মূলত বাংলাদেশের জন্য নির্মিত—এখন ভারতের জাতীয় গ্রিডেও বিদ্যুৎ সরবরাহ করছে। এর পেছনে রয়েছে দুই দেশের মধ্যে চলমান অর্থনৈতিক টানাপোড়েন, রাজনৈতিক পরিবর্তন, এবং আন্তর্জাতিক আইনি জটিলতা।
এই প্রবন্ধে আমরা আলোচনা করব—কীভাবে আদানির বিদ্যুৎ প্রকল্প বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকট, শেখ হাসিনার পতন, এবং দক্ষিণ এশিয়ার জ্বালানি রাজনীতিকে পুনর্গঠিত করছে।


আদানি গড্ডা পাওয়ার প্ল্যান্ট: একটি আন্তর্জাতিক প্রকল্পের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস

ঝাড়খণ্ডের গড্ডা জেলায় অবস্থিত ১,৬০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন এই থার্মাল পাওয়ার প্ল্যান্টটি আদানি পাওয়ার লিমিটেড নির্মাণ করে মূলত বাংলাদেশের জন্য।
২০১৭ সালে ২৫ বছরের একটি দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি হয়েছিল বাংলাদেশ পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ড (BPDB) এবং আদানি পাওয়ার-এর মধ্যে। সেই চুক্তি অনুযায়ী, গড্ডা প্ল্যান্টের উৎপাদিত প্রায় ১০ শতাংশ বিদ্যুৎ বাংলাদেশের জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করা হবে, যা বাংলাদেশের বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থায় একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশীদারিত্ব তৈরি করে।

এই প্রকল্পকে ভারতের “জ্বালানি কূটনীতির প্রতীক” হিসেবে ধরা হয়েছিল, কারণ এটি ছিল ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে প্রথম বেসরকারি সীমান্ত-অতিক্রমী বিদ্যুৎ চুক্তি।


💸 চুক্তির শর্ত, ট্যারিফ ও বকেয়া অর্থের জট

২০২৪ সালের শেষ নাগাদ বাংলাদেশের সরকার আদানি পাওয়ারকে প্রতি ইউনিটে ১৪.৮৭ টাকা (প্রায় $০.১২২০) হারে মূল্য প্রদান করছিল, যা ভারতের অন্যান্য বিদ্যুৎ সরবরাহকারীদের তুলনায় অনেক বেশি।
তুলনামূলকভাবে, ভারতের বিদ্যুৎ বোর্ড গড়ে প্রতি ইউনিট ৯.৫৭ টাকা পরিশোধ করে। এই উচ্চ ট্যারিফ নিয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবল সমালোচনা শুরু হয়—বিশেষ করে যখন দেশের অর্থনীতি জ্বালানি আমদানির খরচে চাপে পড়ে।

২০২৫ সালের শুরুতে বাংলাদেশের সরকারের কাছে আদানির পাওনা দাঁড়ায় প্রায় ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। তবে জুন মাসে প্রায় ৪৩৭ মিলিয়ন ডলার পরিশোধের পর বকেয়া অনেকাংশে কমে আসে, এবং নভেম্বর ২০২৫ নাগাদ কেবল ১৫ দিনের সমমূল্যের পাওনা অবশিষ্ট থাকে।


⚖️ আন্তর্জাতিক সালিশি ও আইনি লড়াই

চুক্তির ট্যাক্স সুবিধা, বিলিং ও মূল্যের পার্থক্য নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে বিরোধ চলমান।
এই কারণে ২০২৫ সালের মাঝামাঝি সময়ে আদানি পাওয়ার ও বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ আন্তর্জাতিক সালিশি আদালতে মামলা করে।
বিশ্লেষকদের মতে, বাংলাদেশের সরকার যদি একতরফাভাবে এই চুক্তি বাতিল করতে চায়, তবে তা ৫ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত জরিমানার ঝুঁকি তৈরি করতে পারে

বাংলাদেশের বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার—যা শেখ হাসিনার পতনের পর ক্ষমতায় এসেছে—চুক্তিটি নতুন করে পর্যালোচনা করছে। ফলে, চুক্তির ভবিষ্যৎ এখন অনিশ্চিত।


ভারতের জাতীয় গ্রিডে সংযুক্তি: নতুন কৌশল

অক্টোবর ২০২৫-এ ভারতের কেন্দ্রীয় বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয় অভূতপূর্ব একটি সিদ্ধান্ত নেয়—গড্ডা প্ল্যান্টকে ভারতের জাতীয় বিদ্যুৎ গ্রিডে সংযুক্তির অনুমতি দেয়।
এর ফলে আদানি এখন গড্ডা থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ ভারতীয় বাজারেও সরবরাহ করতে পারবে, বিশেষ করে যখন বাংলাদেশের রফতানি কমে যায় বা স্থগিত থাকে।

এই সংযোগ ২৫ বছরের জন্য বৈধ করা হয়েছে এবং প্রয়োজনীয় ট্রান্সমিশন অবকাঠামো ইতোমধ্যেই স্থাপন সম্পন্ন হয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, এটি আদানির জন্য একটি “বাণিজ্যিক নিরাপত্তা বলয়” তৈরি করেছে, যাতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকট তাদের ব্যবসায়িক ক্ষতি না ঘটায়।


বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা: শেখ হাসিনার পতন ও আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ

📅 কীভাবে শুরু হলো সংকট

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট বাংলাদেশের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী দিন।
দীর্ঘদিনের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাত্র আন্দোলনের চাপে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান তার পদত্যাগের ঘোষণা দেন।
হাসিনা ও তাঁর পরিবার ভারতে আশ্রয় নেন এবং বর্তমানে নয়াদিল্লিতে অবস্থান করছেন।

নতুন সরকার ও রাজনৈতিক বিচার

হাসিনার পতনের পর একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়, যার নেতৃত্বে রয়েছেন নোবেল বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনুস
২০২৫ সালের মে মাসে আওয়ামী লীগকে আনুষ্ঠানিকভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়।
হাসিনা ও তাঁর মন্ত্রিসভার কয়েকজন সদস্যের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলা চলছে, যেখানে প্রসিকিউশন পক্ষ মৃত্যুদণ্ডের আবেদন জানিয়েছে।

অন্যদিকে হাসিনা দাবি করছেন, এই মামলা সম্পূর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং একদিন আওয়ামী লীগ আবার দেশে ফিরে আসবে।


ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের নতুন বাস্তবতা

জ্বালানি কূটনীতি ও কৌশলগত ভারসাম্য

বাংলাদেশ যখন আর্থিক সংকটের কারণে বিদ্যুৎ আমদানি কমিয়ে দেয়, তখন ভারত দ্রুত প্রতিক্রিয়া দেখায়।
গড্ডা প্ল্যান্টকে ভারতের নিজস্ব গ্রিডে যুক্ত করার অনুমোদনকে অনেক বিশেষজ্ঞ দেখছেন আদানিকে বাঁচানোর পদক্ষেপ হিসেবে।
তবে এটি ভারতের জন্যও কৌশলগত সাফল্য—কারণ এটি বাংলাদেশের অস্থিরতা সত্ত্বেও ভারতের জ্বালানি নিরাপত্তা বজায় রাখে।

🤝 আওয়ামী লীগের পতন ও আঞ্চলিক প্রভাব

দীর্ঘদিন ধরে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের মূল ভিত্তি ছিল সেক্যুলার ও প্রো-ইন্ডিয়া আওয়ামী লীগ
কিন্তু সেই দলের পতন এবং নিষিদ্ধ ঘোষণার পর দুই দেশের সম্পর্ক এক অনিশ্চিত পর্যায়ে প্রবেশ করেছে।
নতুন সরকার ভারতের কাছ থেকে নিরপেক্ষ নীতির আশ্বাস দিলেও, বাণিজ্য ও নিরাপত্তা ইস্যুতে ভবিষ্যৎ সহযোগিতা নিয়ে সংশয় থেকে যাচ্ছে।


বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্ক ও আইএসআই উদ্বেগ

বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতার সুযোগ নিতে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই সক্রিয় হয়ে উঠেছে বলে ভারতীয় বিশ্লেষকরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
ঢাকা ও চট্টগ্রাম অঞ্চলে গোপনে পাকিস্তানপন্থী সংগঠনগুলোর পুনরুত্থান লক্ষ্য করা গেছে, যা ভারতের উত্তর-পূর্ব সীমান্তের নিরাপত্তার জন্যও উদ্বেগজনক।
ভারতের পররাষ্ট্রনীতি তাই এখন বাংলাদেশে “স্থিতিশীল সরকার” ও “চুক্তির ধারাবাহিকতা” বজায় রাখাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিচ্ছে।


🔍 গভীর বিশ্লেষণ: কে লাভবান, কে ক্ষতিগ্রস্ত?

বিষয় বাংলাদেশের দৃষ্টিকোণ ভারতের দৃষ্টিকোণ আদানির দৃষ্টিকোণ
চুক্তি মূল্য অতিরিক্ত দাম, জনগণের ক্ষোভ ভারতের রপ্তানি আয় লাভজনক চুক্তি
রাজনৈতিক ঝুঁকি সরকারের পতন, মামলা কৌশলগত চাপ বাজার বৈচিত্র্য
গ্রিড সংযোগ নির্ভরতা কমছে জ্বালানি নিয়ন্ত্রণ বাড়ছে উৎপাদন স্থিতিশীলতা
আন্তর্জাতিক প্রভাব আইনি দায় ও বিদেশি চাপ দক্ষিণ এশিয়ায় প্রভাব বৃদ্ধি ব্যবসার স্থায়িত্ব

ভবিষ্যৎ পরিপ্রেক্ষিত: কী হতে পারে পরবর্তী পদক্ষেপ

  1. আন্তর্জাতিক সালিশি রায়ের ফলাফল – যদি আদালত আদানির পক্ষে রায় দেয়, তবে বাংলাদেশকে বিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণ দিতে হতে পারে।
  2. বাংলাদেশে রাজনৈতিক স্থিতি ফিরে আসা – ইউনুস সরকারের পর একটি নির্বাচিত সরকার এলে, চুক্তির পুনর্বিবেচনা হতে পারে।
  3. ভারতের আঞ্চলিক জ্বালানি নীতি পুনর্গঠন – ভারত এখন গড্ডা প্ল্যান্টকে ব্যবহার করে নেপাল, ভুটান, এমনকি মায়ানমারের সঙ্গে নতুন বিদ্যুৎ বাণিজ্যের পরিকল্পনা করছে।
  4. চীন ও পাকিস্তানের ভূমিকাও – বাংলাদেশে চীনের উপস্থিতি ও পাকিস্তানের গোয়েন্দা আগ্রহ ভবিষ্যতে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ককে আরও জটিল করে তুলতে পারে।

উপসংহার

আদানি গড্ডা পাওয়ার প্ল্যান্টের ঘটনাটি কেবল একটি ব্যবসায়িক চুক্তির গল্প নয়—এটি দক্ষিণ এশিয়ার বর্তমান রাজনীতি, কূটনীতি ও অর্থনীতির প্রতিফলন।
শেখ হাসিনার পতন, আওয়ামী লীগের নিষিদ্ধ ঘোষণা, এবং বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ সংকট এই চুক্তিকে রাজনৈতিক বিতর্কের কেন্দ্রে নিয়ে এসেছে।
ভারত তার পক্ষ থেকে কৌশলগতভাবে গড্ডা প্ল্যান্টকে নিজের গ্রিডে সংযুক্ত করেছে, যাতে ভবিষ্যৎ ঝুঁকি কমানো যায়।

তবে চূড়ান্তভাবে এই সম্পর্কের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে—বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, আন্তর্জাতিক আদালতের রায়, এবং দুই দেশের পারস্পরিক আস্থার ওপর।
আগামী দশকে দক্ষিণ এশিয়ার জ্বালানি সহযোগিতা ও আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য এই চুক্তি একটি পরীক্ষা ক্ষেত্র হিসেবে কাজ করবে।


🔻মূল সারসংক্ষেপ:
আদানির গড্ডা প্ল্যান্ট বর্তমানে ভারতের ও বাংলাদেশের রাজনৈতিক সম্পর্ক, জ্বালানি কৌশল এবং ব্যবসায়িক ভবিষ্যতের কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করছে। শেখ হাসিনার পতন ও নতুন সরকারের নীতি নির্ধারণই নির্ধারণ করবে—এই সীমান্ত-পার বিদ্যুৎ সহযোগিতা টিকে থাকবে কিনা।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

যদি আপনার কোনও বিষয়ে ডাউট থাকে বা কোনও বিষয় suggest করতে চান তাহলে মেল করুন!

নবীনতর পূর্বতন

banglafacts 4