বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, ড. মুহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বে, বিতর্কিত ইসলামী বক্তা ড. জাকির নায়েকের দেশে প্রবেশ নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই পদক্ষেপ কেবল একটি প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নয় — বরং এটি দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে একটি নতুন কূটনৈতিক উত্তেজনার সূচনা ঘটিয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, এই সিদ্ধান্ত কি নিরাপত্তাজনিত প্রয়োজন থেকে এসেছে, নাকি ভারতের চাপেই বাংলাদেশ এমনটি করেছে?
পটভূমি: এক অনুমতি থেকে নিষেধাজ্ঞা পর্যন্ত
কয়েক সপ্তাহ আগেও সরকার জাকির নায়েককে নভেম্বর ২৮ থেকে ডিসেম্বর ২০ পর্যন্ত বাংলাদেশ সফরের অনুমতি দিয়েছিল। মুহাম্মদ ইউনুসের সরকার যেভাবে গণতন্ত্র ও সংস্কারের প্রচার করে, তা বিবেচনায় এ অনুমতি ছিল বেশ বিস্ময়কর।
তবে, ৪ নভেম্বর, গৃহ মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত এক উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে সেই অনুমতি সম্পূর্ণ বাতিল করা হয়। বৈঠকে অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল এম. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন কর্মকর্তারা মত দেন, নায়েকের আগমন “বৃহৎ জনসমাবেশ” ঘটাবে, যা নির্বাচনের প্রাক্কালে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করবে।
সরকারী যুক্তি: নিরাপত্তা ও লজিস্টিক কারণ
সরকারের আনুষ্ঠানিক বক্তব্যে বলা হয়েছে—
“নির্বাচনের সময় নিরাপত্তা ব্যবস্থার উপর অতিরিক্ত চাপ পড়ছে, তাই এই সফর অনুমোদন সম্ভব নয়।”
জানা গেছে, নায়েক ঢাকায় দুই দিনের ধর্মীয় অনুষ্ঠান শেষে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ভ্রমণ করতে চেয়েছিলেন। তার বিপুল জনপ্রিয়তা ও বিতর্কিত ভাবমূর্তি মিলিয়ে এটি এক বিশাল গণসমাবেশে পরিণত হতে পারত।
সরকারের যুক্তি বাস্তবসম্মত হলেও, অনেকে মনে করছেন—এটি সম্পূর্ণ গল্প নয়।
ভারতের কূটনৈতিক চাপ: প্রমাণ স্পষ্ট
ভারত এই সিদ্ধান্তের পেছনে পরোক্ষ চাপ প্রয়োগ করেছে, এবং সেটি একাধিক সূত্রে নিশ্চিত।
৩০ অক্টোবর, ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রন্ধীর জয়সওয়াল বলেন—
“তিনি ভারতের আইনের চোখে একজন পলাতক। আমরা আশা করি, কোনো দেশই তাকে আশ্রয় দেবে না এবং আমাদের নিরাপত্তা উদ্বেগকে গুরুত্ব দেবে।”
এটি ছিল শুধু অনুরোধ নয়, একপ্রকার কূটনৈতিক সতর্কবার্তা।
ভারতীয় মিডিয়া জানায়, ২৯ অক্টোবরেই দিল্লি আনুষ্ঠানিকভাবে ঢাকা সরকারকে নায়েককে হস্তান্তরের আহ্বান জানায়, ২০১৩ সালের দ্বিপাক্ষিক এক্সট্রাডিশন চুক্তির আওতায়।
বাংলাদেশ এই চাপের প্রতি সরাসরি সাড়া না দিলেও, ৩১ অক্টোবর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র এস. এম. মাহবুবুল আলম মন্তব্য করেন—
“আমরা বিশ্বাস করি, কোনো দেশই অভিযুক্ত ব্যক্তিকে আশ্রয় দেওয়া উচিত নয় — ভারতও না।”
এই বক্তব্যে একদিকে ভারতের প্রতি ইঙ্গিত, অন্যদিকে শেখ হাসিনার ভারতে আশ্রয় নেওয়া সম্পর্কেও সূক্ষ্ম কূটনৈতিক বার্তা ছিল।
ভারতের উদ্বেগ কি ভিত্তিহীন?
না, ভারতের নিরাপত্তা উদ্বেগের একটি বাস্তব ভিত্তি রয়েছে।
জাকির নায়েক একজন ভারতীয় ধর্মীয় বক্তা, যিনি ২০১৬ সালে দেশ ছেড়ে মালয়েশিয়ায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ—
- ঘৃণাত্মক বক্তব্য প্রচার,
- ধর্মীয় বিভাজন উসকে দেওয়া,
- ও অর্থনৈতিক অনিয়মে জড়িত থাকা।
সবচেয়ে বিতর্কিত দিক হলো, ২০১৬ সালের ঢাকা হলি আর্টিজান বেকারি হামলায় (যেখানে ২২ জন নিহত হন) অংশগ্রহণকারীদের কয়েকজন নায়েকের বক্তৃতা দ্বারা অনুপ্রাণিত ছিল বলে তদন্তে উঠে আসে।
ভারতের NIA তার বিরুদ্ধে একাধিক মামলা চালাচ্ছে। ভারত দাবি করে, নায়েকের বক্তৃতা ও চ্যানেল (Peace TV) বহু তরুণকে চরমপন্থায় প্রলুব্ধ করেছে।
ইসলামপন্থী প্রভাব ও ইউনুস সরকারের ভারসাম্য রক্ষা
এই ঘটনার আরেকটি দিক রয়েছে—বাংলাদেশে ইসলামপন্থী সংগঠনগুলির ক্রমবর্ধমান প্রভাব।
নভেম্বরের শুরুতে, সরকার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সঙ্গীত ও শারীরিক শিক্ষা শিক্ষক পদ বাতিল করে। এই সিদ্ধান্ত আসে ইসলামী সংগঠনগুলির দাবির পর।
এই সংগঠনগুলো—হেফাজতে ইসলাম, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, জামিয়াত-ই-ইসলামী প্রভৃতি—ইউনুস সরকারের বিরুদ্ধে “বিরোধী-ইসলামী এজেন্ডা” অনুসরণের অভিযোগ তোলে।
সেপ্টেম্বরে, এসব সংগঠন মহিলা সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব বাতিল না করলে ইউনুসকে সরাসরি হুমকি দেয়:
“শেখ হাসিনার মতো পালানোর সময়ও পাবেন না।”
ফলে, দেখা যায়—ইউনুস সরকারকে একদিকে ভারতের চাপ, অন্যদিকে ইসলামী সংগঠনের চাপ—দুটো দিকেই ভারসাম্য রক্ষা করতে হচ্ছে।
ভূ-রাজনীতি: পাকিস্তানের ভূমিকা ও আঞ্চলিক প্রতিযোগিতা
এই বিতর্কে পাকিস্তানও নেপথ্যে সক্রিয়। গত বছর নায়েক পাকিস্তান সফরে গিয়ে লশকর-ই-তাইবা (LeT)-এর নেতাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ISI বাংলাদেশে তার প্রভাব পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে চাইছে, এবং নায়েকের সফর সেই বৃহত্তর পরিকল্পনার অংশ হতে পারত।
ফলে, বাংলাদেশে নায়েককে আমন্ত্রণ জানানো কেবল ধর্মীয় সিদ্ধান্ত নয়, বরং একটি কৌশলগত পদক্ষেপ, যা ভারতের নজরে পড়েছিল।
মূল সত্য
১. ভারতের সরাসরি চাপ ছিল। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মন্তব্য স্পষ্ট কূটনৈতিক বার্তা দেয়।
২. নিরাপত্তা উদ্বেগও বাস্তব। নায়েকের উপস্থিতি নির্বাচনের সময় বিশৃঙ্খলা ডেকে আনতে পারত।
৩. কিন্তু সিদ্ধান্ত একমাত্র নিরাপত্তাজনিত নয়। এটি এক জটিল ভূ-রাজনৈতিক ভারসাম্যের ফল, যেখানে ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি মিলেমিশে আছে।
দক্ষিণ এশিয়ার প্রেক্ষাপটে তাৎপর্য
এই ঘটনায় উঠে এসেছে কয়েকটি বড় শিক্ষা—
- বাংলাদেশে ধর্মীয় রাজনীতির পুনরুত্থান ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছে।
- পাকিস্তানের প্রভাব আবারও অনুভূত হচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে।
- ভারতের নিরাপত্তা ও কূটনৈতিক সংবেদনশীলতা আরও বাড়ছে।
- এবং ইউনুস সরকারের জনসমর্থন ও নীতিগত অবস্থান এখন দ্বিধাগ্রস্ত অবস্থায়।
উপসংহার
জাকির নায়েককে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা ইউনুস সরকারের একটি সাহসী কিন্তু কৌশলগত পদক্ষেপ।
এতে যেমন বাস্তব নিরাপত্তা বিবেচনা রয়েছে, তেমনি ভারতের চাপ ও আঞ্চলিক রাজনীতিরও গভীর প্রভাব বিদ্যমান।
বাংলাদেশ আজ এমন এক পর্যায়ে দাঁড়িয়ে আছে, যেখানে ধর্ম, কূটনীতি ও রাজনীতি একে অপরের সঙ্গে জটিলভাবে জড়িয়ে গেছে।
এবং জাকির নায়েক ইস্যুটি সেই বৃহত্তর অস্থিতিশীল ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি মাত্র।