১. বঙ্গ (Vanga) ছিল প্রাচীন বঙ্গীয় সভ্যতার অন্যতম সমৃদ্ধ ও নৌ-বাণিজ্যনির্ভর রাজ্য
বঙ্গ প্রাচীন ভারতের দক্ষিণ-পূর্ব অংশে অবস্থিত ছিল, যা আজকের পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে মিলে যায়। আয়তরেয় আরণ্যকে বঙ্গ জাতির নাম প্রথম দেখা যায়, যেখানে বঙ্গদের আর্য সভ্যতার বাইরের জনগণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। বঙ্গের অবস্থান গঙ্গার মোহনার ত্রিভুজাকার ডেল্টা অঞ্চলে ছিল — ভগীরথী ও পদ্মা নদীর মধ্যবর্তী এলাকায়।
কালিদাসের রঘুবংশ কাব্যে বঙ্গকে একটি নৌশক্তি হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। এটি প্রমাণ করে যে বঙ্গবাসীরা জাহাজ নির্মাণ ও নৌবাণিজ্যে অত্যন্ত পারদর্শী ছিল। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে বঙ্গকে নরম ও উৎকৃষ্ট তুলো কাপড় উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত বলা হয়েছে।
২. বঙ্গরাজ্যের প্রিন্স বিজয় ও শ্রীলঙ্কা প্রতিষ্ঠার কিংবদন্তি
খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতকে বঙ্গরাজ্যের রাজপুত্র বিজয় তাঁর পিতা সিংহবাহুর নির্দেশে বঙ্গোপসাগর পাড়ি দিয়ে শ্রীলঙ্কায় পৌঁছান এবং সেখানে রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। এই কিংবদন্তি শ্রীলঙ্কার মহাবংস গ্রন্থেও উল্লেখিত আছে। এর মাধ্যমে বঙ্গের সমুদ্রগামী বাণিজ্য ও সাংস্কৃতিক যোগাযোগের ঐতিহাসিক তাৎপর্য বোঝা যায়।
৩. বঙ্গরাজ্যে ধর্মীয় সহাবস্থান ছিল উল্লেখযোগ্য
বঙ্গে একাধিক ধর্ম সহাবস্থান করেছিল — হিন্দু ধর্ম, জৈন ধর্ম ও বৌদ্ধ ধর্ম এখানে প্রভাব বিস্তার করেছিল। জৈন সাহিত্য অনুযায়ী তাম্রলিপ্তি (বর্তমান তমলুক) বঙ্গরাজ্যের রাজধানী ছিল এবং এটি একটি সমৃদ্ধ বাণিজ্যবন্দর হিসেবেও পরিচিত ছিল। চন্দ্রকেতুগড় নামক প্রত্নস্থলে প্রাক-মৌর্য যুগ থেকে পাল-সেন যুগ পর্যন্ত ক্রমাগত নগরজীবনের প্রত্নপ্রমাণ পাওয়া গেছে।
৪. পুণ্ড্রবর্ধন ছিল উত্তর বঙ্গের প্রাচীন রাজ্য
পুণ্ড্রবর্ধন (বা পুণ্ড্র) রাজ্যটি আজকের বাংলাদেশের রাজশাহী, রংপুর বিভাগ ও ভারতের পশ্চিম দিনাজপুর জেলায় বিস্তৃত ছিল। রাজধানী ছিল পুণ্ড্রনগর, যা বর্তমানে বগুড়া জেলার মহাস্থানগড় নামে পরিচিত। খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীতেই এটি মৌর্য সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয় এবং অশোকের শিলালিপি সেখানে আবিষ্কৃত হয়েছে।
৫. মহাস্থানগড়: পুণ্ড্রবর্ধনের ঐতিহাসিক নিদর্শন
মহাস্থানগড়ের প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণে দেখা যায় এটি খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতক থেকে পাল যুগ পর্যন্ত অব্যাহতভাবে বসতিপূর্ণ ছিল। এখানে বৌদ্ধ স্তূপ, প্রাচীন দুর্গ, শিলালিপি, ও মুদ্রা পাওয়া গেছে। অশোকের শাসনামলে এই অঞ্চলে বৌদ্ধ ধর্ম ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করে।
৬. পুণ্ড্রবর্ধনের ভূগোল ও কৃষিভিত্তিক সমৃদ্ধি
পুণ্ড্র রাজ্যের পশ্চিম সীমান্ত ছিল কৌশিকী নদী এবং পূর্ব সীমান্ত ছিল করতোয়া নদী। উর্বর মাটি ও নদীবাহিত অববাহিকা এই রাজ্যকে কৃষিনির্ভর ও অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ করেছিল। গুপ্ত যুগে এটি শিক্ষা ও বাণিজ্যের কেন্দ্র হিসেবেও খ্যাতি লাভ করে।
৭. সুহ্ম (Suhma) ছিল দক্ষিণ-পশ্চিম বঙ্গের প্রাচীন রাজ্য
সুহ্ম রাজ্যটি বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুর, হুগলি ও হাওড়া জেলার অংশে অবস্থিত ছিল। এটি বঙ্গ, আঙ্গ, কলিঙ্গ ও পুণ্ড্রের সঙ্গে একই বংশধারার রাজ্য হিসেবে পরিচিত। মহাভারতে উল্লেখ আছে যে, অর্জুন ও ভীম তাদের রাজসূয় যজ্ঞের অভিযানে সুহ্ম রাজ্য জয় করেছিলেন।
৮. সুহ্ম রাজ্যের সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার
সুহ্মের জনগণ প্রাচীন বঙ্গীয় সংস্কৃতির এক বিশেষ ধারা বহন করেছিল। রঘুবংশে কালিদাস উল্লেখ করেন, রঘু তাঁর পূর্ব অভিযানে সুহ্ম রাজ্য জয় করেছিলেন। এটি দেখায় যে রাজ্যটি আর্য সভ্যতার প্রভাবে ধীরে ধীরে আসলেও তার নিজস্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বজায় রেখেছিল।
৯. অঙ্গ (Anga) ছিল পূর্ব ভারতের অন্যতম মহাজনপদ
অঙ্গ প্রাচীন ভারতের ১৬টি মহাজনপদের একটি ছিল, যার রাজধানী ছিল চম্পা (বর্তমান ভাগলপুর, বিহার)। এর পশ্চিমে মগধ, পূর্বে বঙ্গ, দক্ষিণে কলিঙ্গ এবং উত্তরে হিমালয় ছিল। আঙ্গরাজ্য ব্যবসা-বাণিজ্যে বিখ্যাত ছিল, বিশেষত চম্পা নগর সমুদ্রবাণিজ্যের জন্য প্রসিদ্ধ।
১০. অঙ্গের বীর রাজা কর্ণ ও মহাভারতের ঐতিহ্য
মহাভারতে আঙ্গরাজ্যের সঙ্গে কর্ণের নাম অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। দুর্যোধন কর্ণকে আঙ্গরাজ্যের রাজা হিসেবে অভিষিক্ত করেন। এই ঘটনা শুধু পৌরাণিক নয়, বরং রাজনৈতিক জোটের প্রতীকও — কারণ এর মাধ্যমে কুরু রাজ্য আঙ্গের আনুগত্য লাভ করে।
১১. অঙ্গ ও মগধের সংঘর্ষ ও একীকরণ
খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে মগধরাজ বিম্বিসার আঙ্গরাজ্যের শেষ স্বাধীন রাজা ব্রহ্মদত্তকে হত্যা করে আঙ্গকে মগধের সঙ্গে যুক্ত করেন। এই একীকরণই পরবর্তীতে বৃহত্তর মগধ সাম্রাজ্যের ভিত্তি স্থাপন করে, যা পরবর্তীতে নন্দ, মোর্য, ও গুপ্ত সাম্রাজ্যে রূপ নেয়।
১২. সমতট (Samatata): দক্ষিণ-পূর্ব বঙ্গের একটি প্রাচীন ভূখণ্ড
সমতটের অঞ্চল বর্তমান বাংলাদেশের কুমিল্লা-নোয়াখালী সমভূমি, চট্টগ্রামের অংশ ও ত্রিপুরা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। পশ্চিম সীমান্ত ছিল মেঘনা নদী, পূর্বে ছিল ত্রিপুরা ও আরাকান পাহাড়। এই অঞ্চল ছিল নদী ও সমুদ্রসংলগ্ন, ফলে বাণিজ্যিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
১৩. সমতটের গুপ্ত-পরবর্তী ইতিহাস ও সাম্রাজ্যিক মর্যাদা
সমতটের প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় সম্রাট সমুদ্রগুপ্তের (খ্রিস্টীয় ৩৫০–৩৭৫) আল্লাহাবাদ প্রশস্তিতে, যেখানে এটি গুপ্ত সাম্রাজ্যের সীমান্ত রাজ্য হিসেবে বার্ষিক কর প্রদানকারী অঞ্চল হিসেবে উল্লেখিত। পরবর্তীতে দেব, খদ্গ, চন্দ্র ও বর্মণ প্রভৃতি রাজবংশ এই অঞ্চলে শাসন করেন।
১৪. সমতটে বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাব ও শালবান বিহার
চীনা পর্যটক হিউয়েন সাঙ সমতটকে “সমুদ্রসংলগ্ন আর্দ্র ভূমি” বলে বর্ণনা করেন এবং এখানে বহু বিহার ও স্তূপের উপস্থিতি উল্লেখ করেন। দেববংশীয় রাজারা দেবপর্বত (বর্তমান কোটবাড়ি, কুমিল্লা) থেকে শাসন করতেন। এখানেই অবস্থিত বিখ্যাত শালবান বিহার, যা পাল ও চন্দ্র যুগের বৌদ্ধ স্থাপত্যের অন্যতম নিদর্শন।
১৫. চন্দ্র রাজবংশ ও সমতটের সামরিক শক্তি
চন্দ্র রাজারা (খ্রিস্টীয় নবম–দশম শতক) সমতট, বঙ্গ ও আরাকান পর্যন্ত বিস্তৃত এক শক্তিশালী সাম্রাজ্য গঠন করেন। তাঁদের শাসনামলে বৌদ্ধ ধর্মচর্চা বৃদ্ধি পায় এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সম্প্রসারিত হয়। তাঁরা পাল সাম্রাজ্যের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবেও পরিচিত ছিলেন।
১৬. হরিকেল (Harikela): প্রাচীন পূর্ববঙ্গের এক সমৃদ্ধ রাজ্য
হরিকেল রাজ্যটি আজকের চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, নোয়াখালী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও ত্রিপুরা অঞ্চল জুড়ে বিস্তৃত ছিল। এর দক্ষিণ সীমান্ত ছিল বঙ্গোপসাগর, পূর্বে ছিল চট্টগ্রাম পাহাড়, পশ্চিমে মেঘনা নদী এবং উত্তরে ত্রিপুরা পাহাড়।
১৭. হরিকেল: পূর্ব ভারতের সীমান্ত ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র
চীনা ভিক্ষু ই-ত্সিং (I-Tsing) সপ্তম শতকে হরিকেলকে "ভারতের পূর্ব প্রান্তের রাজ্য" হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এটি প্রমাণ করে যে, হরিকেল তখন পূর্ব ভারতের একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ছিল, যেখানে বৌদ্ধ ও হিন্দু ধর্মের সংমিশ্রণ ঘটেছিল।
১৮. হরিকেলের নামের ব্যুৎপত্তি ও ধর্মীয় তাৎপর্য
"হরিকেল" শব্দটির অর্থ নিয়ে ইতিহাসবিদদের মধ্যে মতভেদ আছে। কেউ বলেন “হরি” অর্থাৎ বিষ্ণু ও “কেল” মানে অঞ্চল — অর্থাৎ “বিষ্ণুর ভূমি”; আবার কেউ মনে করেন “কেল” মানে পাহাড়, যা চট্টগ্রাম ও ত্রিপুরার পার্বত্য অঞ্চলের ভূপ্রকৃতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ।
১৯. হরিকেলের চন্দ্র রাজারা ও তাদের স্বর্ণযুগ
চন্দ্র রাজবংশের রাজারা, যেমন সূর্যচন্দ্র ও ত্রিভুবনচন্দ্র, হরিকেলকে একটি স্বাধীন ও শক্তিশালী রাজ্যে রূপান্তরিত করেন। তাঁদের শাসনামলে “হরিকেল” লিখিত মুদ্রা প্রচলিত ছিল, যা রাজনৈতিক স্বাধীনতা ও আঞ্চলিক ঐক্যের প্রতীক। হরিকেল কৃষি, পাহাড়ি সম্পদ ও সমুদ্রবাণিজ্যে সমৃদ্ধ ছিল।
২০. অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ, পুণ্ড্র ও সুহ্ম — পৌরাণিক পাঁচ রাজ্যের যৌথ উৎপত্তি
মহাভারত ও পুরাণ অনুসারে, এই পাঁচটি রাজ্যের (আঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ, পুণ্ড্র ও সুহ্ম) প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন পাঁচ ভাই, যারা ঋষি দুর্গতামস ও রাজা বলির স্ত্রী সুদেশনা-র যোগে জন্মগ্রহণ করেন। এই পৌরাণিক কাহিনি বাস্তব ইতিহাস না হলেও, এটি প্রমাণ করে যে আর্য ধর্ম ও সংস্কৃতি কীভাবে পূর্ব ভারতে প্রসারিত হয়েছিল।
Online Earning by Freelance Writing Tips
✍️ উপসংহার
প্রাচীন বঙ্গীয় রাজ্যগুলো কেবল আঞ্চলিক প্রশাসনিক বিভাজন ছিল না, বরং এগুলো ভারতীয় ইতিহাস, সভ্যতা ও ধর্মীয় বিকাশের এক অঙ্গ। বঙ্গ, পুণ্ড্র, আঙ্গ, সুহ্ম, সমতট ও হরিকেল প্রত্যেকটির ভূগোল, অর্থনীতি, ধর্ম ও সংস্কৃতি ভারতীয় উপমহাদেশের পূর্বাঞ্চলকে এক অনন্য ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ করেছে। এই রাজ্যগুলোই পরবর্তীতে পাল, সেন ও অন্যান্য মধ্যযুগীয় বাংলার রাজনৈতিক ভিত্তি তৈরি করে।
.jpg)

