বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ২০২৪ সালের আগস্ট মাস এক গুরুত্বপূর্ণ বাঁকবদলের মুহূর্ত। বহু মাস ধরে চলা ছাত্র আন্দোলন, কোটা বাতিলের দাবিতে দেশজুড়ে বিক্ষোভ, সরকারের দমনপীড়ন, ইন্টারনেট বন্ধ, কারফিউ এবং ‘শুট-অন-সাইট’ নির্দেশনার পর অবশেষে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতন ঘটে। তবে এই পতনের নেপথ্যে ছিল আরও একটি নাটকীয় ঘটনা—নতুন একটি গ্রন্থ “ইনশাল্লাহ বাংলাদেশ” দাবি করেছে যে সেদিন দুপুর ১টা ৩০ মিনিটে ভারতের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা শেখ হাসিনাকে সতর্ক করেছিলেন: “এখনই গণভবন ছাড়ুন, নইলে আপনার প্রাণ যাবে।” এই ফোনকলের পরই কয়েক ঘণ্টার মধ্যে হেলিকপ্টার ও পরে সামরিক বিমানে করে তাকে ভারত নিয়ে যাওয়া হয়—যা পুরো দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতিকে নাড়া দেয়।
কোটা আন্দোলন থেকে দেশব্যাপী গণঅসন্তোষ
২০২৪ সালের মাঝামাঝি থেকে বাংলাদেশে বেকারত্ব, অর্থনৈতিক চাপ, রাজনৈতিক দমন এবং সরকারি পক্ষপাতিত্বের বিরুদ্ধে ক্ষোভ ফুঁসছিল। কোটা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে ছাত্রদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলন কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই বিস্ফোরিত রূপ নেয়। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে রাজধানীর রাস্তায় আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। সরকারি সমর্থক গোষ্ঠী এবং নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে বহু শিক্ষার্থী আহত ও নিহত হয়।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সরকার একের পর এক কঠোর পদক্ষেপ নিতে শুরু করে—কারফিউ, ইন্টারনেট বন্ধ, মাঠে সেনা মোতায়েন, এমনকি ‘দেখামাত্র গুলি’ করার নির্দেশ পর্যন্ত। কিন্তু এসব দমনমূলক ব্যবস্থাই জনরোষ আরও বাড়িয়ে তোলে। জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহ থেকে আগস্টের শুরুতে আন্দোলন ছাত্রদের গণ্ডি ছাড়িয়ে পেশাজীবী, শ্রমিক, প্রবাসী প্রত্যাগত যুবক এবং মধ্যবিত্ত নগরবাসীদের বৃহৎ অ্যান্টি-অথোরিটারিয়ান জোটে পরিণত হয়।
সপ্তাহের পর সপ্তাহ সংঘর্ষে নিহতের সংখ্যা শতাধিক ছুঁয়ে গেলে জাতীয় ক্ষোভ তীব্র রূপ নেয়। দেশজুড়ে অবরোধ, ধর্মঘট, অবাধ্যতা ও গণমিছিলের ঢল শুরু হয়। ঢাকার দিকে ‘মার্চ’ ঘোষণা হলে গণভবনের চারপাশে নিরাপত্তা ভেঙে পড়তে থাকে এবং ক্ষমতার কেন্দ্রগুলোতে তীব্র চাপ তৈরি হয়।
৫ আগস্ট ২০২৪: পতন এবং পালানোর মুহূর্ত
৫ আগস্ট দুপুর নাগাদ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ে। নিরাপত্তা শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ে, প্রশাসন বিভক্ত হয়ে যায়, এবং সরকারের আদেশ কার্যকর করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। ঠিক এই সংকটময় মুহূর্তেই নতুন বইটিতে উল্লেখিত ঘটনাটি ঘটে—দুপুর ১টা ৩০ মিনিটে শেখ হাসিনা নাকি একটি ফোন পান ভারতের এক অত্যন্ত জ্যেষ্ঠ, বিশ্বাসযোগ্য কর্মকর্তার কাছ থেকে।
ফোনে তাকে বলা হয়, গণভবনে আর থাকা নিরাপদ নয়; “আপনি যদি এখনই না বের হন, আপনাকে হত্যা করা হবে।” আরও বলা হয়, “আজ না পালালে লড়ার সুযোগও আর পাবেন না। এখন বাঁচাটা জরুরি।”
দ্রুত সিদ্ধান্ত, দ্রুত অদৃশ্য হওয়া
গ্রন্থে বর্ণিত বিশদ সময়রেখা অনুযায়ী—
- ২:২৩ PM: গণভবন থেকে দ্রুত হেলিকপ্টারে তোলা হয়।
- ২:৩৫ PM: হেলিকপ্টারটি তেজগাঁও এয়ারবেসে অবতরণ করে।
- ২:৪২ PM: একটি সামরিক মালবাহী বিমান—সম্ভবত C-17 বা C-130—চাকা গুটিয়ে উড্ডয়ন করে।
- উড্ডয়নের ২০ মিনিটের মধ্যেই বিমানটি ভারতীয় আকাশসীমায় ঢুকে পড়ে।
- সন্ধ্যার দিকে তা দিল্লির নিকটবর্তী হিন্দন এয়ারবেসে অবতরণ করে, যেখানে ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা নিজেই তাকে গ্রহণ করেন।
যদিও ফোনকলকারীর পরিচয় বইটিতে উল্লেখ নেই, ২০২৪-২৫ সালের অসংখ্য রিপোর্ট নিশ্চিত করেছে—হাসিনা সেদিনই ভারতীয় সুরক্ষা বলয়ের অধীনে আশ্রয় পান এবং এখনও দিল্লিতেই নির্বাসনে আছেন। ভারত তাকে আশ্রয় দিয়েছে—এটি প্রকাশ্যে স্বীকারও করেছেন তিনি, বিভিন্ন মন্তব্যে ভারতের জনগণকে “জীবন বাঁচানোর জন্য গভীর কৃতজ্ঞতা” জানিয়েছেন।
ভারতের হস্তক্ষেপ: কেন দিল্লি হাসিনাকে বাঁচাল?
ভারতের এই সিদ্ধান্ত ছিল কেবল মানবিক নয়—এটি ছিল কৌশলগত হিসাবও। বাংলাদেশের রাস্তায় তীব্র সহিংসতা চলছিল; একজন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীকে যদি গণরোষে ক্ষতিগ্রস্ত করা হতো, তার মূল্যভার পড়ত পুরো অঞ্চলজুড়ে।
ভারতের তিনটি কৌশলগত লক্ষ্য ছিল—
-
সীমান্ত স্থিতিশীলতা: বাংলাদেশের অস্থিরতা ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও শিলিগুড়ি করিডোরকে ঝুঁকিতে ফেলতে পারত। হাসিনাকে নিরাপদে সরিয়ে নেওয়া পরিস্থিতি আরও খারাপ হওয়া থেকে রক্ষা করে।
-
অনুভূতিহীন ক্ষমতার শূন্যতা রোধ: হাসিনার উপর আক্রমণ বা মৃত্যুর ঘটনা দেশটিকে গৃহযুদ্ধের পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারত। ভারত সে ঝুঁকি নেয়নি।
-
রাজনৈতিক অ্যাক্সেস বজায় রাখা: আওয়ামী লীগ বহু বছর ভারতের ঘনিষ্ঠ মিত্র ছিল। হাসিনাকে আশ্রয় দিয়ে দিল্লি তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছে, অথচ নতুন অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে সম্পর্কও খারাপ হতে দেয়নি।
ধারণা করা হচ্ছে, ভারত চেয়েছিল—বাংলাদেশে যে-ই ক্ষমতায় আসুক, দিল্লির নিরাপত্তা স্বার্থ যেন বিঘ্নিত না হয় এবং একক রাজনৈতিক দলের উপর নির্ভরতা কমাতে বহুপাক্ষিক সংযোগ নিশ্চিত হয়।
আন্দোলনের ভেতরের গতিবিধি
ছাত্ররা প্রথমে কোটা ব্যবস্থার সংস্কার দাবি করলেও সরকারের অত্যধিক বলপ্রয়োগ আন্দোলনকে রূপান্তরিত করে। আন্দোলনের মূল স্লোগান হয়ে ওঠে—দমন, গুম, দুর্নীতি, একদলীয়করণ এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের জবাবদিহি।
বিশ্ববিদ্যালয়, পেশাজীবী সংগঠন, চিকিৎসক, আইনজীবী, শিক্ষক, বেসরকারি চাকরিজীবী, এমনকি প্রবাসী প্রত্যাগত তরুণেরাও আন্দোলনে যোগ দেয়। আগস্টের শুরুতে এটি হয়ে ওঠে সর্বাত্মক গণঅমান্যতা আন্দোলন, যা রাষ্ট্রযন্ত্রকে পঙ্গু করে দেয়।
সরকার পতনের পরও উত্তেজনা কমেনি। ২০২৫ জুড়ে মানবাধিকার লঙ্ঘনের তদন্ত, বিভিন্ন গোষ্ঠীর পুনর্মিলনী দাবি ও নতুন সংঘর্ষ পরিস্থিতিকে অস্থিতিশীল রাখে।
শেখ হাসিনা নির্বাসনে—ঢাকা–দিল্লির সম্পর্কের পরিবর্তন
হাসিনা দিল্লিতে অবস্থান নেওয়ার পর বাংলাদেশের নতুন অন্তর্বর্তী নেতৃত্ব কাঠামো ঢাকার পররাষ্ট্রনীতিকে খানিকটা পুনর্গঠন করে। তারা চেয়েছিল—আওয়ামী লীগ যুগ থেকে ভিন্ন এক কূটনৈতিক অবস্থান প্রদর্শন করতে। ফলে তাদের বক্তব্যে ভারতের প্রতি কিছুটা দূরত্ব ও শীতলতা আসে।
২০২৫ সালে ঢাকা–দিল্লির সম্পর্কের তিনটি বৈশিষ্ট্য দেখা যায়—
-
বাড়তি সন্দেহ ও সংবেদনশীলতা: বাংলাদেশের নতুন প্রশাসন প্রকাশ্যে বলেছে—তারা কোনও “চীন-নেতৃত্বাধীন ব্লকে” যোগ দিচ্ছে না। কিন্তু বাস্তবে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে পারস্পরিক সন্দেহ বাড়ে।
-
বাণিজ্য ও সীমান্ত ইস্যুতে টানাপোড়েন: সীমান্তে নজরদারি, অনুপ্রবেশ, রিভার্স মাইগ্রেশন, বাণিজ্য ভারসাম্যসহ বিভিন্ন ইস্যুতে অস্বস্তি দেখা দেয়।
-
নতুন বাস্তবতার মুখে ভারতের ‘হেজিং’ নীতি: দিল্লি এখন বাংলাদেশের রাজনীতিতে একক দল বা মুখের প্রতি নির্ভর না থেকে বহু স্তরে সম্পর্ক রেখেছে—অর্থনীতি, নিরাপত্তা, আঞ্চলিক সংযোগ—সব ক্ষেত্রেই আরও সাবধানী কৌশল নিচ্ছে।
বাংলাদেশের রাজনীতির একাংশ মনে করে—হাসিনাকে রক্ষা করা ভারতের অতিরিক্ত হস্তক্ষেপ; অন্যদিকে দিল্লি মনে করে—ওই সিদ্ধান্ত না নিলে বাংলাদেশ আরও অস্থিতিশীল হতো।
দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তর প্রেক্ষাপট
বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়া এবং বঙ্গোপসাগরের ভূকৌশলিক মানচিত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জন্য এটি এক ধরনের “ভূ-গেটওয়ে”; আবার চীনের জন্য এটি সমুদ্রপথে প্রবেশের সুযোগ। ফলে ঢাকা–দিল্লির টানাপোড়েন অঞ্চলীয় ভারসাম্যে প্রভাব ফেলে।
২০২৫ সালের আঞ্চলিক প্রভাব—
- ভারত এখনও প্রভাবশালী, ভৌগোলিক ও অর্থনৈতিক সুবিধার কারণে।
- কিন্তু রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও বহুপক্ষীয় কূটনৈতিক চাপ ভারতকে আরও সক্রিয় হতে বাধ্য করছে।
- বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি এখন ভারতের জন্য আরও জটিল—একক রাজনৈতিক দলের পরিবর্তে বহু stakeholder-কে সামলাতে হচ্ছে।
- হাসিনাকে ভারতীয় বিমানে গোপনে সরিয়ে আনার “বিশ্বাসযোগ্য বিবরণ” দীর্ঘদিন ধরে দক্ষিণ এশিয়ার জনমানসে ও রাজনৈতিক আলোচনায় থাকবে।
সমাপ্তি: নতুন বাস্তবতার মুখে ভারত–বাংলাদেশ
শেখ হাসিনার আকস্মিক পদত্যাগ ও ভারতের ত্বরিত উদ্ধার—এ দুই ঘটনাই ২০২৪-২৫ সালে দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতির গতিপথ নতুন করে লিখে দিয়েছে। বাংলাদেশ এখন নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতায় মানিয়ে নিচ্ছে; ভারতকে আরও সতর্ক কূটনীতি চালাতে হচ্ছে যাতে সীমান্ত নিরাপত্তা, জলসম্পদ, বাণিজ্য এবং আঞ্চলিক প্রভাব সংরক্ষিত থাকে।
ভারত যেমন বাংলাদেশের অর্থনীতি ও নিরাপত্তায় গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার, বাংলাদেশও ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও বঙ্গোপসাগরীয় কৌশলে সমানভাবে অপরিহার্য। তাই দুই দেশের সম্পর্ক সাময়িক শীতল হতে পারে, কিন্তু বিচ্ছিন্ন হওয়ার সুযোগ নেই।
শেখ হাসিনার “১:৩০ PM কল”—এটি শুধু এক রাজনৈতিক নেত্রীর জীবনরক্ষা নয়; এটি পুরো অঞ্চলের কূটনীতি, নিরাপত্তা ও ভূরাজনৈতিক ভারসাম্যের প্রতীক হয়ে থাকবে বহু বছর।
