ভূমিকা
‘Deep State’ — এই শব্দবন্ধ প্রথম একেবারেই কনস্পিরসি-থিওরি হিসেবে উঠেছিল, কিন্তু দিনের শেষে এটি রাজনৈতিক বিজ্ঞানে ও সাংগঠনিক বিশ্লেষণে একটি সঙ্কেত হয়ে দাঁড়িয়েছে। সাধারণভাবে বলতে হয়, একটি গণতান্ত্রিক রাজ্যে নির্বাচিত সরকার ও সংসদ থাকলেও, তাদের বলির বাইরে গিয়ে, স্বতন্ত্রভাবে কার্যরত এক গোপন বা অজ্ঞাত শাসন-সত্তা থাকতে পারে — যা সরকারি কাঠামোর বাইরে হলেও তার কার্যকারিতায় প্রভাব ফেলতে পারে।
বিশ্বের নানা দেশে এই ধারণাটি উঠেছে — যেমন তুরস্কে ‘Derin Devlet’ হিসেবে, ইজিপটে সামরিক ও গোয়েন্দা সত্তার কার্যকারিতা হিসেবে, আমেরিকায় বেসরকারিভাবে বলানো হয়েছে।
ভারতের প্রেক্ষাপটে এই ধারণা তুলনায় নতুন নয় — তবে এখানে এটি একটু ভিন্ন রূপ নিয়েছে। ভারতের ক্ষেত্রে এটা এক দিকে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তপ্রক্রিয়া, প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ ও গোপন শক্তি-কেন্দ্র নিয়ে আলোচনা তৈরি করেছে। এই ব্লগে আমরা প্রথমে ধারণাটির সারাংশ, তারপর ভারতের প্রেক্ষাপট, তারপর সম্ভাব্য প্রভাব ও সমালোচনা — সবগুলো নিয়ে আলোচনা করব।
‘Deep State’ কী?
সংজ্ঞা ও মূল উপাদান
মূলত, ‘Deep State’ বলতে এমন এক প্রতিষ্ঠান বা নেটওয়ার্ক বোঝানো হয় যা:
- আনুষ্ঠানিক বা প্রকাশ্যভাবে নির্বাচিত সরকারের নিয়ন্ত্রণে নয়, কিন্তু কার্যত গুরুত্বপূর্ণ নীতিনির্ধারণ বা প্রশাসনিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে।
- এটি সাধারণত সরকারের সাংবিধানিক কাঠামোর বাইরে বা তার অজান্তে (কিন্তু হয়তো অনুমোদিতভাবে) কাজ করে, নিজের লক্ষ্য ও এজেন্ডা বাস্তবায়ন করে।
- গোপনীয়তা, পারদর্শিতা কম হওয়া, দায়িত্বপ্রাপ্ত পর্যায়ে স্বচ্ছতার অভাব — এসবের সঙ্গে যুক্ত।
উদ্ভব ও ইতিহাস
- এই শব্দটি মূলত তুরস্কের ‘Derin Devlet’ থেকে এসেছে, যেখানে সামরিক, গোয়েন্দা ও অপরাধ-নেটওয়ার্কর সম্মিলনে একটি গোপন শক্তি হিসেবে কাজ করেছে।
- পরে ওয়েস্টার্ন দেশগুলোতে এটি একটি প্রচলিত ধারণা হয়ে উঠেছে — বিশেষ করে যখন সেনাবাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থা, করপোরেট-লবিং ইত্যাদি নির্বাচিত সরকারের বিরুদ্ধে বা সরকারের নিয়ন্ত্রণ বাইরে কাজ করেছে বলে ধাওয়া করা হয়।
বিশ্লেষণাত্মক দৃষ্টিকোণ
শিক্ষাবিদরা বলছেন — ‘Deep State’ ধারণাকে বিশ্লেষণ করার সময় দুইটি মূল প্রশ্ন দেখার কথা:
- এটি কি সত্যিই একটি সমান্তরাল সরকার বা শক্তি-কেন্দ্র যা নির্বাচিত সরকারের বাইরে কাজ করে?
- অথবা এটি কি শুধুই নির্বাচন পরবর্তী প্রশাসনিক স্থিতিশীলতা ও রাষ্ট্রীয় অনিয়মতার প্রতিচ্ছবি — অর্থাৎ সরকারি সিদ্ধান্ত-প্রক্রিয়া জটিল হলে সেটি ‘Deep State’ বলে ভুল বোঝা হয়?
এই কারণে ‘Deep State’ নিয়ে আলোচনা প্রায়ই বিতর্কিত: একটি দিকে রয়েছে সত্যিই এতগুলো প্রশাসনিক ও গোয়েন্দা-কাঠামোর অদৃশ্য কর্তৃত্ব-বৈশিষ্ট্য রয়েছে কি না; অন্য দিকে রয়েছে ভয়, সন্দেহ বা রাজনৈতিক আক্ষেপের ভাষ্য।
ভারতের প্রেক্ষাপট
উদাহরণ ও আলোচ্য বিষয়
ভারতে ‘Deep State’ ধারণাটি সাধারণভাবে আলোচনায় এসেছে কয়েকটি প্রসঙ্গে। উদাহরণস্বরূপ:
- গেট-আপ হিসেবে National Advisory Council (NAC) – ২০০৪-এর United Progressive Alliance সরকারের সময় প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের বাইরে একটি পরামর্শক সংস্থা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। বিরোধীরা বলেছিলেন, এটি একটি নির্বাচিত সরকারের বাইরের শক্তি-কেন্দ্র।
- Josy Joseph তাঁর বই The Silent Coup: A History of India’s Deep State (২০২১)-এ দাবি করেছেন: ভারতের নিরাপত্তা-সংস্থা, গোয়েন্দা প্রতিষ্ঠান, কর ও তদন্ত সংস্থা ইত্যাদি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার হচ্ছে।
- মিডিয়া-বিশ্লেষণ এবং রাজনৈতিক আলোচনায় বলা হয়েছে, পশ্চিমা মিডিয়া, বিদেশী নন-স্টেট অ্যাক্টর এবং ভারতীয় অভ্যন্তরীণ শক্তি-কেন্দ্র এক সঙ্গে মিলে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত প্রভাবিত করছে — যা একধরনের ‘Deep State’ কার্যকারিতার প্রতিচ্ছবি হতে পারে।
কারণ ও প্রেক্ষাপট
ভারতের জন্য কয়েকটি বিশেষ বিষয় এখানে চোখে পড়বে:
-
ভারতের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ব্যবস্থায় পারদর্শিতা ও স্বচ্ছতার ঘাটতি — অনেক সময় প্রশাসনিক ভারসাম্যান্তর, নির্বাচনের পর হেভি রিভিউ সংস্থা (investigative agencies)-র ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে।
-
বহুসংখ্যক গোয়েন্দা, তদন্ত ও বাজেটবহির্ভূত কার্যকারিতা সম্পন্ন সংস্থা রয়েছে — যেমন Research and Analysis Wing (R&AW) ইত্যাদি।
-
বিদেশী নেটওয়ার্ক, মাল্টি-ন্যাশনাল সংস্থা, মিডিয়া ও প্রযুক্তিগত প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে রাজনৈতিক প্রভাব প্রয়োগ করার চক্রান্ত — ভারতের বড় বাজার ও ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান থাকায়।
ধরন ও কার্যপ্রক্রিয়া
‘Deep State’-র কার্যক্রম ভারতের ক্ষেত্রে নিম্নলিখিত রূপ নিতে পারে বলে আলোচনায় রয়েছে:
- নির্বাচিত সরকারের নীতিকে প্রভাবিত করা — প্রশাসনিক বা গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে।
- গোপনে শক্তি-কেন্দ্র তৈরি করায়, যাদের কাছে রাজনৈতিক দায়িত্ব নেই কিন্তু যাদের কার্যকারিতা রয়েছে।
- বিদেশী সংস্থা, মিডিয়া ও নন-স্টেট অ্যাক্টর-এর সঙ্গে অভ্যন্তরীণ অংশীদারিত্ব — যাতে এক ধরনের শিক্ষাগত, অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক প্রভাব সৃষ্টি হয়।
- রাজনৈতিক বিরোধী বা সমালোচক গোষ্ঠীকে হেফাজতে নেওয়া বা চুপ করানো — নিরাপত্তা আইন, তথ্য সংস্থা, তদন্ত সংস্থা ইত্যাদি মাধ্যমে।
কার্যকারিতার প্রভাবে পর্যালোচনা
ইতিবাচক ও নেগেটিভ দিক
যদিও ‘Deep State’ ধারণাটি প্রায়শই নেতিবাচক অর্থে ব্যবহৃত হয় — কারণ এটি স্বচ্ছতা ও দায়বদ্ধতার মূলনীতিকে চ্যালেঞ্জ করে — তারপরও কিছু ক্ষেত্রে এটি কার্যকর রাষ্ট্রীয় স্থিতিশীলতা রক্ষার উপাদান হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ — দেখা গেছে, নিরাপত্তা-সংশ্লিষ্ট সিদ্ধান্ত দ্রুত ও গোপনভাবে নেওয়ার প্রয়োজন হলে নিবন্ধিত কাঠামোর বাইরে কিছু কার্যকারিতা দরকার হয়। তবে এসব ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা অত্যাবশ্যক।
নেতিবাচক দিকগুলো বেশি গুরুতর:
- নির্বাচিত সরকারের ওপর প্রশাসনিক সংস্থার হস্তক্ষেপ হলে গণতন্ত্র দুর্বল হয়।
- স্বচ্ছ পরিচালনায় বাধা পড়ে, কারণ গোপন সিদ্ধান্ত-প্রক্রিয়া কখনও কখনও আর নিয়মানুযায়ী নয়।
- রাজনৈতিক দ্বিধা ও অভিযোজনের সুযোগ সৃষ্টি হয় — যাদের দায়িত্ব নেই তাঁদের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত প্রভাবিত করার ক্ষমতা হয়।
- বিদেশী ও অন্তর্ভুক্ত নন-স্টেট অ্যাক্টর দ্বারা প্রভাব খেলার সুযোগ তৈরি হয় — এক দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার দৃষ্টিকোণ থেকে উদ্বেগ বাড়ে।
ভারতের ক্ষেত্রে উদাহরণ
উল্লেখযোগ্য কিছু ঘটনা আলোচনায় এসেছে — যেমন ২০২০-২১ সালের কৃষি আইন প্রণয়ে বিরোধ ও আন্দোলন, যেখানে আন্তর্জাতিক মিডিয়া ও বিদেশী ব্যক্তিত্বদের বক্তব্য, ‘টুলকিট’ বিতর্ক ইত্যাদি আলোচনায় আসে।
এছাড়া ভারতীয় নির্বাচনের সময় বিদেশী মিডিয়া-প্রভাব ও হস্তক্ষেপ-বিষয়েও চোখ দেওয়া হয়েছে।
সমস্যার মাপকাঠি
এই ধরনের প্রভাব বা কার্যকারিতাকে মাপার ক্ষেত্রে কয়েকটি চ্যালেঞ্জ রয়েছে:
- কতটা তথ্য-প্রমাণ রয়েছে যে প্রশাসনিক সংস্থা সরকার নয়, নিজের স্বতন্ত্র এজেন্ডায় কাজ করছে?
- কতটা বিষয় কনস্পিরসি, কতটা বিষয়ে বাস্তবতা — এ বিভাজন স্পষ্ট নয়।
- গণতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ ও স্বচ্ছতা বিধান করা হয়েছে কি না — নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার ঘাটতি থাকলে ‘Deep State’-র কার্যকারিতা বাড়ে।
- দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলো রাজনৈতিক অবস্থানের প্রতি নিরপেক্ষ কি না, তা গুরুত্বপূর্ণ।
সমালোচনা ও অন্যান্য দৃষ্টিকোণ
সমালোচকরা কি বলছেন?
- অনেক পণ্ডিত ‘Deep State’ ধারণাকে একটি বড় নেতিবাচক বর্ণনায় রূপ দিতে চান যা বাস্তবতা তুলনায় অতিশয় হয়ে দাঁড়ায়। যেমন অনেক প্রশাসনের কার্যকলাপ সবসময় গোপন বা ষড়যন্ত্রমূলক নয়।
- কোনো সংগঠন বা সংস্থা নির্বাচিত সরকারের বাইরে কাজ করলেই কি তা ‘Deep State’ বলে ধরা যায়? নাকি সেটি শুধু কার্যকর প্রশাসনের একটি অংশ? এই প্রশ্ন প্রশ্রয় পাচ্ছে।
- ‘Deep State’ ধারণার প্রচলন অনেক সময় রাজনৈতিক বিরোধিতার ভাষা হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে — অর্থাৎ নির্বাচিত সরকার বা বিরোধীদের দ্বারা এই শব্দ ব্যবহার হয়ে থাকতে পারে শক্তির মর্যাদা পালটানোর জন্য।
বিকল্প বিশ্লেষণ
- একভাবে বলা হয়, ‘Deep State’ বলতে আমরা হয়তো বলতে চাচ্ছি একটি অ-নিয়ন্ত্রিত প্রশাসনিক-সংস্থা বা স্থিতিশীলতা রক্ষাকারী শক্তি যার উদ্দেশ্য রাষ্ট্রীয় ক্রিয়া–প্রতিক্রিয়া রক্ষার।
- অন্যভাবে — এটি দেখা যেতে পারে একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্তপ্রক্রিয়ার ফল: অর্থাৎ নির্বাচিত সরকারের সিদ্ধান্ত খুব দ্রুত বা practical হলে প্রশাসন/বিবারক সংস্থা প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে, যা তুলনায় ‘Deep State’-র উপস্থাপন।
- আবার, প্রযুক্তি, সামাজিক মিডিয়া ও তথ্যপ্রবাহের যুগে ‘গোপন’ শক্তি বা নেটওয়ার্কের ধারণা কেন্দ্রীয় হয়ে উঠেছে — তাই ‘Deep State’-র আলোচনা বাড়ছে।
ভবিষ্যতের জন্য ভাবনা ও উপসংহার
কী করা যেতে পারে?
- প্রথমত, প্রশাসনিক ও গোয়েন্দা সংস্থার কার্যক্রমের স্বচ্ছতা বাড়াতে হবে — দায়িত্বশীলতা ও লাইভ পর্যালোচনার ব্যবস্থা রাখতে হবে।
- নির্বাচিত সরকারের সিদ্ধান্ত-প্রক্রিয়া ও প্রশাসনিক শক্তিরবিভাজন (checks & balances) সুদৃঢ় করতে হবে।
- বিদেশী ও নন-স্টেট অ্যাক্টরদের প্রভাব যাচাই ও নিয়ন্ত্রণে আইন ও নিয়মের পরিপক্কতা নিশ্চিত করতে হবে।
- সাধারণ জনগণ ও মিডিয়াকে সচেতন থাকতে হবে — কোনও অভিযোগ শুনলে তার পিছে প্রমাণ-ভিত্তিক বিশ্লেষণ খুঁজুন, ও সাধারণকরণ এড়িয়ে চলুন।
উপসংহার
ভারতের মতো গভীর রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক জটিলতার দেশে ‘Deep State’ ধারণার আলোচনা শুধু দৃষ্টিনন্দন নয় — এটি একটি সক্রিয় সচেতনতামূলক বিষয়। যদিও নিশ্চিতভাবে বলা যাবে না যে এখানে একটি পূর্ণাঙ্গ ‘Deep State’ রয়েছে, এবং তারা কার হয়ে কাজ করছে — তবে সন্দেহ, প্রতিক্রিয়া ও রাজনৈতিক-প্রশাসনিক তাড়নায় গ্রহনযোগ্য সন্দেহের ঘর রয়েছে।
এই ব্লগের উদ্দেশ্য ছিল বিষয়টি সংক্ষেপে উপস্থাপন করা — ভুল বা অপূর্ণতা থাকতে পারে। আপনি চাইলে আগামি সময় আমাদের দেশের নির্দিষ্ট ঘটনা বা সংস্থার আলোচনায় ‘Deep State’ নিরীক্ষণ করতে পারেন।
বিদ্যুৎ চুক্তি, রাজনৈতিক উপনেতা ও বাতিল-বিবাদী বিপর্যয়: আদানির বড় ধাঁধা