মোদি–ম্যাক্রোঁ ফোনালাপ: BRICS সভাপতিত্বে ভারতের শক্তি ও মার্কিন ব্যঙ্গ

২১শে আগস্ট ২০২৫, বৃহস্পতিবার। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ এক গুরুত্বপূর্ণ টেলিফোন আলাপচারিতায় বসেন। কাগজে-কলমে এটি ছিল একটি কূটনৈতিক সৌজন্য সাক্ষাৎ, কিন্তু এর ভেতরে লুকিয়ে ছিল এক বহুমাত্রিক বার্তা—বিশ্ব রাজনীতির কেন্দ্র আজ আর কেবল ওয়াশিংটনে সীমাবদ্ধ নয়।

মোদি ম্যাক্রোঁ ফোনালাপ ও ভারতের BRICS সভাপতিত্বে ফ্রান্সের সমর্থন

ম্যাক্রোঁ ফোনের পর টুইট করে স্পষ্টভাবে স্বীকার করেছেন যে, ফ্রান্স ভারতের আসন্ন ব্রিকস সভাপতিত্বকে গুরুত্ব দেবে এবং ২০২৬ সালের জন্য দুই দেশ একসাথে কাজ করবে। পশ্চিমা কোনো নেতা প্রকাশ্যে ব্রিকসকে এমনভাবে স্বীকৃতি দিয়েছেন—এটি কম তাৎপর্যের বিষয় নয়। আর এখানেই ব্যঙ্গের জায়গা তৈরি হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য, যারা দীর্ঘদিন ধরে মনে করে এসেছে, তারাই নাকি বিশ্বের একমাত্র ক্ষমতার কেন্দ্র।


আলোচনার মূল দিক

ফোনালাপে মোদি ও ম্যাক্রোঁ কয়েকটি বড় বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন:

  1. সংঘাত নিরসন:
    ইউক্রেন যুদ্ধ ও পশ্চিম এশিয়ার (বিশেষত গাজা) অস্থিরতা নিয়ে উভয়ে মতবিনিময় করেন। ম্যাক্রোঁ জানান, তিনি সম্প্রতি ওয়াশিংটনে ইউরোপ ও মার্কিন নেতাদের সঙ্গে যে বৈঠক করেছেন, সেখানকার অভিজ্ঞতা তিনি মোদিকে শেয়ার করেছেন।

    • ভারত শান্তির পক্ষে, এ কথা নতুন কিছু নয়।
    • কিন্তু ফ্রান্স যে মার্কিন “অস্ত্র বিক্রয়-নির্ভর সমাধান”-এর বাইরে ভিন্ন কণ্ঠ খুঁজছে, সেটিই আসল নাটক।
  2. দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক:
    ভারত–ফ্রান্স কৌশলগত অংশীদারিত্ব বহুদিনের। প্রতিরক্ষা, পারমাণবিক জ্বালানি, প্রযুক্তি ও বাণিজ্যে দুই দেশের সম্পর্ক ক্রমেই ঘনিষ্ঠ হয়েছে। এবার সিদ্ধান্ত হয়েছে ২০২৬ সালকে “Year of Innovation” ঘোষণা করার।

    • মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রাচীন প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো যখন মনোপলি ধরে রাখতে হাপাচ্ছে, ভারত–ফ্রান্স তখন যৌথভাবে নতুন উদ্ভাবনের পথ খুঁজছে।
  3. বহুপাক্ষিক সমন্বয়:
    সবচেয়ে আলোচিত অংশটি হলো—ফ্রান্সের জি৭ সভাপতিত্ব (২০২৬) এবং ভারতের ব্রিকস সভাপতিত্ব (২০২৬) উপলক্ষে একসাথে কাজ করার অঙ্গীকার।

    • একদল বলে, জি৭ হলো উন্নত অর্থনীতির ক্লাব।
    • অন্যদিকে, ব্রিকস হলো উদীয়মান শক্তিগুলোর বিকল্প ফোরাম।
    • ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট যখন বলেন যে দুই পক্ষ মিলে সমন্বয় করবে, তখন এটি কার্যত মার্কিন “আমরাই সবকিছুর কেন্দ্র” ধারণার প্রতি এক ব্যঙ্গাত্মক চপেটাঘাত।

ম্যাক্রোঁর টুইট: বার্তার ভেতরে বার্তা

ফোনালাপের পর ম্যাক্রোঁর টুইট শুধু সৌজন্যমূলক বার্তা ছিল না। তিনি স্পষ্টভাবে লিখলেন—
“জি৭ (২০২৬) এবং ব্রিকস (২০২৬) সভাপতিত্বের প্রেক্ষিতে আমরা একসাথে কাজ করব।”

এখানে দুইটি বিষয় স্পষ্ট:

  1. ব্রিকসকে বৈধতা দেওয়া
    পশ্চিমা মিডিয়া বহুদিন ধরে ব্রিকসকে হেয় করার চেষ্টা করেছে। বলেছে, এটি নাকি শুধু চীনের কূটনৈতিক খেলা। অথচ আজ ফ্রান্স স্বীকার করছে—ভারতের সভাপতিত্বে ব্রিকসের গুরুত্ব বাড়ছে।

  2. মার্কিন একাধিপত্যকে অস্বীকার
    ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট প্রকাশ্যে স্বীকার করছেন যে, বিশ্ব রাজনীতির কেন্দ্র শুধু ওয়াশিংটন বা ব্রাসেলস নয়। দিল্লি, ব্রাজিলিয়া, প্রিটোরিয়া বা মস্কোও সমান গুরুত্বপূর্ণ।
    এ যেন “আমেরিকা ফার্স্ট”–এর বিপরীতে “বিশ্ব ফার্স্ট” বার্তা।


মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বার্তা 
ফ্রান্স বনাম মার্কিন কূটনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি

ম্যাক্রোঁ–মোদি ফোনালাপ যে কেবল কূটনৈতিক সৌজন্য নয়, তা বুঝতে মার্কিনিদের খুব একটা কষ্ট হওয়ার কথা নয়। কিন্তু সমস্যা হলো—ওয়াশিংটনের রাজনৈতিক এলিটরা এখনও নিজেদেরকে ১৯৯০-এর দশকের “একক সুপারপাওয়ার” ভাবনায় আটকে রেখেছে।

১. মার্কিন অহঙ্কারের ধাক্কা

  • যুক্তরাষ্ট্র মনে করে, জি৭-ই সবকিছু।
  • অথচ ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট বলছেন, ব্রিকস সভাপতিত্বের সাথেও সমন্বয় জরুরি।
  • এ যেন মার্কিন অহঙ্কারের মুখে কষে দেওয়া এক বিদ্রূপাত্মক চপেটাঘাত।

২. পশ্চিমা ক্লাবের ভিতরে ভাঙন

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চাইবে না, তার মিত্ররা ব্রিকস বা গ্লোবাল সাউথ–এর সাথে খোলামেলা সহযোগিতার কথা প্রকাশ্যে স্বীকার করুক। কিন্তু ম্যাক্রোঁ করছেন। কেন?

  • কারণ তিনি জানেন, ভবিষ্যৎ শক্তি ভারসাম্য এশিয়া–আফ্রিকায় তৈরি হচ্ছে।
  • মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যতই অবরোধ, শুল্ক বা নিষেধাজ্ঞার খেলায় মেতে উঠুক, বাস্তবতা হলো গ্লোবাল সাউথ এখন নিজের কণ্ঠ তুলছে।

৩. কূটনীতির থিয়েটারে মার্কিন বিচ্ছিন্নতা

ওয়াশিংটন ইউক্রেন–রাশিয়া যুদ্ধ থামাতে পারেনি।
গাজা সংকটে কার্যকর সমাধান আনতে পারেনি।
মধ্যপ্রাচ্যে তার উপস্থিতি মানে কেবল অস্ত্র বিক্রি আর তেল দখলের রাজনীতি।
এমন প্রেক্ষাপটে ম্যাক্রোঁর মতো মিত্ররাও বিকল্প শক্তির সাথে হাত মেলাচ্ছে।


কেন ভারতের ব্রিকস সভাপতিত্ব মার্কিনদের অস্বস্তির কারণ?

২০২৬ সালে ভারত ব্রিকস-এর সভাপতিত্ব নেবে। এর মানে হলো—

  • ভারত নির্ধারণ করবে এজেন্ডা।
  • ভারত গ্লোবাল সাউথের মুখপাত্র হয়ে উঠবে।
  • ভারত পশ্চিমা দেশগুলোর জন্য কূটনৈতিক পাল্টা ভারসাম্য তৈরি করবে।

এবং ফ্রান্স যদি প্রকাশ্যে ভারতের সাথে সমন্বয়ের কথা বলে, তবে এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে স্পষ্ট বার্তা:
“আপনারা আর একা শো চালাচ্ছেন না। মঞ্চে নতুন অভিনেতা এসেছে।”


ফ্রান্সের কূটনৈতিক প্রাগম্যাটিজম বনাম মার্কিন কঠোরতা

ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট বারবার দেখিয়েছেন যে তিনি “কেবল পশ্চিমা শিবিরের প্রতিনিধি” হয়ে থাকতে চান না।

  • তিনি একসময় ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলনে অতিথি হওয়ার ইচ্ছাও প্রকাশ করেছিলেন।
  • তিনি আফ্রিকায় মার্কিন মডেল চাপিয়ে না দিয়ে নতুনভাবে সম্পর্ক সাজাতে চান।
  • আর এবার তিনি ভারতের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়াচ্ছেন।

অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কূটনীতি আজও “আমরা বনাম ওরা” মানসিকতায় আটকে আছে।

  • যে দেশ তাদের নির্দেশ মেনে চলে না, তাকে নিষেধাজ্ঞা।
  • যে ব্লক তাদের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে, তাকে দুর্বল করার প্রচেষ্টা।
  • যে নেতা স্বাধীন কণ্ঠ তোলে, তাকে মিডিয়ায় অপবাদ।

 যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান অবস্থা

চলুন, একটু রসিক ভঙ্গিতে দেখি আজকের আমেরিকার কূটনৈতিক দশা—

  1. ইউক্রেনে ট্রিলিয়ন ডলার ঢালছে, ফলাফল?
    যুদ্ধ থামেনি, বরং দীর্ঘস্থায়ী হয়েছে।
    রাশিয়া এখনও টিকে আছে।
    ইউক্রেনের অর্থনীতি ভেঙে পড়ছে।

  2. মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি আনার প্রতিশ্রুতি, বাস্তবে?
    গাজায় বোমা থামেনি।
    ফিলিস্তিনি শিশুদের মৃত্যু সংখ্যা বাড়ছে।
    আমেরিকার কণ্ঠস্বর কেবল অস্ত্র প্রস্তুতকারক কোম্পানির পক্ষে শোনা যায়।

  3. বাণিজ্য যুদ্ধে চীনকে হারানোর চেষ্টা, ফলাফল?
    আমেরিকার ভোক্তারা আজ বেশি দাম দিয়ে পণ্য কিনছে।
    চীন meanwhile গ্লোবাল সাপ্লাই চেইনে নিজের জায়গা আরও মজবুত করেছে।

  4. গ্লোবাল সাউথকে অবহেলা, অথচ?
    আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা, এশিয়া আজ ব্রিকস ও অন্যান্য প্ল্যাটফর্মে এক হচ্ছে।
    আমেরিকার পুরনো “মাস্টার–সার্ভেন্ট” সম্পর্ক ভেঙে যাচ্ছে।

এ যেন “সম্রাটের কাপড় নেই”—সবাই দেখছে, শুধু সম্রাট নিজেই বুঝতে চাইছে না।


উপসংহার

মোদি–ম্যাক্রোঁর ফোনালাপ তাই নিছক এক কূটনৈতিক সৌজন্য নয়। এটি বহুমাত্রিক বার্তা—

  • ভারত ব্রিকস সভাপতিত্বে নতুন নেতৃত্ব দেখাবে।
  • ফ্রান্স কেবল জি৭-এর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না।
  • আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বুঝুক বা না-ই বুঝুক, বিশ্ব আজ বহু-মেরুকেন্দ্রিক।

এখনও যদি আমেরিকা ভাবে যে ওয়াশিংটন ডিসি-ই পৃথিবীর কেন্দ্র, তবে সেটি হবে ২১শ শতকের সবচেয়ে বড় কৌতুক। আর তাই বলা যায়—
ম্যাক্রোঁর এক টুইট আসলে মার্কিন অহঙ্কারের বিরুদ্ধে এক ব্যঙ্গচিত্র, যার ক্যাপশন লেখা আছে স্পষ্ট বাংলায়: “বিশ্ব আর তোমার খেলনা নয়।”

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

যদি আপনার কোনও বিষয়ে ডাউট থাকে বা কোনও বিষয় suggest করতে চান তাহলে মেল করুন!

নবীনতর পূর্বতন

banglafacts 4