অগ্নি-V ক্ষেপণাস্ত্র: ভারতের কৌশলগত প্রতিরক্ষার নতুন অধ্যায় (২০২৫ টেস্ট)


ভারতীয় প্রতিরক্ষা গবেষণা ও উন্নয়ন সংস্থা (DRDO) ভারতের প্রতিরক্ষা সক্ষমতা ও প্রযুক্তিগত অগ্রগতির ক্ষেত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক অর্জন করেছে অগ্নি-V ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করে। এটি শুধু একটি অস্ত্র নয়, বরং ভারতের কৌশলগত প্রতিরক্ষা ও পারমাণবিক প্রতিরোধ ক্ষমতার প্রতীক।

Agni-V missile test India 2025 with MIRV technology

সাম্প্রতিক সাফল্য: ২০২৫ সালের পরীক্ষা

২০২৫ সালের ২০ আগস্ট, ভারতের ওডিশার চাঁদিপুর উপকূলে অবস্থিত Integrated Test Range (ITR) থেকে অগ্নি-V ক্ষেপণাস্ত্রের সফল উৎক্ষেপণ সম্পন্ন হয়। কৌশলগত বাহিনী কমান্ডের (Strategic Forces Command) অধীনে পরিচালিত এই পরীক্ষা ক্ষেপণাস্ত্রটির কার্যক্ষমতা, নির্ভুলতা এবং প্রস্তুতি প্রমাণ করে।
পরীক্ষায় প্রমাণিত হয়েছে যে অগ্নি-V এখন কার্যত ভারতীয় প্রতিরক্ষার জন্য পূর্ণমাত্রায় প্রস্তুত এবং তাৎক্ষণিক মোতায়েনযোগ্য।


অগ্নি-V এর বৈশিষ্ট্য ও প্রযুক্তিগত সক্ষমতা

ক্ষেপণাস্ত্রের ধরন ও জ্বালানি ব্যবস্থা

অগ্নি-V একটি তিন ধাপবিশিষ্ট কঠিন জ্বালানিচালিত ক্ষেপণাস্ত্র। এটি মধ্যম পাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র (IRBM) হিসেবে পরিচিত হলেও এর পাল্লা প্রযুক্তিগতভাবে একে আন্তঃমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র (ICBM) পর্যায়ে নিয়ে যায়।

পাল্লা ও লক্ষ্যভেদ ক্ষমতা

অগ্নি-V এর ঘোষিত পাল্লা ৫,০০০ কিলোমিটার হলেও বাস্তবে এটি ৭,০০০–৮,০০০ কিমি পর্যন্ত আঘাত হানতে সক্ষম (হালকা ওয়ারহেড বহন করলে)। এর ফলে ভারত এশিয়ার অধিকাংশ অঞ্চল, বিশেষত চীন, মধ্য এশিয়া, এমনকি ইউরোপের কিছু অংশকেও লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করতে পারে।

পেলোড ক্ষমতা

ক্ষেপণাস্ত্রটি সর্বোচ্চ ১.৫ টন ওজনের পারমাণবিক ওয়ারহেড বহন করতে পারে। এর ফলে একে ভারতের পারমাণবিক প্রতিরক্ষা কাঠামোর অন্যতম প্রধান স্তম্ভ হিসেবে ধরা হয়।

MIRV প্রযুক্তি

অগ্নি-V এর সবচেয়ে বড় অগ্রগতি হলো MIRV (Multiple Independently Targetable Re-entry Vehicle) প্রযুক্তি।

  • ২০২৪ সালের মার্চ মাসে ভারত সফলভাবে অগ্নি-V কে MIRV প্রযুক্তিসহ পরীক্ষা করে।
  • এর ফলে একটি মাত্র ক্ষেপণাস্ত্র থেকে একাধিক ওয়ারহেড উৎক্ষেপণ সম্ভব হয়।
  • প্রতিটি ওয়ারহেড আলাদা আলাদা লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করতে সক্ষম।

👉 এই প্রযুক্তি ভারতকে আরও শক্তিশালী করে তুলেছে, কারণ এতে শত্রু দেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা (যেমন চীনের anti-missile shield) অকার্যকর হয়ে পড়ে।

লঞ্চ সিস্টেম

অগ্নি-V একটি ক্যানিস্টারাইজড ক্ষেপণাস্ত্র। অর্থাৎ এটি বায়ুরোধী ক্যানিস্টারে রাখা হয় এবং ট্রাক বা সড়ক-ভিত্তিক মোবাইল প্ল্যাটফর্ম থেকে তাৎক্ষণিকভাবে উৎক্ষেপণ করা যায়।
এটি ভারতের ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন ক্ষমতায় এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে—

  • দ্রুত পরিবহনযোগ্য
  • গোপন স্থানে মোতায়েন সম্ভব
  • তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া দেওয়ার ক্ষমতা বৃদ্ধি

নেভিগেশন ও নির্দেশনা ব্যবস্থা

অগ্নি-V তে ব্যবহার করা হয়েছে Ring Laser Gyroscope ভিত্তিক Inertial Navigation System (RLG-INS), যা অত্যন্ত নির্ভুলভাবে ক্ষেপণাস্ত্রকে লক্ষ্যবস্তুতে পৌঁছে দেয়।


ভারতের প্রতিরক্ষা নীতি ও Credible Minimum Deterrence

ভারতের পরমাণু নীতি বরাবরই "Credible Minimum Deterrence" এর ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। এর মূল বক্তব্য হলো—

  • ভারত প্রথমে পারমাণবিক হামলা করবে না (No First Use Policy)।
  • তবে ভারতের ওপর যদি পারমাণবিক বা ব্যাপক ধ্বংসাত্মক হামলা হয়, তবে ভারত প্রতিশোধ নেবে।

অগ্নি-V এই নীতিকে বাস্তবায়ন করার জন্য অপরিহার্য। এর মাধ্যমে ভারত প্রমাণ করছে যে যে কোনো হুমকির মোকাবিলা করার মতো যথেষ্ট প্রতিরোধ ক্ষমতা তার রয়েছে।


চীন ও পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়া

পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়া

  • পাকিস্তান সবসময় ভারতের ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচিকে তাদের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হিসেবে দেখে।
  • পাকিস্তান এখনো পর্যন্ত MIRV প্রযুক্তি বা ICBM শ্রেণির ক্ষেপণাস্ত্রে ভারতীয় অগ্রগতির সমকক্ষ হতে পারেনি।
  • ফলে অগ্নি-V এর পরীক্ষা পাকিস্তানের ওপর মনস্তাত্ত্বিক ও কৌশলগত চাপ তৈরি করেছে।

চীনের প্রতিক্রিয়া

  • অগ্নি-V মূলত চীনকে লক্ষ্য করে তৈরি বলেই বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
  • উত্তর চীনের শহরগুলো ও কৌশলগত সামরিক ঘাঁটিগুলো এখন ভারতের পাল্লার মধ্যে পড়েছে।
  • চীন নিজেও শক্তিশালী ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি চালাচ্ছে, তবে ভারতের MIRV সক্ষমতা চীনকেও নতুন করে হিসাব কষতে বাধ্য করছে।

আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ভারতের অবস্থান

ভারতের অগ্নি-V পরীক্ষা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা বহন করছে—

  1. ভারত এখন আর শুধু দক্ষিণ এশিয়ার শক্তি নয়, বরং একটি উদীয়মান বৈশ্বিক শক্তি
  2. ভারতের কৌশলগত সক্ষমতা তাকে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন প্রভৃতি শক্তিধর দেশের সমতুল্য কূটনৈতিক অবস্থানে নিয়ে যাচ্ছে।
  3. ভারতীয় ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি ভারতের স্বনির্ভর প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি উন্নয়নের প্রতিফলন।
  4. পশ্চিমা দেশগুলো ভারতের এই সাফল্যকে আংশিকভাবে সমর্থন করে, কারণ এটি চীনের প্রভাবকে নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে।

ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা

ভারত ভবিষ্যতে অগ্নি সিরিজের আরও উন্নত সংস্করণ তৈরি করতে পারে।

  • Agni-VI: ধারণা করা হচ্ছে এটি আরও বেশি পাল্লার হবে (৮,০০০–১০,০০০ কিমি), এবং এতে উন্নত MIRV প্রযুক্তি ব্যবহৃত হতে পারে।
  • Hypersonic প্রযুক্তি: ভারত হাইপারসনিক গ্লাইড ভেহিকল উন্নয়নের দিকেও কাজ করছে, যা অগ্নি ক্ষেপণাস্ত্র পরিবারের সঙ্গে যুক্ত হতে পারে।

উপসংহার

অগ্নি-V কেবল একটি ক্ষেপণাস্ত্র নয়—এটি ভারতের বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি, প্রযুক্তিগত দক্ষতা এবং কৌশলগত পরিকল্পনার প্রতিফলন। এর সফলতা প্রমাণ করে যে ভারত এখন বৈশ্বিক শক্তির সমীকরণে নিজের জায়গা দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম।

যে পরিস্থিতিতে চীন ও পাকিস্তান ভারতের নিরাপত্তার জন্য চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে, সেই প্রেক্ষাপটে অগ্নি-V ভারতের প্রতিরোধ শক্তিকে বহুগুণ বাড়িয়ে তুলেছে। এটি ভারতের জন্য এক নিরাপদ ঢাল, আবার একই সঙ্গে এক শক্তিশালী বার্তা—ভারত শান্তি চায়, কিন্তু প্রয়োজনে শক্তি প্রয়োগেও সক্ষম।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

যদি আপনার কোনও বিষয়ে ডাউট থাকে বা কোনও বিষয় suggest করতে চান তাহলে মেল করুন!

নবীনতর পূর্বতন

banglafacts 4