ভূমিকা
বিশ্ব বাণিজ্যের বর্তমান প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্রের সুরক্ষাবাদী (Protectionist) নীতি নতুন করে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে। বিশেষত ২০২৫ সালের মে মাসে সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প কর্তৃক ভারতের ওপর আরোপিত নতুন শুল্ক নীতি শুধু দুই দেশের অর্থনৈতিক সম্পর্কেই নয়, বরং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ভবিষ্যত দিকনির্দেশক হিসেবেও দেখা হচ্ছে।
এই প্রেক্ষাপটে জার্মানির প্রকাশ্য সমর্থন ভারতের জন্য কেবল অর্থনৈতিক নয়, কূটনৈতিক দিক থেকেও অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্যতম প্রধান শক্তি হিসেবে জার্মানি সবসময় মুক্ত বাণিজ্যের (Free Trade) প্রবল সমর্থক, এবং মার্কিন শুল্কনীতির বিরুদ্ধে তাদের অবস্থান একটি বড় ভূরাজনৈতিক বার্তা বহন করছে।
ট্রাম্প প্রশাসনের ভারতের ওপর শুল্ক নীতি
২০২৫ সালের মে মাসে যুক্তরাষ্ট্র ভারতীয় পণ্যের ওপর অতিরিক্ত শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেয়। এর ফলে কিছু পণ্যে শুল্কহার বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ৫০% পর্যন্ত।
যুক্তরাষ্ট্রের যুক্তি
মার্কিন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় (Department of Homeland Security) জানায়, এই শুল্ক আরোপ সরাসরি রাশিয়ার বিরুদ্ধে প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপের অংশ। যুক্তরাষ্ট্রের মতে—
- ভারত রাশিয়া থেকে ক্রমাগত অপরিশোধিত তেল (Russian Crude Oil) কিনে যাচ্ছে।
- এর ফলে রাশিয়ার অর্থনীতি শক্তিশালী হচ্ছে, যা যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্য হুমকি।
অতএব, ভারতের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে যুক্তরাষ্ট্র অতিরিক্ত শুল্ককে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে।
জার্মানির প্রতিক্রিয়া ও অবস্থান
জার্মানির সমালোচনা
শুল্ক আরোপের কয়েকদিনের মধ্যেই জার্মানির ভারতের ডেপুটি এনভয় জর্জ এঞ্জভেইলার (Georg Enzweiler) প্রকাশ্যে মার্কিন নীতির সমালোচনা করেন। তিনি একে “বাণিজ্যের মুক্ত প্রবাহের পথে বাধা” বলে আখ্যায়িত করেন।
তার বক্তব্য অনুযায়ী—
- জার্মানি সর্বদা শুল্ক কমিয়ে ন্যূনতম পর্যায়ে নামিয়ে আনার পক্ষে।
- মুক্ত বাণিজ্যই বিশ্ব অর্থনীতিকে এগিয়ে নিতে পারে।
- যুক্তরাষ্ট্রের একতরফা পদক্ষেপ বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সহযোগিতার জন্য ক্ষতিকর।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের ভূমিকা
ইউরোপীয় ইউনিয়ন দীর্ঘদিন ধরে মাল্টিল্যাটারালিজম তথা বহুপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তির পক্ষে। যুক্তরাষ্ট্র যখন “আমেরিকা ফার্স্ট” নীতি গ্রহণ করছে, তখন ইইউ দেশগুলো একসঙ্গে থেকে শুল্কবিরোধী অবস্থান জোরালো করছে। জার্মানির ভারতের প্রতি সমর্থন তাই শুধু দ্বিপাক্ষিক নয়, বরং ইইউ-ভারত সম্পর্ককেও নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাচ্ছে।
ভারতের প্রতিক্রিয়া ও কৌশল
ভারত সরকার যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক আরোপকে অন্যায্য ও অযৌক্তিক বলে অভিহিত করেছে।
ভারতের অবস্থান
- জাতীয় স্বার্থ আগে – ভারতের বাণিজ্য ও জ্বালানি নীতি সম্পূর্ণরূপে তাদের নিজস্ব জাতীয় স্বার্থ দ্বারা পরিচালিত হবে।
- রাশিয়ান তেল আমদানি অব্যাহত – রাশিয়া থেকে অপরিশোধিত তেল কেনা ভারতের জন্য অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক এবং জ্বালানি নিরাপত্তার জন্য অপরিহার্য।
- অর্থনৈতিক সংস্কার – শুল্কযুদ্ধের চাপ মোকাবিলায় ভারত দ্রুত অর্থনৈতিক সংস্কার ও নীতি পরিবর্তন করছে।
- বাণিজ্য বৈচিত্র্যকরণ – যুক্তরাষ্ট্রের বাজারের ওপর নির্ভরতা কমাতে ভারত অন্যান্য দেশ, বিশেষ করে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার সঙ্গে বাণিজ্য সম্প্রসারণে জোর দিচ্ছে।
ভারতের শক্তি
ভারতের ম্যাক্রোইকোনমিক স্থিতিশীলতা এবং ভোক্তা-নির্ভর অর্থনীতি এই সংকটে তাকে শক্ত অবস্থানে রেখেছে। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের চাপ সত্ত্বেও ভারত তার অবস্থান পরিবর্তন না করে বরং বিকল্প সুযোগ খুঁজছে।
জার্মানি-ভারত সহযোগিতার সম্ভাবনা
বাণিজ্যিক সুবিধা
- জার্মানি ভারতের অন্যতম বড় বাণিজ্য অংশীদার।
- শিল্প, প্রযুক্তি, সবুজ জ্বালানি এবং অবকাঠামো উন্নয়নে দুই দেশ ইতিমধ্যেই সহযোগিতা করছে।
- যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কনীতির ফলে ভারত তার রপ্তানি বাজারের জন্য জার্মানি ও ইইউকে আরও বেশি গুরুত্ব দিতে পারে।
ভূরাজনৈতিক সুবিধা
- যুক্তরাষ্ট্রের একতরফা নীতির বিপরীতে ভারত-জার্মানি ঘনিষ্ঠতা বিশ্ব রাজনীতিতে নতুন শক্তির ভারসাম্য তৈরি করতে পারে।
- ইইউ-ভারত সহযোগিতা এশিয়া-ইউরোপ বাণিজ্য রুটে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারে।
বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট ও বড় চিত্র
সুরক্ষাবাদ বনাম মুক্ত বাণিজ্য
আজকের বিশ্ব বাণিজ্যে দুই ধরনের প্রবণতা দেখা যাচ্ছে—
- সুরক্ষাবাদী নীতি (যেমন: ট্রাম্পের শুল্কনীতি), যা এক দেশের স্বার্থকে প্রাধান্য দেয়।
- মুক্ত বাণিজ্যের নীতি (যেমন: জার্মানির সমর্থন), যা বহুপাক্ষিক সহযোগিতাকে এগিয়ে নিয়ে যায়।
মাল্টিপোলার বিশ্ব অর্থনীতি
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই সংঘাত কেবল অর্থনৈতিক নয়, বরং ভূরাজনৈতিক এক পরিবর্তনের পূর্বাভাস।
- যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব কমছে।
- ইউরোপ, ভারত, চীন, রাশিয়া—এরা মিলিতভাবে একটি বহুমুখী (Multipolar) বিশ্ব অর্থনীতি গড়ে তুলছে।
- জার্মানি-ভারত সহযোগিতা এই প্রক্রিয়াকে আরও শক্তিশালী করছে।
ভবিষ্যতের সম্ভাব্য দৃশ্যপট
- ভারত-ইইউ মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (FTA) আরও দ্রুত বাস্তবায়িত হতে পারে।
- যুক্তরাষ্ট্র হয়তো আরও কঠোর শুল্ক নীতি আনতে পারে, যা বৈশ্বিক উত্তেজনা বাড়াবে।
- জার্মানি ও ইউরোপীয় দেশগুলো ভারতের বাজারে বিনিয়োগ বাড়াতে পারে।
- আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো (যেমন WTO) এই শুল্কযুদ্ধ নিয়ে নতুন নিয়মকানুন প্রণয়নের দিকে যেতে পারে।
উপসংহার
যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক আরোপ নিঃসন্দেহে ভারতের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ। কিন্তু একই সঙ্গে এটি নতুন সুযোগও এনে দিয়েছে। জার্মানির প্রকাশ্য সমর্থন প্রমাণ করে যে, বিশ্ব এখন আর একমুখী নয়; বরং বহুমুখী শক্তির ভারসাম্য তৈরি হচ্ছে।
ভারত যদি সঠিকভাবে কৌশল নির্ধারণ করে, তবে এই পরিস্থিতি থেকে লাভবান হওয়া সম্ভব। কারণ—
- যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে বিকল্প বাজার তৈরি হচ্ছে।
- ইউরোপ ও ভারতের অর্থনৈতিক সহযোগিতা নতুন মাত্রা পাচ্ছে।
- বহুপাক্ষিক বিশ্ব বাণিজ্যে ভারতের ভূমিকা আরও জোরদার হচ্ছে।
অতএব বলা যায়, এই শুল্কযুদ্ধ কেবল সংকট নয়, বরং ভারতের জন্য এক নতুন অর্থনৈতিক ও ভূরাজনৈতিক সম্ভাবনার দ্বারও উন্মুক্ত করছে।