চাঁদের রহস্য: আগ্নেয়গিরি থেকে ‘বিগ হোয়াক’ পর্যন্ত

 মানুষের কৌতূহলের ইতিহাসে চাঁদ এক বিশেষ স্থান দখল করে আছে। পৃথিবীর আকাশে প্রতিদিন চোখে পড়া এই মহাজাগতিক সঙ্গীকে আমরা অনেকেই শুধুই একটি বড় পাথরের গোলক হিসেবে ভাবি। কিন্তু চাঁদ আসলে এর থেকেও অনেক বেশি জটিল ও বিস্ময়কর। এর ভেতরে একসময় আগ্নেয়গিরি ছিল, এর ভূপৃষ্ঠে আছে পর্বত, গহ্বর আর ‘সাগর’ বা মারিয়া। আর সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার হলো—চাঁদ আসলে পৃথিবীরই একটি অংশ থেকে তৈরি! আজকের ব্লগে আমরা জানবো চাঁদের অভ্যন্তরীণ গঠন, আগ্নেয় অতীত এবং ‘বিগ হোয়াক’ নামের সেই মহাজাগতিক দুর্ঘটনার কাহিনি, যেখান থেকে আমাদের একমাত্র প্রাকৃতিক উপগ্রহের জন্ম।

Moon Formation in Bengali

🌋 চাঁদে আগ্নেয়গিরি: অতীতের অগ্নিময় ইতিহাস

আজকের দিনে চাঁদকে আমরা নীরব, শীতল এবং প্রাণহীন একটি দেহ হিসেবে দেখি। কিন্তু প্রায় ৪.৫ বিলিয়ন বছর আগে পরিস্থিতি ছিল ভিন্ন। পৃথিবীর মতো চাঁদেরও স্তরবিন্যাস রয়েছে—

  • উপরের দিকে কঠিন শিলা-ভূত্বক
  • এর নিচে আধা-তরল ম্যান্টল
  • এবং আরও গভীরে ধাতব কেন্দ্র (আভ্যন্তরীণ ও বহিঃকেন্দ্র)।

চাঁদ যখন সদ্য গঠিত, তখন এর ম্যান্টল প্রচণ্ড তাপধারী ছিল। এই অস্থির ভেতরের অংশ থেকে গলিত লাভা ভূত্বকের ফাটল ভেদ করে উপরে উঠে আসত। ফলস্বরূপ, অসংখ্য আগ্নেয়গিরির সৃষ্টি হয় এবং ব্যাপক লভা প্রবাহে চাঁদের পৃষ্ঠে মসৃণ সমভূমি তৈরি হয়।

তবে পৃথিবীর বিপরীতে চাঁদের ভেতরের শক্তি দ্রুত নিঃশেষিত হয়। মাত্র ১০০ থেকে ১৫০ মিলিয়ন বছরের মধ্যেই অভ্যন্তরীণ তাপ ঠান্ডা হয়ে যায়। এর ফলে আগ্নেয়গিরিগুলো ধীরে ধীরে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। বর্তমানে চাঁদে সক্রিয় আগ্নেয়গিরি নেই। কেবলমাত্র কিছু ছোট ছোট গম্বুজ আকৃতির আগ্নেয়গিরি পাহাড় (উচ্চতা কয়েকশ মিটার মাত্র) প্রমাণ দেয় সেই অতীতের আগ্নেয় কার্যকলাপের।


🏞️ চাঁদের ভূদৃশ্য: মরুভূমি, পর্বত ও ‘সাগর’

যে ১২ জন মহাকাশচারী চাঁদের মাটিতে হেঁটেছেন, তাঁদের বর্ণনা অনুযায়ী চাঁদ অনেকটা মরুভূমির মতো। নির্জন, শুষ্ক, অথচ এক অদ্ভুত সৌন্দর্যে ভরপুর। এখানে আছে—

  • অসংখ্য গহ্বর (craters), যেগুলো প্রাচীন উল্কাপাতের ফল।
  • শিলা ও পর্বতশ্রেণী, যা ভূতাত্ত্বিক পরিবর্তনের সাক্ষ্য বহন করে।
  • এবং সবচেয়ে বিখ্যাত ‘মারিয়া’ (Maria) বা সমতল কালো প্রান্তর। এগুলো প্রাচীন আগ্নেয় লাভা প্রবাহ থেকে সৃষ্টি, যেগুলো পরবর্তীতে ঠান্ডা হয়ে শক্ত সমতল জমি গঠন করে।

প্রাচীন রোমান জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা অন্ধকার এসব সমতলকে ‘মারিয়া’ বা ‘সাগর’ ভেবেছিলেন। যদিও সেখানে কোনো জল নেই, তবুও আজও আমরা এই নাম ব্যবহার করি।


🌍 চাঁদের জন্ম: ‘বিগ হোয়াক’ তত্ত্ব

চাঁদের গঠন নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই গবেষণা চলছে। একসময় ধারণা করা হতো চাঁদ হয়তো পৃথিবীর মহাকর্ষে ধরা পড়া অন্য কোনো গ্রহাণু। কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞানীদের মতে চাঁদ পৃথিবীরই অংশ থেকে গঠিত।

এই তত্ত্বকে বলা হয় The Big Whack Theory বা ‘বিগ হোয়াক’ তত্ত্ব। এর সারমর্ম হলো—

প্রায় ৪.৫ বিলিয়ন বছর আগে, যখন সৌরজগত তখনও নবীন, পৃথিবীর কক্ষপথে ঘুরছিল আরও কিছু গ্রহাকৃতি বস্তু। এর মধ্যে একটি বিশাল গ্রহাণু (আকারে প্রায় মঙ্গল গ্রহের সমান) পৃথিবীর সঙ্গে প্রচণ্ডভাবে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। এই আঘাতে পৃথিবীর এক বিশাল অংশ ছিঁড়ে মহাশূন্যে ছিটকে যায়।

এই ভাঙা টুকরোগুলো গলিত ধুলা, শিলা ও ধাতুতে পরিণত হয়ে পৃথিবীর চারপাশে একটি বলয় (ring) তৈরি করে— অনেকটা আজকের শনির বলয়ের মতো। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এসব ধ্বংসাবশেষ মাধ্যাকর্ষণের প্রভাবে একত্রিত হয়ে তৈরি হয় এক নতুন মহাজাগতিক দেহ— আমাদের চাঁদ।


🔥 প্রাথমিক চাঁদ: অগ্নিময় থেকে শীতল

চাঁদ যখন সদ্য তৈরি হলো, তখন এটি ছিল গলিত আগ্নেয় পিণ্ড। সর্বত্র চলত লাভার স্রোত, অগ্ন্যুত্পাত এবং ক্রমাগত ভূতাত্ত্বিক পরিবর্তন। প্রায় ৯০০ মিলিয়ন বছর পর চাঁদ ধীরে ধীরে ঠান্ডা হতে শুরু করে এবং শেষ পর্যন্ত আজকের মতো কঠিন, শীতল ও নিষ্ক্রিয় অবস্থায় পৌঁছায়।

এরপর থেকে চাঁদের ভূপৃষ্ঠে বড় কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। কেবল মাঝে মাঝে উল্কাপিণ্ড আঘাত হেনে নতুন গহ্বর তৈরি করেছে, যেগুলো আজও আমরা চাঁদের মাটিতে দেখতে পাই।


🌗 চাঁদের আকার ও কক্ষপথ

চাঁদ পৃথিবীর তুলনায় অনেক ছোট— ব্যাস প্রায় পৃথিবীর এক-চতুর্থাংশ। গড় দূরত্ব ৩৮৪,৪০০ কিলোমিটার (২,৪০,০০০ মাইল)। এটি পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করতে সময় নেয় ২৭.৩ দিন। আশ্চর্যের বিষয় হলো, চাঁদ সবসময় পৃথিবীর দিকে একই দিক দেখায়। অর্থাৎ আমরা পৃথিবী থেকে কেবল এক পাশই দেখতে পাই, অন্য পাশ (যাকে আমরা far side of the Moon বলি) আমাদের চোখের আড়ালেই থেকে গেছে।


🧪 কেন চাঁদের উৎস পৃথিবীর সঙ্গে যুক্ত?

বিজ্ঞানীরা চাঁদের মাটি ও শিলা বিশ্লেষণ করে দেখেছেন, এগুলোর রাসায়নিক গঠন অনেকটাই পৃথিবীর ভূত্বকের মতো। বিশেষ করে অক্সিজেন আইসোটোপের গঠন পৃথিবীর সঙ্গে একেবারেই মিলে যায়। এটি প্রমাণ করে যে চাঁদের উপাদান আসলে পৃথিবীর থেকেই এসেছে। তাই ‘বিগ হোয়াক’ তত্ত্ব এখন পর্যন্ত সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা।


🚀 মানুষের পদচিহ্ন

১৯৬৯ সালে নীল আর্মস্ট্রং যখন প্রথম চাঁদের মাটিতে পা রাখেন, তখন তিনি আসলে পৃথিবীরই সেই প্রাচীন ভাঙা অংশে হেঁটেছিলেন। এরপর আরও ১১ জন নভোচারী চাঁদে হেঁটেছেন এবং সেখান থেকে শিলা ও ধুলার নমুনা সংগ্রহ করেছেন। এগুলো আমাদের ‘বিগ হোয়াক’ তত্ত্বকে আরও শক্তিশালী করেছে।


🌌 উপসংহার

চাঁদ শুধু রাতের আকাশের সৌন্দর্য নয়, এটি পৃথিবীর ইতিহাসেরও জীবন্ত সাক্ষ্য। আগ্নেয় অতীত, প্রাচীন গহ্বর, মারিয়া সমভূমি আর সেই মহাজাগতিক সংঘর্ষ—সবকিছুই মিলিয়ে চাঁদ আমাদের বলে দেয় সৌরজগতের জন্মের গল্প।

পৃথিবী ও চাঁদ আসলে অবিচ্ছেদ্য— কারণ চাঁদ পৃথিবীরই সন্তান। প্রতিদিন আকাশে তাকিয়ে যখন আমরা চাঁদ দেখি, তখন আসলে আমরা আমাদেরই অতীত ইতিহাসের দিকে তাকিয়ে থাকি।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

যদি আপনার কোনও বিষয়ে ডাউট থাকে বা কোনও বিষয় suggest করতে চান তাহলে মেল করুন!

নবীনতর পূর্বতন

banglafacts 4