বিশ্বজুড়ে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ চলছে তিন বছরেরও বেশি সময় ধরে। যুদ্ধ মানেই দুঃখ, রক্তপাত, রাজনৈতিক জটিলতা আর মানবিক সংকট। কিন্তু এই ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিতেও কিছু মানুষ আছেন যাঁরা যেন ভাঁড়ামি করার সুযোগ হাতছাড়া করতে চান না। তাঁদের মধ্যে প্রথম সারিতে আছেন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ বাণিজ্য উপদেষ্টা পিটার নাভারো।

তিনি সম্প্রতি এক ‘বিস্ফোরক’ দাবি করেছেন—এই যুদ্ধ নাকি "মোদীর যুদ্ধ"! শুনতে যতটা অদ্ভুত, বাস্তবে তারচেয়ে বেশি হাস্যকর। ট্রোল করার মতো এমন উপাদান পাওয়া সত্যিই বিরল।
নাভারোর দাবি: "মোদীই দায়ী!"
নাভারো বলেছেন, ভারত রাশিয়ার ডিসকাউন্টে পাওয়া অপরিশোধিত তেল কিনে রাশিয়ার যুদ্ধযন্ত্র চালু রাখতে সাহায্য করছে। তাই এ যুদ্ধকে বলা উচিত "মোদীর যুদ্ধ"।
এবার একটু ভেবে দেখুন—যদি ভারত রাশিয়ার কাছ থেকে তেল কেনে, তবে দোষ ভারতের। কিন্তু চীন, ইউরোপ, এমনকি আমেরিকার কিছু মিত্র দেশ যখন সরাসরি বা আড়ালে রাশিয়ার জ্বালানি নিচ্ছে, তখন তাঁদের দোষ নেই। এ যেন মিষ্টি খেলে দাঁত পড়ে যায় শুধু প্রতিপক্ষের, নিজের হলে হজমে সাহায্য করে!
নাভারো আরও বলেছেন, আমেরিকার অধিকার আছে ভারতের ওপর নতুন শুল্ক চাপানোর। তবে ভারত যদি রাশিয়ার তেল কেনা বন্ধ করে, তাহলে ২৫% শুল্ক ছাড় দেওয়া হতে পারে। আহা! যেন শুল্ক আর তেলকে আলু-পটলের বাজারে দরাদরির মতো ব্যবহার করছেন।
ভারতের অবস্থান: "না তোর, না আমার—আমার নিজের"
ভারত সবসময়ই স্পষ্ট করেছে যে তারা কোনও গোষ্ঠীর যুদ্ধে পক্ষ নেবে না। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বারবার বলেছেন, “এটা যুদ্ধের যুগ নয়, শান্তির যুগ”। ভারত রাশিয়ার সঙ্গেও কথা বলেছে, আবার ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কিকেও দিল্লি আমন্ত্রণ জানিয়েছে।
কিন্তু, নিজের জনগণের প্রয়োজনের কথা না ভেবে কি ভারত কেবল আমেরিকার খুশির জন্য জ্বালানি কিনবে না?
- এনার্জি সিকিউরিটি: ভারত বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম জ্বালানি আমদানিকারক দেশ। দামি মধ্যপ্রাচ্যের তেল বাদ দিয়ে সস্তায় রাশিয়ার তেল না কিনলে ভারতের অর্থনীতি তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়বে।
- কূটনৈতিক ভারসাম্য: ভারত পশ্চিমা বিশ্বকে খুশি করার পাশাপাশি রাশিয়ার সঙ্গে ঐতিহাসিক সম্পর্কও বজায় রাখতে চায়।
তাহলে প্রশ্ন দাঁড়ায়—এ যুদ্ধ কি আসলেই "মোদীর যুদ্ধ", নাকি নাভারোর মাথার ভেতর চলা অদ্ভুত সব তত্ত্বের যুদ্ধ?
আমেরিকার ভূমিকায় একপেশে নাটক
নাভারোর অভিযোগ বুঝতে হলে আমেরিকার অবস্থানও দেখা দরকার।
- ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকে আমেরিকা ১০০ বিলিয়ন ডলারের বেশি সাহায্য দিয়েছে কিয়েভকে। এর বিশাল অংশ সামরিক সরঞ্জাম, ট্যাঙ্ক, ড্রোন আর গোলাবারুদের জন্য।
- এই অর্থের বড় ভাগ আবার ফিরে যাচ্ছে আমেরিকার অস্ত্রশিল্পে। এক কথায়—"তুই লড়, আমি কামাই করব।"
তাহলে প্রশ্ন আসে—ভারত যদি নিজের অর্থনীতি বাঁচাতে সস্তায় তেল কেনে, সেটা "মোদীর যুদ্ধ"; কিন্তু আমেরিকা যদি যুদ্ধকে অস্ত্র ব্যবসার সোনার খনি বানায়, সেটা "গণতন্ত্র রক্ষার মহৎ কাজ"?
বিশেষজ্ঞদের মতে: নাভারো = "স্ট্র্যাটেজিক কমেডি"
আমেরিকার বিশ্লেষক ও থিঙ্ক ট্যাঙ্কগুলোর অনেকেই নাভারোর বক্তব্যকে "স্ট্র্যাটেজিক্যালি ইনকোহেরেন্ট" বলেছেন। কারণ—
- চীনও প্রচুর রাশিয়ান তেল কিনছে। কিন্তু নাভারোর মুখে চীনের নাম নেই। কেন? হয়তো ট্রাম্প-নাভারো দল চীনের নাম শুনলেই নিজেদের দুর্বলতা মনে পড়ে যায়।
- ইউরোপের দেশগুলোও নানা উপায়ে রাশিয়ার এনার্জি ব্যবহার করছে। তাঁদের প্রতি এত উদারতা, আর ভারতের প্রতি এত কড়াকড়ি কেন?
- দুই দশক ধরে গড়ে ওঠা ভারত-আমেরিকা কৌশলগত সম্পর্ককে এভাবে হঠাৎ চাপের মুখে ফেলা একধরনের কূটনৈতিক আত্মঘাতী প্রবণতা।
অনেক বিশেষজ্ঞ ঠাট্টা করে বলেছেন—নাভারোর এ যুক্তি শুনে মনে হয় তিনি হয়তো ইউক্রেন যুদ্ধের খবর না পড়ে "মিম পেজ" ফলো করছেন!
ট্রাম্প প্রশাসনের কূটনৈতিক কসরত: "সবার সঙ্গে ঝগড়া, নিজের সঙ্গে বাঁধা"
ডোনাল্ড ট্রাম্প আর তাঁর উপদেষ্টাদের বৈশিষ্ট্য হলো—
- ট্যারিফ মানেই সমাধান: সব সমস্যার উত্তর হলো আমদানি শুল্ক। সেটা চীন হোক, ভারত হোক বা মেক্সিকো।
- কূটনীতির চেয়ে টুইটার: রাষ্ট্রনীতি নির্ধারণ হয় একেকটা ক্যাপস লক টুইটের মাধ্যমে।
- বন্ধু মানেই শর্ত: আপনি যদি মার্কিন স্বার্থ মেনে চলেন, তবে বন্ধু। না হলে সঙ্গে সঙ্গে আপনি শত্রু।
এই নীতির ফলে আমেরিকা অনেক মিত্র হারিয়েছে। আর নাভারোর "মোদীর যুদ্ধ" তত্ত্ব যেন সেই ব্যর্থ কূটনীতির নতুন সংস্করণ।
ভারতকে শাস্তি না ট্রোল?
ভারত এখন আমেরিকার ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলের অন্যতম প্রধান স্তম্ভ। কিন্তু নাভারোর মতো ব্যক্তিরা যদি বারবার ভারতের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলেন, তবে ভারতকে কাছে আনার বদলে দূরে ঠেলে দেওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।
হয়তো রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এখন বসে হাসছেন—
"আমাকে দোষ না দিয়ে মোদীকে দোষ দিচ্ছে? বাহ, আমেরিকার রাজনীতিবিদরা আসলেই ট্রোল মাস্টার!"
শেষকথা: যুদ্ধ নয়, নাভারোর মাথায় চলছে কমেডি শো
বিশ্বযুদ্ধ, মানবিক সংকট, অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ—এসব গুরুতর বিষয়ে যুক্তিসংগত আলোচনা প্রয়োজন। কিন্তু নাভারো এসব বাদ দিয়ে "মোদীর যুদ্ধ" বলে যেসব বোমা ছুড়ছেন, তা মূলত বস্তাপচা রাজনৈতিক ট্রোল ছাড়া কিছুই নয়।
ভারত যদি নিজের জনগণের স্বার্থে তেল কেনে, সেটা যুদ্ধের দায়ভার নয়। কিন্তু ট্রাম্প প্রশাসনের বাণিজ্যিক হুমকি ও কূটনৈতিক ভাঁড়ামিই প্রমাণ করে—আসল যুদ্ধটা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক মঞ্চে, যেখানে যুক্তি আর কৌতুকের লড়াই চলছে।
তাই বলা যায়—
👉 ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ হয়তো বাস্তবে রক্তাক্ত, কিন্তু "মোদীর যুদ্ধ" নামক নাটকটা আসলে পিটার নাভারোর মাথার ভেতরেই সীমাবদ্ধ।
👉 আর ট্রাম্প প্রশাসন? তারা তো সর্বকালের সেরা ট্রল টিম, যাঁরা গম্ভীর কূটনীতিকেও মিমের খোরাক বানাতে ওস্তাদ।