১৯৭১ এর ক্ষত: পাকিস্তান-বাংলাদেশের দ্বিমুখী রাজনীতি ও ভণ্ডামি

দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক নিয়ে কথা উঠলেই একটি শব্দ যেন চিরকালই সামনে চলে আসে—১৯৭১। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, পাকিস্তানি সেনাদের গণহত্যা, লাখো মানুষের মৃত্যু, নারীদের উপর বর্বর যৌন নির্যাতন—সব মিলিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাসে এটি এক অমোচনীয় অধ্যায়। অথচ, এই ভয়াবহ ট্র্যাজেডির ৫৪ বছর পরও পাকিস্তান ও বাংলাদেশ দুই দেশই নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থে এই ইস্যুকে টেনে নিয়ে চলছে। সম্প্রতি পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইশাক দার ঢাকায় সফরে এসে যে মন্তব্য করেছেন, তাতে আবারও এই পুরনো ক্ষত খুলে গিয়েছে।

পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যে ১৯৭১ মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কূটনৈতিক দ্বন্দ্ব

পাকিস্তানের ভণ্ডামি ও অস্বীকার

ইশাক দার ঢাকায় এসে দাবি করেছেন, ১৯৭১ সালের বিষয়টি দুইবারই মীমাংসিত হয়েছে—একবার ১৯৭৪ সালে, আবার পারভেজ মোশাররফের সময়ে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে—কোন মীমাংসা? পাকিস্তান কখনোই আনুষ্ঠানিকভাবে মুক্তিযুদ্ধের গণহত্যা স্বীকার করেনি। “অনুশোচনা” বা “দুঃখ প্রকাশ” জাতীয় কিছু ফাঁপা শব্দ ব্যবহার করা হলেও প্রকৃত অর্থে ক্ষমা প্রার্থনা তারা কখনোই করেনি।

পাকিস্তানের এই অবস্থানকে কেবল এক ধরনের অস্বীকারের রাজনীতি বলা যায়। কারণ, ইতিহাসের সামনে তারা মাথা নত করতে চায় না। পাকিস্তান বরাবরই নিজের সেনাবাহিনীকে “গর্বের প্রতীক” হিসেবে তুলে ধরতে চায়। তাই মুক্তিযুদ্ধে সেনাদের বর্বরতা মেনে নেওয়া মানেই তাদের আত্মপরিচয়ের এক বড় অংশ ভেঙে পড়া। সেই ভয়েই পাকিস্তান আজও দায় স্বীকার করে না।

কিন্তু এই ভণ্ডামির সর্বোচ্চ পর্যায় হলো—আজও পাকিস্তান রাজনৈতিকভাবে ভেবে থাকে, অতীত চাপা দিলে বর্তমানে সম্পর্ক মধুর হয়ে যাবে। অথচ গণহত্যা, ধর্ষণ আর দুঃস্বপ্নের স্মৃতি কি কেবল “settled” শব্দ ব্যবহার করে মুছে ফেলা সম্ভব?


বাংলাদেশের ভণ্ডামি ও সুযোগসন্ধান

তবে কেবল পাকিস্তানকেই দোষ দিয়ে থেমে গেলে চলবে না। বাংলাদেশও এই ইস্যুকে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে এসেছে বছরের পর বছর।

বাংলাদেশের প্রতিটি সরকার এই ইস্যুকে প্রয়োজনে সামনে আনে, প্রয়োজনে চাপা দেয়। যখন রাজনৈতিক সুবিধা থাকে—তখন পাকিস্তানের কাছে “ক্ষমা” দাবি উঁচিয়ে ধরা হয়। কিন্তু বাস্তবে কোনো সরকারই আন্তরিকভাবে আন্তর্জাতিক মহলে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে শক্ত কণ্ঠে অবস্থান নেয়নি।

বাংলাদেশ একদিকে পাকিস্তানের ক্ষমাপ্রার্থনা দাবি করে, অন্যদিকে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য বাড়াতে আবার গোপনে কূটনৈতিক আলাপও চালিয়ে যায়। বিদেশনীতি যেন এক ধরনের নাটক হয়ে গেছে—যেখানে জনগণের আবেগ দিয়ে খেলা হয়, কিন্তু মূল লক্ষ্য থাকে কেবল রাজনৈতিক সুবিধা।

তাছাড়া, বাংলাদেশের ভেতরেও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি নিয়ে ভয়াবহ রাজনীতি হয়েছে। শহীদ সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক, রাজাকারদের বিচার নিয়ে দলীয় স্বার্থ, কিংবা নির্বাচনকেন্দ্রিক প্রচারণা—সবকিছুতেই ১৯৭১ এক প্রকার রাজনৈতিক মুদ্রা হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। এই ভণ্ডামির দায় শুধু পাকিস্তানের নয়, বাংলাদেশের রাজনৈতিক শ্রেণির উপরও বর্তায়।


ক্ষমাপ্রার্থনা বনাম বাস্তব রাজনীতি

বাংলাদেশ দাবি করে—আনুষ্ঠানিক ক্ষমা, ক্ষতিপূরণ, এবং আটক পাকিস্তানি নাগরিকদের ফেরত নেওয়া। প্রশ্ন হচ্ছে—এগুলো আদৌ কখনো বাস্তবায়িত হবে কি?

পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অবস্থা এমন যে, সেনাবাহিনী-নিয়ন্ত্রিত রাষ্ট্রে কেউই প্রকাশ্যে সেনাদের “অপরাধী” বলতে সাহসী হবে না। ফলে ক্ষমাপ্রার্থনা আসলে দিগন্তের ওপারে থাকা মরীচিকা ছাড়া কিছুই নয়।

অন্যদিকে, বাংলাদেশ জানে যে এই ক্ষমা আদায় প্রায় অসম্ভব। তবু এই ইস্যুকে জিইয়ে রাখাই তাদের জন্য লাভজনক—কারণ এতে জাতীয়তাবাদী আবেগ উসকে দেওয়া যায়, জনগণকে বিভ্রান্ত রাখা যায়।

অর্থাৎ দুই দেশই ১৯৭১-এর ক্ষতকে ব্যবহার করছে রাজনৈতিক নাটকের অংশ হিসেবে। একজন অস্বীকার করছে, আরেকজন অতিরঞ্জিত করে তুলে ধরছে—কিন্তু সাধারণ মানুষ, ভুক্তভোগী পরিবারগুলো, কিংবা ইতিহাসের সত্যিকারের ন্যায়বিচার—কোথাও নেই।


আন্তর্জাতিক উদাসীনতা

এটাও ভেবে দেখা দরকার—কেন এত বড় একটি গণহত্যা আজও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যথাযথ স্বীকৃতি পায়নি?

ভিয়েতনাম যুদ্ধ বা রুয়ান্ডা গণহত্যা বিশ্বমঞ্চে ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়েছে। কিন্তু ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের গণহত্যা আজও প্রায় উপেক্ষিত। এর পেছনে দায় পাকিস্তান ও বাংলাদেশের নিজেদেরও।

পাকিস্তান চেয়েছে আন্তর্জাতিকভাবে এই ইস্যুকে চাপা দিতে, আর বাংলাদেশ কখনোই ধারাবাহিকভাবে বিশ্ব দরবারে একে তুলে ধরেনি। আন্তর্জাতিক রাজনীতির কাছে ১৯৭১-এর গণহত্যা কেবল দক্ষিণ এশিয়ার এক “দ্বিপাক্ষিক সমস্যা”—যা দুই দেশ নিজেরা মিটিয়ে নিক। এই উদাসীনতাকে কাজে লাগিয়ে পাকিস্তান দায়িত্ব এড়িয়ে যাচ্ছে, আর বাংলাদেশ কেবল অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ব্যবহার করছে।


জনগণ বনাম রাজনীতি

সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি হলো—দুই দেশের জনগণই এই ভণ্ডামির শিকার। পাকিস্তানের সাধারণ মানুষ হয়তো ইতিহাসের পূর্ণ সত্যই জানে না। স্কুল-কলেজের বইয়ে মুক্তিযুদ্ধের গণহত্যার কথা নেই, বরং একে তুলে ধরা হয় “অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ” হিসেবে।

অন্যদিকে বাংলাদেশের জনগণ মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি নিয়ে আবেগপ্রবণ থাকলেও, সেই আবেগকে রাজনৈতিক দলগুলো কাজে লাগিয়ে বারবার প্রতারিত করেছে। ফলে প্রকৃত সমাধান হয়নি, বরং পুরোনো ক্ষতই নতুন করে খোঁচানো হয়েছে।


উপসংহার: এক ভণ্ডামির ইতিহাস

পাকিস্তান ও বাংলাদেশ—দুই দেশই আজও ১৯৭১-এর ট্র্যাজেডিকে সত্যিকার অর্থে মোকাবিলা করেনি। পাকিস্তান অস্বীকারের দেয়ালে দাঁড়িয়ে আছে, আর বাংলাদেশ আবেগের বাণিজ্যে মত্ত।

প্রকৃত ক্ষমা, প্রকৃত ন্যায়বিচার, কিংবা প্রকৃত ক্ষতিপূরণ—এসব আজও অধরা। বরং রাজনীতির নামে ইতিহাসের ক্ষতকে ব্যবহার করা হচ্ছে প্রতিনিয়ত।

একদিকে পাকিস্তানের সামরিকতান্ত্রিক গোঁড়ামি, অন্যদিকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভণ্ডামি—এই দুই মিলেই মুক্তিযুদ্ধের ভয়াবহ স্মৃতি আজও দক্ষিণ এশিয়ার কূটনীতির অচলাবস্থার প্রতীক।

অতএব বলা যায়—১৯৭১ এর ক্ষত কেবল ইতিহাস নয়, এটি পাকিস্তান ও বাংলাদেশের বর্তমান রাজনীতির আয়না। আর এই আয়নায় প্রতিফলিত হচ্ছে দুই দেশেরই ভণ্ডামি, কূটনৈতিক ব্যর্থতা ও জনগণের সঙ্গে প্রতারণা।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

যদি আপনার কোনও বিষয়ে ডাউট থাকে বা কোনও বিষয় suggest করতে চান তাহলে মেল করুন!

নবীনতর পূর্বতন

banglafacts 4