ভারতের ১১৩ কিমি দীর্ঘ খাল নির্মাণ পরিকল্পনা: ইন্দাস জলচুক্তির অধীনে জলের সর্বোচ্চ ব্যবহার
ভারত বর্তমানে ইন্দাস নদী ব্যবস্থা থেকে অতিরিক্ত জলকে নিজের ভূখণ্ডে ব্যবহার করার জন্য এক বিশাল খাল প্রকল্পের পরিকল্পনা করেছে। প্রস্তাবিত খালটি ১১৩ কিলোমিটার দীর্ঘ এবং এটি ইন্দাস নদী ব্যবস্থার ‘পশ্চিমী নদীগুলির’ অতিরিক্ত জলকে ‘পূর্ব নদী’ ব্যবস্থার সঙ্গে সংযুক্ত করবে। এই প্রকল্পটি শুধু ভারতের জল সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করার চেষ্টা নয়, বরং এর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে ভূ-রাজনৈতিক বার্তা, জলসঙ্কট মোকাবিলার রণনীতি এবং পাকিস্তানের সঙ্গে একটি পুরনো চুক্তির কার্যকারিতা নিয়ে নতুন বিতর্ক।
🔹 ইন্দাস জল চুক্তি (Indus Waters Treaty) – এক সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা
১৯৬০ সালে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে স্বাক্ষরিত ইন্দাস জল চুক্তি ছিল এক ঐতিহাসিক ঘটনা। বিশ্ব ব্যাংকের তত্ত্বাবধানে হওয়া এই চুক্তি অনুযায়ী, ইন্দাস নদী ব্যবস্থার ছয়টি নদী – ইন্দাস, ঝেলম, চেনাব (পশ্চিম নদী) এবং রবি, বিয়াস, সতলজ (পূর্ব নদী) – এর জলবন্টনের দায়িত্ব ভাগ করা হয়।
- পাকিস্তানকে প্রাধান্য দেওয়া হয় পশ্চিমী নদীগুলির ব্যবহারে।
- ভারতকে সম্পূর্ণ অধিকার দেওয়া হয় পূর্ব নদীগুলিতে।
- ভারত কিছু সীমিত ‘অ-ভোগান্তিমূলক’ এবং কৃষিকাজের ব্যবহার করতে পারে পশ্চিম নদীগুলিতে।
এই চুক্তি এতদিন আন্তর্জাতিক স্তরে একটি স্থিতিশীল সমঝোতার নিদর্শন হিসেবে বিবেচিত হয়েছে, কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলিতে এর যথার্থতা ও প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে।
🔹 ১১৩ কিমি দীর্ঘ খাল প্রকল্পের মূল লক্ষ্য
ভারতের প্রস্তাবিত খালটির প্রধান উদ্দেশ্য হল পশ্চিমী নদী – বিশেষত চেনাব – থেকে অতিরিক্ত জলের প্রবাহকে পূর্ব নদী ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত করে দেশের জলসঙ্কটপূর্ণ রাজ্যগুলিতে পৌঁছে দেওয়া। এই রাজ্যগুলি হল:
- পাঞ্জাব
- হরিয়ানা
- রাজস্থান
এখানে উল্লেখযোগ্য যে, বর্তমানে চেনাব, ঝেলম ও ইন্দাস নদীর বেশিরভাগ জল ব্যবহার না করে সরাসরি পাকিস্তানে প্রবাহিত হয়ে যায়। এর ফলে ভারতের নিজস্ব জলচাহিদা পূরণে ঘাটতি রয়ে যায়, বিশেষত কৃষিকাজ ও পানীয় জলের ক্ষেত্রে।
🔹 খালের প্রযুক্তিগত কাঠামো ও কার্যপ্রণালী
এই খাল প্রকল্পটি চেনাব নদীকে রবি-বিয়াস-সতলজ নদী ব্যবস্থার সঙ্গে সংযুক্ত করবে, যা পূর্ব নদী হিসেবেই ভারতকে বরাদ্দ। এর মাধ্যমে একটি আন্তঃনদী সংযোগ (inter-basin transfer) তৈরি হবে, যা ভারতের জল ব্যবস্থাপনায় যুগান্তকারী পরিবর্তন আনবে।
এই খালের সম্ভাব্যতা নিয়ে একটি বিশদ সমীক্ষা বর্তমানে চলমান। যদি সব কিছু পরিকল্পনামাফিক চলে, তবে আগামী তিন বছরের মধ্যেই এর নির্মাণকাজ সম্পন্ন হবে বলে আশা করা যাচ্ছে।
🔹 বিদ্যমান পরিকাঠামোর সঙ্গে সংযুক্তিকরণ
এই খাল প্রকল্পটি সম্পূর্ণ নতুন কিছু নয়, বরং এটি বিদ্যমান অবকাঠামোর সঙ্গে যুক্ত হয়ে একটি বিস্তৃত জল সরবরাহ ব্যবস্থা তৈরি করবে।
- জম্মু ও কাশ্মীর, পাঞ্জাব, হরিয়ানা ও রাজস্থানে থাকা ১৩টি বিদ্যমান খাল ব্যবস্থার সঙ্গে এটি সংযুক্ত হবে।
- এর মাধ্যমে এটি ইন্দিরা গান্ধী খাল প্রকল্পে যুক্ত হবে, যা রাজস্থানের মরুপ্রদেশে কৃষিকাজের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
- ভবিষ্যতে এটি যমুনা নদীর সঙ্গেও যুক্ত করা হতে পারে, যার ফলে খালটির দৈর্ঘ্য প্রায় ২০০ কিমিতে পৌঁছতে পারে।
🔹 পাকিস্তানের উদ্বেগ ও কূটনৈতিক বার্তা
যদিও ভারত দাবি করেছে এই প্রকল্প পুরোপুরি ইন্দাস জলচুক্তির সীমার মধ্যেই রয়েছে, তবুও পাকিস্তানের মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে।
- পাকিস্তান আশঙ্কা করছে যে, বিশেষ করে চেনাব নদীর প্রবাহে বড়সড় হ্রাস ঘটবে।
- ভারতের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ এই প্রকল্প নিয়ে প্রকাশ্যে বলেছেন, “ইন্দাস নদীর জল আগামী তিন বছরের মধ্যে খালের মাধ্যমে রাজস্থানের গঙ্গানগরে পৌঁছে যাবে এবং পাকিস্তান একফোঁটা জলের জন্য হাহাকার করবে।”
এই মন্তব্যের মাধ্যমে প্রকল্পটি কেবল প্রযুক্তিগত নয়, রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক গুরুত্বও বহন করছে।
🔹 জলের রাজনীতি ও জাতীয় নিরাপত্তা
এই খাল প্রকল্প শুধুমাত্র কৃষি ও জনজীবনের চাহিদা পূরণের জন্য নয়, বরং এটি ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা কৌশলের অংশ হিসেবেও বিবেচিত।
- পাকিস্তানের সঙ্গে চুক্তির পুনর্বিন্যাস নিয়ে ভারতের ক্ষোভ বহুদিনের।
- সম্প্রতি পাকিস্তান ঘন ঘন সন্ত্রাসবাদীদের আশ্রয় দেওয়ার অভিযোগে ভারতের তরফ থেকে জলচুক্তি পুনর্বিবেচনার ডাক উঠেছে।
- এই প্রকল্পের মাধ্যমে ভারত একপ্রকার “জল কূটনীতি” (Water Diplomacy) চালু করতে চাইছে।
🔹 পরিবেশগত ও সামাজিক প্রভাব
এই প্রকল্পের একটি বড় দিক হল পরিবেশ ও সামাজিক প্রভাব।
- একদিকে এটি ভারতের জলঘাটতি মেটাবে, অন্যদিকে জলপ্রবাহের পরিবর্তনে কিছু এলাকায় পরিবেশগত ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে।
- এছাড়া, খাল নির্মাণের ফলে জমি অধিগ্রহণ, পুনর্বাসন, এবং কৃষক সমাজে সম্ভাব্য অসন্তোষের দিকেও নজর রাখতে হবে।
সরকার অবশ্য বলেছে যে সমস্ত প্রভাব বিবেচনা করেই খাল নির্মাণ করা হবে এবং যথাযথ ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
🔹 আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও আইনি পরিস্থিতি
ইন্দাস জল চুক্তি আন্তর্জাতিক আইন ও কূটনীতির ক্ষেত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টান্ত। ভারত যদি তার বরাদ্দ জলের মধ্যে থেকেই এই খাল নির্মাণ করে, তবে তা আন্তর্জাতিক নিয়ম লঙ্ঘন বলে বিবেচিত হবে না।
তবে পাকিস্তান যদি এই নিয়ে আন্তর্জাতিক আদালতে যায়, তবে বিষয়টি আরেকটি রাজনৈতিক জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে।
🔹 উপসংহার: ভারতের জলনীতির নতুন অধ্যায়
ভারতের এই ১১৩ কিমি দীর্ঘ খাল প্রকল্প একটি নতুন জলনীতির সূচনা করছে, যা শুধু প্রযুক্তিগত দিক থেকে নয়, কূটনৈতিক, রাজনৈতিক এবং কৌশলগত স্তরেও গভীর তাৎপর্যপূর্ণ।
- এটি ভারতের নিজস্ব জল অধিকার রক্ষার পদক্ষেপ।
- এটি পাকিস্তানের প্রতি কঠোর বার্তা।
- এটি জলসম্পদের কৌশলগত ব্যবস্থাপনার এক নজির।
এই প্রকল্পের সাফল্য ভবিষ্যতের জন্য ভারতের জলের উপর নির্ভরশীলতা কমাবে এবং আন্তর্জাতিক স্তরে দেশের অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করবে।
📲 যোগ দিন টেলিগ্রামে: https://t.me/banglafact
#IndiaWaterPolicy #IndusWatersTreaty #ChenabCanal #WaterSecurity #IndiaPakistanTensions #JalSankat #BanglaBlog #জলনীতি #IndiaGeopolitics