ইরানের হাইপারসোনিক ক্ষেপণাস্ত্র ফাত্তাহ: মধ্যপ্রাচ্যে সামরিক ভারসাম্যের নতুন অধ্যায়

 ইরান তার সামরিক প্রযুক্তিতে এক বিশাল অগ্রগতি অর্জন করেছে “ফাত্তাহ” নামক হাইপারসোনিক ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা (Hypersonic Missile System) উদ্ভাবনের মাধ্যমে। “ফাত্তাহ” শব্দের অর্থ ফারসি ভাষায় "বিজয়ী" বা "জয়কারী"। এই উন্নত ক্ষেপণাস্ত্র শুধু ইরানের প্রযুক্তিগত সক্ষমতার প্রতীক নয়, বরং তা মধ্যপ্রাচ্যে সামরিক ভারসাম্য এবং কৌশলগত পরিস্থিতিকে গভীরভাবে প্রভাবিত করতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।

ইরানের ফাত্তাহ হাইপারসোনিক ক্ষেপণাস্ত্রের গঠন ও প্রযুক্তি

ফাত্তাহ-১: ইরানের প্রথম হাইপারসোনিক বলিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র

উন্মোচন ও নির্মাণ

২০২৩ সালের জুন মাসে ইরান আনুষ্ঠানিকভাবে "ফাত্তাহ-১" (Fattah-1) নামক তাদের প্রথম হাইপারসোনিক ক্ষেপণাস্ত্র উন্মোচন করে। এটি ইসলামি বিপ্লবী গার্ড কর্পস (IRGC)-এর অ্যারোস্পেস ফোর্সের নেতৃত্বে সম্পূর্ণভাবে দেশীয় প্রযুক্তিতে নির্মিত।

শ্রেণিবিভাগ ও বৈশিষ্ট্য

ফাত্তাহ-১ মূলত একটি মাঝারি-পাল্লার (Medium-Range) হাইপারসোনিক বলিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র। এর প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে রয়েছে:

  • গতি: ইরান দাবি করে যে ফাত্তাহ-১ ক্ষেপণাস্ত্রের সর্বোচ্চ গতি Mach 13 থেকে Mach 15 পর্যন্ত হতে পারে। Mach 15 গতি মানে প্রায় ১৭,৯০০ কিমি/ঘণ্টা, যা বিশ্বের অন্যতম দ্রুত অস্ত্রব্যবস্থার মধ্যে পড়ে।
  • পরিসর: প্রায় ১,৪০০ কিলোমিটার পর্যন্ত লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম। অর্থাৎ ইসরায়েলসহ মধ্যপ্রাচ্যের প্রায় সমস্ত মার্কিন ঘাঁটি এই পরিসরের মধ্যে পড়ে।
  • প্রপালশন (চালনা ব্যবস্থা): এটি একটি দ্বি-পর্যায়ের (two-stage) সলিড ফুয়েল প্রপালশন সিস্টেম ব্যবহার করে, যা উচ্চগতির পাশাপাশি দ্রুত উৎক্ষেপণ সক্ষমতা প্রদান করে।
  • চালনা ও ম্যানুভারিং ক্ষমতা: এটি বায়ুমণ্ডলের ভিতরে ও বাইরে জটিল গতিবিধি সম্পাদন করতে সক্ষম, যা একে আধুনিক মিসাইল প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাগুলিকে এড়িয়ে চলতে সহায়তা করে। বিশেষ করে ইসরায়েলের Iron Dome ও Arrow প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে এটি একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
  • ওয়ারহেড: এতে একটি Hypersonic Glide Vehicle (HGV) ওয়ারহেড ব্যবহৃত হয়েছে, যা গতিপথ পরিবর্তন করতে পারে ও অপ্রত্যাশিত রুট অনুসরণ করতে সক্ষম। এতে প্রায় ২০০ কেজি বিস্ফোরক পরিবহন সম্ভব।
  • প্রধান লক্ষ্য: ইরান স্পষ্টভাবে এই মিসাইলকে “ইসরায়েল স্ট্রাইকার” হিসাবে অভিহিত করেছে, যার মাধ্যমে তাদের উদ্দেশ্য সুস্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়।

যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহারের সম্ভাব্য নজির

রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২৪ সালের অক্টোবর ও ২০২৫ সালের জুন মাসে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে এই মিসাইল ব্যবহৃত হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। যদিও এসব ঘটনার পূর্ণাঙ্গ প্রমাণ আন্তর্জাতিকভাবে যাচাই হয়নি, তবে তা মধ্যপ্রাচ্যে চরম উত্তেজনার প্রতিফলন।


ফাত্তাহ-২: পরবর্তী প্রজন্মের উন্নত হাইপারসোনিক ক্ষেপণাস্ত্র

উন্নয়নের অগ্রগতি

ফাত্তাহ-১ এর পর ইরান এখন ফাত্তাহ-২ (Fattah-2) নামে একটি উন্নত সংস্করণের উপর কাজ করছে। এটি আরও দীর্ঘ পাল্লার এবং অধিক নির্ভুলতার সঙ্গে শত্রু লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম হবে বলে জানা গেছে।

প্রধান বৈশিষ্ট্য:

  • পরিসর: প্রাথমিকভাবে ১,৫০০ কিমি পর্যন্ত লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানার ক্ষমতা থাকবে। ভবিষ্যতে এটিকে ২,০০০ কিমি পর্যন্ত সম্প্রসারণ করার পরিকল্পনা রয়েছে।
  • ডিজাইন: এটি ফাত্তাহ-১ এর প্রথম স্টেজের অনুরূপ হলেও দ্বিতীয় স্টেজে সম্পূর্ণ ভিন্ন ডিজাইন এবং প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে। এই ক্ষেপণাস্ত্রকে Hypersonic Cruise Glide Vehicle (HCGV) বলা হচ্ছে।
  • প্রপালশন: এটি লিকুইড ফুয়েল প্রপালশন সিস্টেম ব্যবহার করে, যা thrust বা গতি শক্তি সামঞ্জস্য করার ক্ষমতা রাখে। এটি একটি দুই-ধাপে চালিত প্রিসিশন-গাইডেড মিসাইল।

হাইপারসোনিক প্রযুক্তির সামরিক তাৎপর্য

হাইপারসোনিক অস্ত্রের বৈশিষ্ট্য

হাইপারসোনিক ক্ষেপণাস্ত্র এমন অস্ত্র যা Mach 5 বা তার বেশি গতি অর্জন করে এবং চলন্ত অবস্থায় গতিপথ পরিবর্তনের ক্ষমতা রাখে। এর ফলে:

  • এগুলি ট্র্যাক করা অত্যন্ত কঠিন।
  • প্রচলিত ব্যালিস্টিক মিসাইল প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাগুলি এদের থামাতে প্রায় অক্ষম।
  • লক্ষ্যবস্তুর প্রতিক্রিয়া জানানোর সময়সীমা কমে যায়।

মধ্যপ্রাচ্যে প্রভাব

ইরানের ফাত্তাহ মিসাইল শুধুমাত্র সামরিক অগ্রগতি নয়, এটি রাজনৈতিক এবং কৌশলগত ক্ষেত্রেও গভীর প্রভাব ফেলছে। বিশেষ করে ইসরায়েল ও উপসাগরীয় দেশগুলো ইরানের এই ক্ষমতাকে হুমকি হিসেবে দেখছে। মার্কিন সামরিক ঘাঁটিরও নিরাপত্তা প্রশ্নে নতুন হিসাব কষতে হচ্ছে।


আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও বিশ্লেষণ

ইরানিরা যা বলছে:

ইরান বলছে, ফাত্তাহ তাদের প্রতিরক্ষা কৌশলের অংশবিশেষ। এটি শত্রুদের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে কার্যকর প্রতিবাদ এবং জাতীয় নিরাপত্তার একটি শক্তিশালী প্রতীক।

পশ্চিমা বিশ্লেষকরা যা বলছেন:

অনেক পশ্চিমা বিশ্লেষক ইরানি মিডিয়ার দাবিকে অতিরঞ্জিত বলে মনে করেন। তারা মনে করেন, ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থার কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তবে তারা একমত যে, হাইপারসোনিক প্রযুক্তির দিকে ইরানের অগ্রসর হওয়া এক বিশাল পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়।


উপসংহার: মধ্যপ্রাচ্যের নতুন সামরিক বাস্তবতা

ফাত্তাহ-১ এবং ফাত্তাহ-২ ক্ষেপণাস্ত্র ইরানকে শুধু প্রতিরক্ষা নয়, আক্রমণাত্মক ক্ষমতার দিক থেকেও শক্তিশালী করে তুলেছে। এই প্রযুক্তি ইসরায়েল, সৌদি আরব এবং আমেরিকাসহ বহু রাষ্ট্রের দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ইরানের এই অগ্রগতি শুধু প্রযুক্তিগত নয়; এটি মধ্যপ্রাচ্যে এক নতুন সামরিক প্রতিযোগিতার সূচনাও ঘটিয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জন্য ইরানের মিসাইল কর্মসূচির প্রতি আরও নজর দেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।


🔖 পড়তে থাকুন আমাদের অন্যান্য ব্লগ
📲 টেলিগ্রাম চ্যানেল: https://t.me/banglafact
📝 ব্লগসাইট: https://banglaafacts.blogspot.com


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

যদি আপনার কোনও বিষয়ে ডাউট থাকে বা কোনও বিষয় suggest করতে চান তাহলে মেল করুন!

নবীনতর পূর্বতন

banglafacts 4