সৌদি–ইয়েমেন সংকট ২০২৫ মূলত সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের মধ্যে প্রক্সি দ্বন্দ্বের ফল। মুকাল্লা বন্দরে বিমান হামলা, STC-এর আকস্মিক অগ্রগতি এবং ইয়েমেন সরকারের আল্টিমেটাম—এই ঘটনাগুলো একত্রে আঞ্চলিক নিরাপত্তা ভারসাম্যকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে।
ভূমিকা
২০২৫ সালের শেষ প্রান্তে মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতিতে একাধিক সমান্তরাল সংকট একে অপরের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে। এর কেন্দ্রে রয়েছে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং যুদ্ধবিধ্বস্ত ইয়েমেন। ৩০ ডিসেম্বর ২০২৫ ইয়েমেনের বন্দরনগরী মুকাল্লা-তে সৌদি-নেতৃত্বাধীন জোটের সীমিত বিমান হামলা এই উত্তেজনাকে প্রকাশ্যে এনে দেয়। বাহ্যিকভাবে ঘটনাটি হুথি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে অভিযানের ধারাবাহিকতা বলে মনে হলেও, গভীরে রয়েছে সৌদি–আমিরাত দ্বন্দ্ব, ইয়েমেনের অভ্যন্তরীণ ক্ষমতার লড়াই এবং বৃহত্তর আঞ্চলিক পুনর্গঠনের ইঙ্গিত।
এই প্রতিবেদনের লক্ষ্য হলো আবেগঘন ও ভাইরাল দাবির বাইরে গিয়ে কী ঘটেছে, কে কী বলেছে এবং কোন দাবি তথ্যসমর্থিত—সেসব আলাদা করে তুলে ধরা।
কী ঘটেছিল: সত্যকে আলাদা করা
মুকাল্লা বন্দরে বিমান হামলা
৩০ ডিসেম্বর ভোররাতে সৌদি-নেতৃত্বাধীন জোট মুকাল্লা বন্দরে একটি “নির্ভুল ও সীমিত” বিমান হামলা চালায়। জোটের দাবি অনুযায়ী, দুটি জাহাজ থেকে নামানো বিপুল সামরিক সরঞ্জাম—প্রায় ৪৮০ কিলোমিটার দীর্ঘ লজিস্টিক কনভয়ের সমপরিমাণ অস্ত্র ও সাঁজোয়া যান—এই হামলার লক্ষ্য ছিল। জাহাজগুলোর একটি “গ্রিনল্যান্ড” নামে চিহ্নিত করা হলেও অন্যটির নাম প্রকাশ করা হয়নি।
জোটের বক্তব্যে বলা হয়, জাহাজ দুটি ফুজাইরা থেকে রওনা হয়েছিল এবং কোয়ালিশনের অনুমতি ছাড়াই ইয়েমেনে প্রবেশ করে। আরও অভিযোগ করা হয়, জাহাজগুলো ইচ্ছাকৃতভাবে তাদের ট্র্যাকিং সিস্টেম বন্ধ রেখেছিল। সৌদি জোটের মুখপাত্র মেজর জেনারেল তুর্কি আল-মালিকি দাবি করেন, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের আওতায় হামলা চালানো হয়েছে এবং কোনো বেসামরিক হতাহত বা পার্শ্বক্ষতি হয়নি।
এই পর্যায়ে একটি বিষয় স্পষ্ট: হামলাটি ঘটেছে—এটি বিতর্কিত নয়। বিতর্ক শুরু হয় অস্ত্রের উৎস, গন্তব্য ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে।
ইয়েমেন সরকারের ২৪ ঘণ্টার আল্টিমেটাম
হামলার পরপরই নাটকীয় ঘোষণা আসে ইয়েমেনের রাজনৈতিক নেতৃত্বের পক্ষ থেকে। ইয়েমেনের প্রেসিডেনশিয়াল লিডারশিপ কাউন্সিলের প্রধান রাশাদ আল-আলিমি ঘোষণা করেন, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ইয়েমেন থেকে সব আমিরাতি সামরিক বাহিনী প্রত্যাহার করতে হবে। একই সঙ্গে তিনি সংযুক্ত আরব আমিরাতের সঙ্গে যৌথ প্রতিরক্ষা চুক্তি বাতিল করেন, জরুরি অবস্থা জারি করেন এবং ৭২ ঘণ্টার জন্য সীমান্ত ও বন্দর কার্যক্রম স্থগিত রাখার নির্দেশ দেন।
গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো—এই আল্টিমেটামটি সরাসরি সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান দেননি। এটি এসেছে ইয়েমেন সরকারের কাছ থেকে। সৌদি আরব অবশ্য প্রকাশ্যে সমর্থন জানিয়ে বলেছে, তাদের জাতীয় নিরাপত্তা “অ-আলোচনাযোগ্য লাল রেখা”।
সৌদি–পাকিস্তান কৌশলগত প্রতিরক্ষা চুক্তি: বিভ্রান্তির উৎস
সাম্প্রতিক আলোচনায় একটি বড় বিভ্রান্তির কারণ হলো সৌদি আরব ও পাকিস্তানের মধ্যে স্বাক্ষরিত কৌশলগত প্রতিরক্ষা চুক্তিকে ইয়েমেন সংকটের সঙ্গে সরাসরি জুড়ে দেওয়া।
চুক্তির বাস্তব তথ্য
পাকিস্তান-এর প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ এবং সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫ রিয়াদের আল ইয়ামামাহ প্রাসাদে “স্ট্র্যাটেজিক মিউচুয়াল ডিফেন্স এগ্রিমেন্ট” স্বাক্ষর করেন। এই চুক্তিতে বলা হয়, কোনো এক পক্ষের বিরুদ্ধে আগ্রাসন হলে তা উভয়ের বিরুদ্ধে আগ্রাসন হিসেবে বিবেচিত হবে।
চুক্তিটি গোপন ছিল না এবং ইয়েমেনের ডিসেম্বরের ঘটনাবলির সঙ্গে সরাসরি যুক্তও নয়। এর পটভূমি ছিল সেপ্টেম্বরের শুরুতে দোহায় ইসরায়েলি বিমান হামলার পর উপসাগরীয় অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা নিশ্চয়তা নিয়ে সন্দেহ বৃদ্ধি।
ভুল ব্যাখ্যা
ডিসেম্বরের ইয়েমেন সংকটের সঙ্গে এই চুক্তিকে জুড়ে দিয়ে সামাজিক মাধ্যমে এমন ধারণা ছড়ানো হয় যে, সৌদি যুবরাজ নাকি একযোগে আমিরাত ও পাকিস্তানকে আল্টিমেটাম দিয়েছেন। নির্ভরযোগ্য আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম বা সরকারি নথিতে এর কোনো প্রমাণ নেই।
সৌদি–আমিরাত বিভাজন: কাঠামোগত কারণ
ভিন্ন প্রক্সি কৌশল
সৌদি আরব সমর্থন করে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ইয়েমেন সরকার ও ন্যাশনাল শিল্ড ফোর্সেসকে। বিপরীতে সংযুক্ত আরব আমিরাত দীর্ঘদিন ধরে সমর্থন দিচ্ছে সাউদার্ন ট্রানজিশনাল কাউন্সিল (STC)-কে, যারা দক্ষিণ ইয়েমেনকে আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে চায়।
উভয় দেশ প্রকাশ্যে হুথি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে একসঙ্গে লড়াইয়ের কথা বললেও, ২০২২ সাল থেকেই তারা ইয়েমেনের ভেতরে প্রতিদ্বন্দ্বী গোষ্ঠীগুলোকে সমর্থন দিয়ে আসছে।
STC-এর আকস্মিক আক্রমণ
২০২৫ সালের ২ ডিসেম্বর STC হঠাৎ করে সামরিক অভিযান শুরু করে এবং মাত্র ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে হাদরামাউত ও আল-মাহরা প্রদেশ দখল করে নেয়। এই অঞ্চলগুলো তেলসমৃদ্ধ এবং সৌদি সীমান্তের অত্যন্ত কাছাকাছি। সৌদি বিশ্লেষকদের মতে, এই দখল অনেকটা “হস্তান্তর”-এর মতো ছিল—তীব্র লড়াই ছাড়াই সৌদি-সমর্থিত বাহিনী সরে যায়।
২৫ ডিসেম্বর সৌদি আরব আনুষ্ঠানিকভাবে STC-কে সরে যেতে সতর্ক করে। ২৭ ডিসেম্বর তুর্কি আল-মালিকি ঘোষণা করেন, ভবিষ্যতে যেকোনো সামরিক অগ্রগতি “তাৎক্ষণিকভাবে মোকাবিলা করা হবে”।
কে কী বলেছে: দায়িত্ব নির্ধারণ
এই সংকটে বিভিন্ন বক্তব্য এসেছে বিভিন্ন স্তর থেকে—
-
সৌদি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়: আমিরাতের কার্যকলাপকে “অত্যন্ত বিপজ্জনক” বলে আখ্যা দেয়।
-
সৌদি জোটের মুখপাত্র তুর্কি আল-মালিকি: সামরিক হুঁশিয়ারি ও অভিযানের বিবৃতি দেন।
-
সৌদি প্রতিরক্ষামন্ত্রী প্রিন্স খালিদ বিন সালমান: বলেন, সাম্প্রতিক ঘটনায় ঐক্যবদ্ধ ফ্রন্টে ফাটল ধরেছে।
-
ইয়েমেন সরকার (রাশাদ আল-আলিমি): ২৪ ঘণ্টার আল্টিমেটাম জারি করেন।
লক্ষণীয়ভাবে, মোহাম্মদ বিন সালমানের পক্ষ থেকে আমিরাত ও পাকিস্তানকে একযোগে লক্ষ্য করে কোনো আল্টিমেটামের প্রমাণ পাওয়া যায় না।
আমিরাতের অবস্থান
সংযুক্ত আরব আমিরাত অস্ত্র পাঠানোর অভিযোগ অস্বীকার করেছে। তারা স্বীকার করেছে যে কিছু সাঁজোয়া যান পাঠানো হয়েছে, তবে সেগুলো আমিরাতি বাহিনীর নিজস্ব ব্যবহারের জন্য। আমিরাতের বিবৃতি ছিল তুলনামূলক সংযত—তারা সৌদি আরবের সঙ্গে সম্পর্কের প্রতি অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করে এবং STC নিয়ন্ত্রণের অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে। এই সংযমী কূটনীতি সৌদি আরবের তুলনামূলক কঠোর ভাষার সঙ্গে বৈপরীত্য তৈরি করেছে।
আঞ্চলিক প্রভাব
ওপেক ঐক্যের ঝুঁকি
সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত উভয়ই ওপেকের প্রধান সদস্য। তাদের মধ্যে প্রকাশ্য দ্বন্দ্ব তেলের উৎপাদন নীতি নিয়ে ঐকমত্যে ফাটল ধরাতে পারে। ৫ জানুয়ারি ২০২৬ ওপেকের ভার্চুয়াল বৈঠক এই কারণে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
সামরিক “লাল রেখা”
সৌদি আরবের “জাতীয় নিরাপত্তা অ-আলোচনাযোগ্য” বক্তব্য ভবিষ্যতে আরও সামরিক পদক্ষেপের ইঙ্গিত দেয়। বর্তমানে প্রায় ১৫ হাজার সৌদি-সমর্থিত যোদ্ধা ইয়েমেন সীমান্তে অবস্থান করছে, যদিও সরাসরি আক্রমণের নির্দেশ এখনো স্পষ্ট নয়।
বৃহত্তর ভূরাজনৈতিক পুনর্গঠন
সৌদি–পাকিস্তান প্রতিরক্ষা চুক্তি মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্র-কেন্দ্রিক নিরাপত্তা কাঠামো থেকে ধীরে সরে যাওয়ার ইঙ্গিত দেয়। দক্ষিণ এশিয়ায়, বিশেষত ভারত, এই চুক্তি উদ্বেগের চোখে দেখা হচ্ছে—কারণ এতে পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণ ও আঞ্চলিক ভারসাম্যের প্রশ্ন জড়িত।
উপসংহার
বর্তমান সৌদি–ইয়েমেন সংকট মূলত সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের মধ্যে দীর্ঘদিনের চাপা দ্বন্দ্বের প্রকাশ। ইয়েমেনে প্রক্সি প্রতিযোগিতা, সম্পদ নিয়ন্ত্রণ এবং পরিবর্তিত আঞ্চলিক নিরাপত্তা ধারণা এই উত্তেজনাকে উসকে দিয়েছে।
সৌদি–পাকিস্তান কৌশলগত প্রতিরক্ষা চুক্তি একটি আলাদা ভূরাজনৈতিক অধ্যায়—যার সঙ্গে ডিসেম্বরের ইয়েমেন ঘটনাবলির সরাসরি যোগ নেই। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, মোহাম্মদ বিন সালমানের পক্ষ থেকে একযোগে আমিরাত ও পাকিস্তানকে আল্টিমেটাম দেওয়ার দাবি প্রামাণ্য উৎসে সমর্থিত নয়।
দায়িত্বশীল বিশ্লেষণের জন্য প্রয়োজন তথ্যনির্ভর বিভাজন—কী ঘটেছে, কে বলেছে এবং কোন দাবি প্রমাণহীন। বর্তমান সংকট সেই পার্থক্য বোঝার একটি গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা।