ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল হুমকি: বাংলাদেশ, শিলিগুড়ি করিডর ও ভারতের কৌশল

siliguri-corridor-chicken-neck-india-security-cartoon
  •  শিলিগুড়ি করিডর ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের একমাত্র স্থল সংযোগ

ভারতীয় দূতাবাস ঘিরে হুমকি: কূটনৈতিক সংকট ও নিরাপত্তা উদ্বেগ

২০২৫ সালের ১৭ ডিসেম্বর ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্ক এক নতুন উত্তেজনার পর্যায়ে প্রবেশ করে। সেদিন ভারতের বিদেশ মন্ত্রক (MEA) ঢাকায় নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার এম. রিয়াজ হামিদুল্লাহকে তলব করে। কূটনৈতিক ক্ষেত্রে এটি একটি অত্যন্ত বিরল ও কঠোর পদক্ষেপ, যা স্পষ্টভাবে দেখায় যে বাংলাদেশে ভারতের কূটনৈতিক নিরাপত্তা নিয়ে দিল্লি গভীরভাবে উদ্বিগ্ন।

এই সিদ্ধান্তের মূল কারণ ছিল ঢাকায় অবস্থিত ভারতীয় হাইকমিশনের চারপাশে নিরাপত্তাহীন পরিস্থিতি তৈরি করার হুমকি। কিছু চরমপন্থী গোষ্ঠী প্রকাশ্যে ঘোষণা করে যে তারা ভারতীয় দূতাবাসকে ঘিরে অস্থিরতা তৈরি করবে। বিষয়টি শুধুই বিচ্ছিন্ন হুমকি ছিল না, বরং বাংলাদেশে ক্রমবর্ধমান ভারত-বিরোধী বক্তব্য ও কর্মকাণ্ডের একটি ধারাবাহিক অংশ।

ভারতের বিদেশ মন্ত্রক জানায়, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার এই ঘটনার যথাযথ তদন্ত করেনি, এমনকি ভারতকে কোনো বিশ্বাসযোগ্য তথ্যও দেয়নি। ফলে ভারতের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে ডিমার্শ (Diplomatic Protest Note) প্রদান করা হয়। এতে স্পষ্ট ভাষায় বলা হয়, কূটনৈতিক মিশনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা প্রতিটি দেশের দায়িত্ব—যা ভিয়েনা কনভেনশন অনুযায়ী বাধ্যতামূলক।

শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ২০২৪ সালের আগস্ট থেকে বাংলাদেশে যে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছে, তার আমলে ভারত-বিরোধী মনোভাব স্পষ্টভাবে বেড়েছে। ছাত্রনেতৃত্বাধীন এই নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতায় কিছু রাজনৈতিক গোষ্ঠী ভারতকে শত্রু হিসেবে তুলে ধরছে। এর ফলে ঢাকায় ভারতীয় কূটনীতিক ও ভারতীয় নাগরিকদের নিরাপত্তা নিয়ে বড় প্রশ্ন তৈরি হয়েছে।


“সেভেন সিস্টার্স” বিচ্ছিন্ন করার হুমকি: হাসনাত আবদুল্লাহর বক্তব্য

২০২৫ সালের ১৫ ডিসেম্বর ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে এক রাজনৈতিক সমাবেশে জাতীয় নাগরিক পার্টির (NCP) নেতা হাসনাত আবদুল্লাহ এমন বক্তব্য দেন, যা সরাসরি ভারতের নিরাপত্তার বিরুদ্ধে হুমকি হিসেবে ধরা হয়।

তিনি প্রকাশ্যে বলেন, বাংলাদেশ যদি অস্থিতিশীল হয়, তবে সেই “প্রতিরোধের আগুন” ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়বে। তিনি আরও বলেন, ভারত যদি বাংলাদেশের বিরোধী শক্তিকে আশ্রয় দেয়, তবে বাংলাদেশও ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের আশ্রয় দেবে এবং “সেভেন সিস্টার্স” রাজ্যগুলিকে ভারতের মূল ভূখণ্ড থেকে আলাদা করে দেবে।

এই বক্তব্যে স্পষ্টভাবে ভারতের সাতটি উত্তর-পূর্ব রাজ্য—
অরুণাচল প্রদেশ, অসম, মণিপুর, মেঘালয়, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড ও ত্রিপুরা—এর কথা বলা হয়।

ভারতের দৃষ্টিতে এটি শুধুই রাজনৈতিক বক্তব্য নয়, বরং রাষ্ট্রের অখণ্ডতার বিরুদ্ধে প্রকাশ্য হুমকি

বাংলাদেশের মন্তব্যে উত্তর–পূর্ব ভারত নিয়ে উত্তেজনা: হিমন্ত বিশ্ব শর্মার কঠোর বার্তা


এই বক্তব্যের রাজনৈতিক পটভূমি

হাসনাত আবদুল্লাহ বাংলাদেশে শেখ হাসিনা বিরোধী আন্দোলনের সময় উঠে আসা এক পরিচিত মুখ। তার দল NCP মূলত সেই ছাত্র আন্দোলনের ফল, যা ২০২৪ সালে সরকারের পতন ঘটায়।

নতুন রাজনৈতিক শক্তিগুলো মনে করে, ভারত দীর্ঘদিন ধরে আওয়ামী লীগ সরকারের খুব কাছের মিত্র ছিল। সেই ক্ষোভ থেকেই ভারতের বিরুদ্ধে কঠোর বক্তব্য দিয়ে তারা নিজেদের দেশপ্রেমিক হিসেবে তুলে ধরতে চাইছে।

অর্থাৎ, হাসনাতের বক্তব্যের দুটি উদ্দেশ্য ছিল—

  1. বাইরে ভারতের ওপর চাপ তৈরি করা(I dont think,India cares about such statements)

  2. দেশের ভেতরে জাতীয়তাবাদী সমর্থন বাড়ানো(Elections are coming))

এই কারণেই তার বক্তব্যে ভারত-বিরোধী স্লোগান ও বিচ্ছিন্নতাবাদী হুমকি ব্যবহার করা হয়েছে।


অতীত ইতিহাস ও বিচ্ছিন্নতাবাদ প্রসঙ্গ

বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্মৃতিতে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময়কার অভিজ্ঞতা আজও জীবিত। তখন ভারতের মাটি থেকেই অনেক মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। এই ইতিহাসের কারণে “অন্য দেশের মাটিতে বিদ্রোহীদের আশ্রয়” বিষয়টি বাংলাদেশে সংবেদনশীল।

এছাড়া সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সীমান্তে পুশ-ইন, অবৈধ অনুপ্রবেশ, এবং ২০২৫ সালের মে মাসে প্রায় ১৬০০ জনকে বাংলাদেশে পাঠানো—এসব ঘটনাও উত্তেজনা বাড়িয়েছে।

এই কারণেই হাসনাতের বক্তব্য শুধু স্লোগান হিসেবেই নয়, সম্ভাব্য নীতিগত ইঙ্গিত হিসেবেও দেখা হচ্ছে।(If they will able to make govt)


শিলিগুড়ি করিডর: ভারতের সবচেয়ে সংবেদনশীল ভূখণ্ড

ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে মূল ভূখণ্ডকে যুক্ত করে একমাত্র স্থলপথ হলো শিলিগুড়ি করিডর, যাকে বলা হয় “চিকেনস নেক”।

এই করিডরের প্রস্থ মাত্র ২২ কিলোমিটার। এই পথ দিয়েই—

  • সেনা রসদ

  • অস্ত্র

  • খাদ্য

  • জ্বালানি

  • সাধারণ নাগরিকদের চলাচল

সবকিছু হয়।

প্রায় ৫ কোটি মানুষের জীবনরেখা এই করিডর।


কেন শিলিগুড়ি করিডর ঝুঁকিপূর্ণ

এই করিডরের চারদিকে রয়েছে—

  • উত্তরে নেপাল

  • উত্তর-পূর্বে ভুটান

  • দক্ষিণে বাংলাদেশ

  • পূর্বে চীন

অর্থাৎ, চারদিক থেকেই চাপের সম্ভাবনা।

এই কারণেই ভারত বহু বছর ধরে এখানে সবচেয়ে শক্তিশালী সেনা মোতায়েন করেছে।


অতীতের বিদেশি হস্তক্ষেপ

১৯৬০ ও ৭০-এর দশকে চীন নাগা ও মিজো বিদ্রোহীদের অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ দিয়েছিল।
পাকিস্তানের আইএসআই ১৯৯০–২০০৪ সালের মধ্যে একাধিক উত্তর-পূর্ব বিদ্রোহী গোষ্ঠীকে সহায়তা করেছে।

বর্তমানে গোয়েন্দা রিপোর্ট অনুযায়ী—

  • আইএসআই-এর স্লিপার সেল এখনো আছে

  • বাংলাদেশে উগ্রপন্থার পুনরুত্থান হয়েছে

এতে ভারতের উদ্বেগ আরও বেড়েছে।


লালমনিরহাট বিমানঘাঁটি ও চীনের ভূমিকা

বাংলাদেশের লালমনিরহাটে একটি পুরনো বিমানঘাঁটি আছে, যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্যবহৃত হতো। সম্প্রতি এই বিমানঘাঁটি নতুন করে চালু করার আলোচনা শুরু হয়েছে, যেখানে চীনের সহায়তার কথা শোনা যাচ্ছে

এই ঘাঁটি—

  • ভারতের সীমান্ত থেকে ২০ কিমি দূরে

  • শিলিগুড়ি করিডর থেকে প্রায় ১০০ কিমি

এখান থেকে নজরদারি, গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ এবং ভবিষ্যতে সামরিক কার্যক্রম চালানো সম্ভব।

ভারতের কাছে এটি একটি ডুয়াল-ইউজ হুমকি—বেসামরিক হলেও সামরিক কাজে ব্যবহার করা যাবে।


ভারতের পাল্টা কৌশল: সেনা ও অর্থনীতি

নতুন সেনা ঘাঁটি

২০২৫ সালের নভেম্বর মাসে ভারত তিনটি নতুন সেনা ঘাঁটি চালু করে—

  • ধুবড়ির কাছে বামুনি

  • কিশানগঞ্জ

  • চোপড়া

এগুলো ত্রিশক্তি কোর-এর অধীনে।

এখানে রয়েছে—

  • S-400 এয়ার ডিফেন্স

  • ব্রহ্মোস মিসাইল

  • আকাশ মিসাইল

  • আধুনিক ট্যাঙ্ক ও সেনা ইউনিট


কৈলাশহর বিমানঘাঁটির পুনর্জীবন

ত্রিপুরার কৈলাশহর বিমানঘাঁটি ১৯৭১ সালে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল। এখন আবার সেটি চালু করা হচ্ছে।

এর ফলে—

  • সীমান্ত নজরদারি

  • দ্রুত সেনা মোতায়েন

  • চীন-বাংলাদেশ জোটের পাল্টা উপস্থিতি

সবই সম্ভব।


দীর্ঘমেয়াদি বিমান মহড়া

২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০২৬ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত ভারত উত্তর-পূর্বে বিশাল বিমান মহড়া চালায়।

রাফাল যুদ্ধবিমানসহ একাধিক স্কোয়াড্রন অংশ নেয়।

এটি একটি স্পষ্ট বার্তা—
ভারত প্রস্তুত এবং সতর্ক।


অর্থনৈতিক চাপ

২০২৫ সালের এপ্রিল মাসে ভারত বাংলাদেশকে দেওয়া ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বন্ধ করে দেয়।

এর ফলে—

  • বাংলাদেশি পণ্য

  • ভুটান, নেপাল, মায়ানমারে যেতে পারে না

মে মাসে আরও কঠোর সিদ্ধান্ত—

  • গার্মেন্টস

  • খাবার

  • প্লাস্টিক

  • আসবাব

এসব স্থলপথে আমদানি নিষিদ্ধ।

বাংলাদেশের প্রায় ৪২% রপ্তানি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।


রাজনৈতিক বার্তা

অসমের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা স্পষ্ট ভাষায় বলেন—

“ভারতের একটি চিকেন নেক, বাংলাদেশের দুটি। ওরা যদি আমাদেরটা আঘাত করে, আমরা ওদের দুটোই আঘাত করতে পারি।”

এই বক্তব্যেই কৌশলগত বাস্তবতা পরিষ্কার।


কেন উত্তর-পূর্বাঞ্চল বিচ্ছিন্ন করা অসম্ভব

সামরিক দিক থেকে

ভারতের শক্তির তুলনায় বাংলাদেশ দাঁড়াতে পারে না।

ভৌগোলিক দিক থেকে

উত্তর-পূর্বে সমুদ্রপথ নেই। সব রাস্তাই ভারতের ভেতর দিয়ে।

রাজনৈতিক দিক থেকে

বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার দুর্বল ও বিভক্ত।


উপসংহার

বর্তমান পরিস্থিতি উত্তেজনাপূর্ণ হলেও বাস্তবতা পরিষ্কার—

  • শিলিগুড়ি করিডর সুরক্ষিত

  • উত্তর-পূর্ব বিচ্ছিন্ন করা অসম্ভব

  • ভারতের পাল্টা শক্তি অনেক বেশি

ভারতের কৌশলগত দৃঢ়তা এই সংকটকে নিয়ন্ত্রণে রেখেছে।
হাসনাত আবদুল্লাহর বক্তব্য রাজনৈতিক শব্দবাজি—
বাস্তব শক্তির প্রতিফলন নয়।

বাংলাদেশের মন্তব্যে উত্তর–পূর্ব ভারত নিয়ে উত্তেজনা: হিমন্ত বিশ্ব শর্মার কঠোর বার্তা

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

যদি আপনার কোনও বিষয়ে ডাউট থাকে বা কোনও বিষয় suggest করতে চান তাহলে মেল করুন!

নবীনতর পূর্বতন

banglafacts 4