বাংলাদেশের মন্তব্যে উত্তর–পূর্ব ভারত নিয়ে উত্তেজনা: হিমন্ত বিশ্ব শর্মার কঠোর বার্তা


ভারতের উত্তর–পূর্বাঞ্চলকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের কিছু রাজনৈতিক মহল থেকে উঠে আসা সাম্প্রতিক মন্তব্য ঘিরে দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন করে উত্তেজনা তৈরি হয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে অসমের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা যে কঠোর ও স্পষ্ট প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন, তা শুধু একটি রাজ্য সরকারের বক্তব্য নয়—বরং ভারতের সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক অখণ্ডতা রক্ষায় দিল্লির কঠোর অবস্থানের প্রতিফলন হিসেবেই দেখা হচ্ছে।

২০২৫ সালের ১৫ থেকে ১৭ ডিসেম্বরের মধ্যে দেওয়া একাধিক বক্তব্যে হিমন্ত বিশ্ব শর্মা বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বের উদ্দেশে এমন ভাষা ব্যবহার করেছেন, যা সাম্প্রতিক ভারত–বাংলাদেশ কূটনৈতিক সম্পর্কে এক উল্লেখযোগ্য মোড় হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।


উত্তেজনার সূত্রপাত: ঢাকার বক্তব্য কী ছিল?

এই উত্তেজনার সরাসরি সূত্রপাত ঘটে ২০২৫ সালের ১৬ ডিসেম্বর ঢাকায়। বাংলাদেশের সদ্য গঠিত রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল সিটিজেন পার্টি (NCP)–এর শীর্ষ নেতা হাসনাত আব্দুল্লাহ ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে এক জনসভায় বক্তব্য রাখতে গিয়ে ভারতের বিরুদ্ধে সরাসরি হুমকিমূলক ভাষা ব্যবহার করেন।

তার বক্তব্যে তিনি বলেন—

“যদি ভারত বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করে, তাহলে বাংলাদেশও উত্তর–পূর্ব ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী ও ভারতবিরোধী শক্তিগুলিকে আশ্রয় দেবে এবং প্রয়োজনে ‘সেভেন সিস্টার্স’কে ভারতের মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেবে।”

এই বক্তব্যে তিনি আরও দাবি করেন যে বাংলাদেশ চাইলে উত্তর–পূর্ব ভারতকে “আলাদা করে দেওয়ার” মতো কৌশলগত পদক্ষেপ নিতে পারে।

এই মন্তব্য শুধু কূটনৈতিক শালীনতার সীমা লঙ্ঘনই করেনি, বরং সরাসরি ভারতের ভৌগোলিক অখণ্ডতাকে চ্যালেঞ্জ করেছে বলে দিল্লি ও গুয়াহাটি—উভয় জায়গাতেই তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে।


হিমন্ত বিশ্ব শর্মার পাল্টা জবাব: ভাষা ও বার্তার কঠোরতা

অসমের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা এই বক্তব্যকে “ভিত্তিহীন, বিপজ্জনক ও উসকানিমূলক” বলে আখ্যা দেন। সংবাদমাধ্যমে প্রতিক্রিয়া জানিয়ে তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলেন—

“ভারত একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র। ভারত আজ একটি পারমাণবিক শক্তিধর দেশ, দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতি এবং বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম অর্থনীতি। বাংলাদেশ কীভাবে এমন চিন্তা করতে পারে?”

শর্মা স্পষ্ট করে দেন যে ভারত প্রতিবেশীদের সঙ্গে সহযোগিতায় বিশ্বাস করে, কিন্তু জাতীয় ঐক্য ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে কোনও আপস করা হবে না

তিনি আরও সতর্ক করে বলেন, বাংলাদেশ যদি এ ধরনের বক্তব্য ও আচরণ চালিয়ে যায়, তাহলে ভারত নীরব দর্শকের ভূমিকায় থাকবে না এবং প্রয়োজনে “উপযুক্ত শিক্ষা দিতে দ্বিধা করবে না”।


‘চিকেন নেক’ তত্ত্ব: ভৌগোলিক বাস্তবতার কঠোর স্মরণ

হিমন্ত বিশ্ব শর্মার বক্তব্যের সবচেয়ে আলোচিত ও বিতর্কিত অংশ হলো তথাকথিত “চিকেন নেক ডকট্রিন”। এই ভৌগোলিক যুক্তি তিনি আগেও একাধিকবার ব্যবহার করেছেন, তবে এবার তা আরও স্পষ্ট ও আক্রমণাত্মকভাবে তুলে ধরেন।

ভারতের চিকেন নেক: শিলিগুড়ি করিডোর

ভারতের উত্তর–পূর্বাঞ্চলকে মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে যুক্ত করেছে পশ্চিমবঙ্গের শিলিগুড়ি করিডোর, যার প্রস্থ মাত্র ২০–২২ কিলোমিটার। এই করিডোরকে দীর্ঘদিন ধরেই ভারতের কৌশলগত দুর্বলতা হিসেবে দেখা হয়।


বাংলাদেশের “দুটি চিকেন নেক”: হিমন্তর বিশ্লেষণ

হিমন্ত বিশ্ব শর্মার দাবি অনুযায়ী, বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থানেও দুটি বড় কৌশলগত দুর্বলতা রয়েছে—

১) উত্তর বাংলাদেশের করিডোর

দক্ষিণ দিনাজপুর থেকে দক্ষিণ–পশ্চিম গারো পাহাড় পর্যন্ত বিস্তৃত প্রায় ৮০ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি সংকীর্ণ ভূখণ্ড। এই অংশ বিচ্ছিন্ন হলে বাংলাদেশের পুরো রংপুর বিভাগ কার্যত দেশের বাকি অংশ থেকে আলাদা হয়ে যাবে।

২) চট্টগ্রাম করিডোর

দক্ষিণ ত্রিপুরা থেকে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত প্রায় ২৮ কিলোমিটার চওড়া একটি সংকীর্ণ করিডোর। এই পথই বাংলাদেশের অর্থনৈতিক রাজধানী চট্টগ্রাম বন্দরকে দেশের মূল প্রশাসনিক কাঠামোর সঙ্গে যুক্ত করে।

এই প্রেক্ষাপটে হিমন্ত বিশ্ব শর্মার বহুল আলোচিত মন্তব্য—

“ভারতের একটি চিকেন নেক আছে। কিন্তু বাংলাদেশের আছে দুটি। যদি বাংলাদেশ আমাদের চিকেন নেক স্পর্শ করার চেষ্টা করে, তাহলে ভারত বাংলাদেশের দুইটি চিকেন নেকেই আঘাত হানবে।”

এই বক্তব্য কেবল রাজনৈতিক নয়, স্পষ্টভাবে একটি কৌশলগত প্রতিরোধ বার্তা বহন করে।


সামরিক সক্ষমতার প্রসঙ্গ: অপারেশন সিঁদুরের উল্লেখ

নিজের বক্তব্যকে আরও শক্তিশালী করতে হিমন্ত বিশ্ব শর্মা ভারতের সাম্প্রতিক সামরিক অভিযানের প্রসঙ্গও টেনে আনেন। তিনি অপারেশন সিঁদুর–এর উদাহরণ দেন, যেখানে ভারত পাকিস্তানের অভ্যন্তরে জঙ্গি ঘাঁটি ও সামরিক স্থাপনায় সফল আঘাত হানে।

এই প্রসঙ্গে তিনি মন্তব্য করেন—

“ভারতের সামরিক শক্তির সঙ্গে টক্কর দিতে গেলে বাংলাদেশকে ১৪ বার নতুন করে জন্ম নিতে হবে।”

এই মন্তব্য কূটনৈতিক দৃষ্টিতে অত্যন্ত কঠোর হলেও, এতে ভারতের প্রতিরোধমূলক কৌশল (Deterrence Strategy) স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে।


‘সেভেন সিস্টার্স’: কেন এত সংবেদনশীল এই অঞ্চল?

বাংলাদেশের মন্তব্যে যেসব রাজ্যের কথা বলা হয়েছে, সেগুলি ভারতের উত্তর–পূর্বাঞ্চলের সাতটি রাজ্য—

  1. অরুণাচল প্রদেশ

  2. অসম

  3. মণিপুর

  4. মেঘালয়

  5. মিজোরাম

  6. নাগাল্যান্ড

  7. ত্রিপুরা

এর মধ্যে অসম, মেঘালয়, ত্রিপুরা ও মিজোরাম সরাসরি বাংলাদেশের সঙ্গে সীমান্ত ভাগ করে। ফলে এই অঞ্চলে যেকোনো ধরনের বিচ্ছিন্নতাবাদী উসকানি ভারতের জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্নে সরাসরি প্রভাব ফেলে।


বাংলাদেশের বক্তব্য: বিচ্ছিন্ন ঘটনা নাকি ধারাবাহিক প্রবণতা?

হিমন্ত বিশ্ব শর্মা দাবি করেন, এটি কোনও বিচ্ছিন্ন বক্তব্য নয়। গত এক বছরে বাংলাদেশের বিভিন্ন মহল থেকে উত্তর–পূর্ব ভারত নিয়ে ধারাবাহিকভাবে আপত্তিকর মন্তব্য এসেছে।

তিনি বিশেষভাবে উল্লেখ করেন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ও নোবেলজয়ী মুহাম্মদ ইউনুস–এর একটি পুরনো মন্তব্য, যেখানে ইউনুস বলেছিলেন—

“ভারতের উত্তর–পূর্বাঞ্চল স্থলবেষ্টিত এবং তাদের সমুদ্রের একমাত্র অভিভাবক বাংলাদেশ।”

এই মন্তব্য চীনে দেওয়া হয়েছিল, যা ভারতের কাছে বিশেষভাবে উদ্বেগজনক বলে বিবেচিত হয়েছে।


ভারতের সরকারি অবস্থান: কড়া বার্তার অন্তর্নিহিত অর্থ

হিমন্ত বিশ্ব শর্মার বক্তব্যকে অনেকেই কেবল রাজ্য রাজনীতির বক্তব্য বলে উড়িয়ে দিলেও, বাস্তবে এটি ভারতের বৃহত্তর কৌশলগত অবস্থানেরই প্রতিফলন।

বার্তাটি স্পষ্ট—

  • ভারতের আঞ্চলিক অখণ্ডতা প্রশ্নাতীত

  • বিচ্ছিন্নতাবাদ উসকে দেওয়া শত্রুতামূলক কাজ হিসেবে বিবেচিত হবে

  • প্রতিবেশী রাষ্ট্রের রাজনৈতিক বক্তব্যও নিরাপত্তা ঝুঁকি হিসেবে মূল্যায়িত হবে

এই অবস্থান দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের লাল রেখা (Red Lines) স্পষ্ট করে দিয়েছে।


উপসংহার

বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক বক্তব্য এবং তার জবাবে হিমন্ত বিশ্ব শর্মার কঠোর প্রতিক্রিয়া শুধুমাত্র দ্বিপাক্ষিক বাকযুদ্ধ নয়। এটি উত্তর–পূর্ব ভারতের নিরাপত্তা, দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতি এবং ভারতের প্রতিরোধমূলক কৌশলের একটি স্পষ্ট বার্তা।

এই ঘটনা প্রমাণ করে, ভারত তার উত্তর–পূর্বাঞ্চল নিয়ে কোনও ধরনের ছাড় দিতে প্রস্তুত নয়—সে বক্তব্য যতই রাজনৈতিক হোক বা কূটনৈতিক আবরণের আড়ালে থাকুক না কেন।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

যদি আপনার কোনও বিষয়ে ডাউট থাকে বা কোনও বিষয় suggest করতে চান তাহলে মেল করুন!

নবীনতর পূর্বতন

banglafacts 4