ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে এক ঐতিহাসিক বাণিজ্য চুক্তি চূড়ান্ত হওয়ার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছে। এই চুক্তি কার্যকর হলে ভারতীয় রপ্তানিপণ্যের উপর যুক্তরাষ্ট্রের আরোপিত শুল্ক ৫০% থেকে নেমে মাত্র ১৫-১৬% হতে পারে — যা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সরকারের জন্য এক বিরাট কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক সাফল্য হিসেবে দেখা হচ্ছে।
এই সাফল্যের পেছনে রয়েছে দীর্ঘ মাসব্যাপী উচ্চপর্যায়ের আলোচনা, যেখানে নয়াদিল্লি রাশিয়ান তেলের আমদানি এবং কৃষিখাতের বাজার প্রবেশাধিকারকে চতুরভাবে আলোচনার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে।
উচ্চপর্যায়ের আলোচনা: মোদী-ট্রাম্প ফোনালাপের পর মোড় ঘোরে
২০২৫ সালের ২২ অক্টোবর, দীপাবলির দিন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যে ফোনালাপের পরই পরিস্থিতি নতুন দিকে মোড় নেয়। ট্রাম্প পরবর্তীতে জানান, আলোচনাটি মূলত বাণিজ্য নিয়ে হয়েছিল। তবে মোদীর দপ্তর থেকে জারি করা বিবৃতিতে জোর দেওয়া হয় “সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ অবস্থান”-এর উপর, যেখানে রাশিয়ান তেল আমদানির প্রসঙ্গ সরাসরি উল্লেখ করা হয়নি।
এই সূক্ষ্ম কূটনৈতিক ভারসাম্য দেখায়, কতটা জটিল ছিল আলোচনাগুলি। কারণ যুক্তরাষ্ট্র ভারতীয় পণ্যের ওপর এশিয়ার মধ্যে সর্বোচ্চ ৫০% শুল্ক আরোপ করেছিল — যার মধ্যে ২৫% ছিল “পারস্পরিক” শুল্ক এবং অতিরিক্ত ২৫% ছিল রাশিয়ান তেল কেনার জন্য আরোপিত শাস্তিমূলক শুল্ক। এই পদক্ষেপ প্রায় ৫০ বিলিয়ন ডলারের ভারতীয় রপ্তানি বাজারকে বিপদের মুখে ফেলে দেয়, বিশেষ করে টেক্সটাইল, রত্ন ও গয়না, ওষুধ এবং সামুদ্রিক খাদ্য শিল্পে।
“কর্ন কানেকশন”: ভুট্টা হলো কূটনীতির মূল চাল
এই বাণিজ্য চুক্তির কেন্দ্রে রয়েছে এক আশ্চর্যজনক পণ্য — ভুট্টা (কর্ন)। যুক্তরাষ্ট্রে চীন যখন বাণিজ্যযুদ্ধের জেরে ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনার দিকে ভুট্টা ক্রয় ঘুরিয়ে দেয়, তখন আমেরিকান কৃষকেরা নতুন বাজারের সন্ধানে মরিয়া হয়ে ওঠে।
ভারতে বর্তমানে বছরে মাত্র ০.৫ মিলিয়ন টন ভুট্টা ১৫% রেয়াতি শুল্কে আমদানি করা যায়। এর বেশি আমদানি করলে শুল্ক বেড়ে দাঁড়ায় ৫০%। তাছাড়া ভারত জেনেটিক্যালি মডিফায়েড (GM) ফসল আমদানি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করেছে, অথচ আমেরিকার প্রায় ৯০% ভুট্টাই জিএম-ভিত্তিক।
এই প্রেক্ষাপটে ভারত যুক্তরাষ্ট্রের জন্য নন-জিএম ভুট্টা ও সয়ামিল আমদানির কোটা বৃদ্ধি করার প্রস্তাব বিবেচনা করছে, তবে শুল্ক ১৫% সীমার মধ্যেই রাখছে। এতে যুক্তরাষ্ট্র তার উদ্বৃত্ত কৃষিপণ্য বিক্রির বাজার পাবে, আবার ভারতও নিজের প্রয়োজন মেটাতে পারবে।
ভারতের ভেতরে ভুট্টার চাহিদা: এথানল যুগের উত্থান
ভারতের E20 এথানল মিশ্রণ কর্মসূচি, যেখানে পেট্রোলে ২০% এথানল মেশানোর লক্ষ্য নেওয়া হয়েছে, তার ফলে দেশে ভুট্টার চাহিদা বেড়েছে বহুগুণে। পশুখাদ্য ও দুগ্ধ শিল্পও এই চাহিদাকে আরও বাড়াচ্ছে।
২০২৪-২৫ অর্থবছরে ভারত প্রথমবারের মতো নেট আমদানিকারক দেশ হয়ে পড়ে, প্রায় ১ মিলিয়ন টন ভুট্টা আমদানি করে মিয়ানমার ও ইউক্রেন থেকে — যেগুলো উভয়ই নন-জিএম ভুট্টার সরবরাহকারী। এই বাস্তবতা ভারতের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কৃষি বাণিজ্য সমঝোতাকে যৌক্তিক করে তুলেছে।
রাশিয়ান তেলের প্রসঙ্গ: চাপ ও কৌশলের মিশেল
ভারত বর্তমানে তার মোট অপরিশোধিত তেল আমদানির প্রায় এক-তৃতীয়াংশ, অর্থাৎ প্রায় ১.৭ মিলিয়ন ব্যারেল প্রতিদিন, রাশিয়া থেকে আমদানি করে। ২০২২ সালের ইউক্রেন আক্রমণের পর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার পরিপ্রেক্ষিতে রাশিয়া তেল বিক্রিতে ছাড় দিতে শুরু করে, যা ভারতের জন্য লাভজনক হয়ে ওঠে।
তবে যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক নিষেধাজ্ঞা (বিশেষত Rosneft ও Lukoil-এর উপর) ভারতীয় রিফাইনারদের জন্য চাপ বাড়ায়। রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজসহ কয়েকটি বড় কোম্পানি রাশিয়ান তেল ক্রয় কমানোর ঘোষণা দিয়েছে।
ফলে মার্কিন প্রশাসনের দৃষ্টিতে ভারতের প্রতি ২৫% “শাস্তিমূলক” শুল্ক তুলে নেওয়ার পথ তৈরি হয়েছে। যেহেতু তেলের দামে ছাড়ও এখন মাত্র $১.৮–$২.২ প্রতি ব্যারেল, রাশিয়ান তেলের অর্থনৈতিক সুবিধা আগের মতো নেই। মোদীর সরকার এই বাস্তবতাকে কাজে লাগিয়ে আলোচনায় যুক্তরাষ্ট্রের চাপকে দক্ষভাবে মোকাবিলা করেছে।
এশিয়ার প্রতিযোগী দেশগুলির তুলনায় ভারতের অবস্থান
বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের গড় শুল্কহার এশিয়ার দেশগুলোর জন্য নিম্নরূপ:
| দেশ | গড় শুল্কহার (%) |
|---|---|
| জাপান | ১৫ |
| মালয়েশিয়া | ১৯ |
| ইন্দোনেশিয়া | ১৯ |
| থাইল্যান্ড | ১৯ |
| বাংলাদেশ | ২০ |
| ভিয়েতনাম | ২০ |
| পাকিস্তান | ১৯ |
যদি ভারত ১৫–১৬% শুল্ক হার পায়, তাহলে এটি বাংলাদেশের, পাকিস্তানের বা ভিয়েতনামের তুলনায় অনেক সুবিধাজনক অবস্থানে চলে আসবে। তবে নয়াদিল্লি চাইছে ১৫%-এর নিচে নামাতে — যাতে ভারত এশিয়ার সবচেয়ে কম শুল্কভুক্ত দেশ হয়।
যুক্তরাষ্ট্র এতে কিছুটা অনিচ্ছুক, কারণ এটি আসিয়ান গড় ১৯–২০% থেকে অনেক কম। এক মার্কিন কর্মকর্তা মন্তব্য করেছেন:
“আমরা কতটা রেয়াত দেব, তা নির্ভর করছে ভারত সরকার কতটা বাজার উন্মুক্ত করতে চায় তার উপর।”
রাজনৈতিক সময়ের হিসাব: কেন বিলম্ব?
যদিও আলোচনার কাঠামো তৈরি, কিন্তু ঘোষণার সময় নিয়ে দুই দেশেই রাজনীতি কাজ করছে।
ভারত নভেম্বর মাসে বিহার নির্বাচনের আগে কৃষক-সংবেদনশীল কোনও ঘোষণা দিতে চায় না, কারণ রাজ্যটি ভুট্টা ও সয়াবিন উৎপাদনের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। মোদী তাই আসিয়ান সম্মেলনে (২৬–২৮ অক্টোবর) ভার্চুয়ালি অংশ নিচ্ছেন — যাতে ট্রাম্পের সঙ্গে মুখোমুখি সাক্ষাৎ না করেই সময় কেনা যায়।
অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রও চাইছে ২০২৬ সালের মধ্যবর্তী নির্বাচনের আগে আমেরিকান কৃষকদের জন্য ইতিবাচক সঙ্কেত দিতে। তবে বাণিজ্যমন্ত্রী পীযূষ গয়াল স্পষ্টভাবে বলেছেন:
“আমরা কখনও বন্দুকের নল দেখিয়ে চুক্তি করি না, আমরা তাড়াহুড়ো করেও করি না।”
দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য কাঠামো: ‘মিশন ৫০০’ উদ্যোগ
এই চুক্তি হলো ভবিষ্যতের বৃহত্তর Bilateral Trade Agreement (BTA)-এর প্রথম ধাপ। ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে মোদীর হোয়াইট হাউস সফরের সময় শুরু হওয়া এই উদ্যোগের লক্ষ্য ২০৩০ সালের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য $১৯১ বিলিয়ন থেকে বাড়িয়ে $৫০০ বিলিয়ন করা — যার নাম “মিশন ৫০০”।
মার্চ ২০২৫ থেকে এখন পর্যন্ত পাঁচ দফা বৈঠক সম্পন্ন হয়েছে, এবং কর্মকর্তারা জানিয়েছেন দুই দেশের অবস্থানের মধ্যে এখন “খুব কম পার্থক্য” রয়ে গেছে। আইনি ভাষা নিয়ে কাজ চলছে এবং বেশিরভাগ কৃষি-সংক্রান্ত বিষয়েও ঐকমত্য হয়েছে।
মোদীর কূটনৈতিক মাস্টারস্ট্রোক: কৌশল ও সাফল্য
এই চুক্তি কেবল অর্থনৈতিক নয়, কূটনৈতিক দিক থেকেও মোদীর এক বিশাল সাফল্য হিসেবে গণ্য হচ্ছে।
কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন বজায় রেখে আলোচনা:
ভারত নিজের নীতি থেকে বিচ্যুত না হয়ে বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েছে। রাশিয়ান তেল আমদানি কমলেও সেটি বাজারের স্বাভাবিক পরিবর্তনের ফল হিসেবে দেখানো হয়েছে, কোনও চাপের ফল নয়।
কৃষি বাজারকে আলোচনার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার:
ভারত খুব বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে শুধুমাত্র নন-জিএম ভুট্টা ও সয়ামিল আমদানির সুযোগ দিচ্ছে, যা খাদ্যশস্য উৎপাদক কৃষকদের ক্ষতি না করে জ্বালানি ও পশুখাদ্য খাতকে সহায়তা করবে।
বাজার বাস্তবতাকে সময়মতো কাজে লাগানো:
যখন আমেরিকান কৃষকেরা চীনা বাজার হারিয়ে হতাশ, আর ভারত নিজের অভ্যন্তরীণ ঘাটতি মোকাবিলায় আমদানির পথে — তখন উভয় দেশের স্বার্থ মিলেছে।
আঞ্চলিক প্রতিযোগিতায় সুবিধা অর্জন:
শুল্ক ৫০% থেকে ১৫%-এ নামলে ভারতীয় রপ্তানিপণ্য যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে আবারও প্রতিযোগিতামূলক হয়ে উঠবে, যা টেক্সটাইল, ফার্মা, রত্ন, গয়না প্রভৃতি শিল্পে নতুন গতি আনবে।
বহুমাত্রিক সহযোগিতা:
এই চুক্তি শুধু বাণিজ্য নয় — এর আওতায় জ্বালানি সহযোগিতা, প্রতিরক্ষা, প্রযুক্তি স্থানান্তর ও ক্রিটিক্যাল মিনারেল সরবরাহ চেইনও অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
অসমাপ্ত ইস্যু ও সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জ
তবুও কিছু বিতর্ক রয়ে গেছে। যুক্তরাষ্ট্র ভারতের “কোয়ালিটি কন্ট্রোল অর্ডার” নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে, যা তাদের রপ্তানিতে বাধা সৃষ্টি করছে। ভারত আবার দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে মার্কিন দুগ্ধজাত পণ্য (যেমন চিজ ও প্রিমিয়াম ডেইরি প্রোডাক্ট) আমদানির প্রস্তাব।
চুক্তিতে এমন একটি প্রক্রিয়া থাকবে, যার মাধ্যমে নির্দিষ্ট সময় অন্তর দুই দেশ শুল্ক ও বাজার প্রবেশাধিকার পুনর্মূল্যায়ন করবে — যা ভবিষ্যতে নতুন সংঘাতের জন্ম দিতে পারে।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, রাশিয়ান তেল আমদানির জন্য আরোপিত ২৫% শাস্তিমূলক শুল্ক নভেম্বরের পর উঠতে পারে, তবে ২৫% “পারস্পরিক” শুল্ক ২০২৬ সালের মার্চ পর্যন্ত বহাল থাকতে পারে।
উপসংহার: ভারতের কূটনৈতিক বিজয়
এই আসন্ন ভারত-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্য চুক্তি নিঃসন্দেহে প্রধানমন্ত্রী মোদীর এক বিরাট কূটনৈতিক সাফল্য। যে সংকট একসময় দুই দেশের সম্পর্ককে টানটান করেছিল, সেটিকেই মোদী দক্ষতার সঙ্গে নিজের কূটনৈতিক শক্তিতে রূপান্তরিত করেছেন।
রাশিয়ান তেলের ওপর মার্কিন চাপকে মোকাবিলা করে, সীমিত কৃষি প্রবেশাধিকার দিয়ে, এবং বাস্তব অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটকে কাজে লাগিয়ে ভারত এমন এক শুল্ক সুবিধা পেতে চলেছে যা তার রপ্তানি খাতকে পুনরুজ্জীবিত করবে।
“ভুট্টার বিনিময়ে শুল্ক ছাড়” এই অদ্ভুত সমঝোতা আজ নতুন যুগের প্রতীক — যেখানে কৃষিপণ্য কেবল অর্থনৈতিক সম্পদ নয়, ভূ-রাজনৈতিক কূটনীতির অস্ত্রেও পরিণত হয়েছে।
যদি এই কাঠামো কার্যকর হয়, তবে “মিশন ৫০০” শুধু বাণিজ্যের নয়, বরং ভারত-আমেরিকা সম্পর্কের নতুন ইতিহাস লিখবে — সহযোগিতা, আস্থা ও কৌশলগত অংশীদারিত্বের এক নতুন অধ্যায়।


