এক্সারসাইজ ড্রোন কভচ: ভারতীয় সেনার ভবিষ্যৎ যুদ্ধ প্রস্তুতির নতুন মাইলফলক


ভারতের প্রতিরক্ষা আধুনিকীকরণ যাত্রা ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে এক ঐতিহাসিক বাঁক নিল। ২৫ থেকে ২৮ সেপ্টেম্বর, অরুণাচল প্রদেশের পূর্ব সেক্টরে উচ্চভূমিতে ভারতীয় সেনা "এক্সারসাইজ ড্রোন কভচ" পরিচালনা করল। চার দিনের এই অনুশীলন কেবল একটি সামরিক মহড়া নয়—এটি ভারতের সেনাবাহিনীর পরবর্তী প্রজন্মের যুদ্ধ প্রস্তুতির প্রকৃত রূপকল্প।
ড্রোন প্রযুক্তি, পাল্টা-ড্রোন ব্যবস্থা, মাল্টি-ডোমেইন অপারেশন, উন্নত ট্যাকটিক্স—সবকিছুর সমন্বয়ে এই মহড়া ভবিষ্যৎ যুদ্ধক্ষেত্রের বাস্তব চিত্র ফুটিয়ে তুলেছে।

DRDO D4 system



কৌশলগত প্রেক্ষাপট ও ভৌগোলিক তাৎপর্য

পূর্ব অরুণাচল প্রদেশ: সীমান্তের কৌশলগত কেন্দ্রবিন্দু

ড্রোন কভচ মহড়ার স্থান নির্বাচনই ভারতীয় কৌশলের বার্তা বহন করে। অরুণাচল প্রদেশের পূর্বাঞ্চল চীনের সঙ্গে বাস্তব নিয়ন্ত্রণ রেখা (LAC)-এর এক অতি সংবেদনশীল সীমান্ত। ২০২০ সালের গালওয়ান সংঘর্ষে দেখা গেছে, আধুনিক নজরদারি ও পাল্টা নজরদারি ব্যবস্থার কতটা প্রয়োজন।
হিমালয়ের উচ্চভূমি, প্রতিকূল আবহাওয়া, জটিল ভূপ্রকৃতি—এসবই একে করে তুলেছে ড্রোন ও পাল্টা-ড্রোন প্রযুক্তি পরীক্ষার জন্য আদর্শ ক্ষেত্র।

চীনের ড্রোন কৌশল ও ভারতের প্রতিক্রিয়া

চীন ইতিমধ্যেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা-চালিত কামিকাজে ড্রোন, ড্রোন স্বর্ম এবং উন্নত আনম্যানড সিস্টেম সীমান্ত এলাকায় মোতায়েন করেছে। গোয়েন্দা তথ্য বলছে, PLA (People’s Liberation Army) নিয়মিতভাবে ড্রোন যুদ্ধের মহড়া করছে।
এই প্রেক্ষাপটে ভারতও এক বিস্তৃত নজরদারি নেটওয়ার্ক স্থাপন করেছে এবং "ড্রোন কভচ" মহড়া তার কার্যকারিতা যাচাইয়েরই অংশ।


স্পিয়ার কর্পস: পূর্ব সীমান্তের অভিভাবক

অরুণাচল প্রদেশের এই অঞ্চলে মোতায়েন স্পিয়ার কর্পস পূর্বাঞ্চলীয় প্রতিরক্ষা কৌশলের মূল স্তম্ভ। পূর্বাঞ্চলীয় সেনা প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল রাম চন্দর তিওয়ারির মতে, কর্পস প্রযুক্তিগত আধুনিকীকরণের মাধ্যমে শত্রুর উপর প্রাধান্য বজায় রাখছে।
তাদের হাতে এখন এমন উন্নত UAV রয়েছে, যা ৮০ কিলোমিটার পর্যন্ত নজরদারি চালাতে সক্ষম। এই ক্ষমতা ভারতের সীমান্ত প্রতিরক্ষায় এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে।


প্রযুক্তি ও সক্ষমতার পরীক্ষা

আক্রমণাত্মক ড্রোন প্রযুক্তি

ড্রোন কভচে বিভিন্ন আক্রমণাত্মক ড্রোন প্রযুক্তির কার্যকারিতা পরীক্ষা করা হয়। এর মধ্যে ছিল—

  • কৌশলগত নজরদারি ড্রোন
  • নিখুঁত লক্ষ্যভেদী সিস্টেম
  • স্বয়ংক্রিয় যুদ্ধ ড্রোন
  • সেন্সর-টু-শুটার লিঙ্ক, যা তাৎক্ষণিক তথ্য থেকে নির্ভুল হামলা নিশ্চিত করে

প্রতিরক্ষামূলক পাল্টা-ড্রোন ব্যবস্থা

মহড়ায় সমান গুরুত্ব দেওয়া হয় পাল্টা-ড্রোন প্রযুক্তিকে। সেনা ও ITBP সদস্যরা সক্রিয় ও নিষ্ক্রিয় দুই ধরনের পাল্টা-ড্রোন কৌশল অনুশীলন করেন।

  • ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার সিস্টেম
  • জ্যামিং ও স্পুফিং
  • কাইনেটিক ইন্টারসেপশন (লেজার বা মিসাইল দ্বারা ধ্বংস)
    এই সমন্বিত বহুস্তর প্রতিরক্ষা কৌশল ভবিষ্যৎ ড্রোন হুমকির মোকাবিলায় অত্যন্ত কার্যকর প্রমাণিত হয়।

উন্নত ট্যাকটিক্যাল প্রক্রিয়া ও মাল্টি-ডোমেইন অপারেশন

ড্রোন কভচে নতুনভাবে গঠিত ইউনিট-লেভেল টিমগুলো উন্নত Tactics, Techniques and Procedures (TTPs) অনুশীলন করেছে। এর মধ্যে ছিল—

  • সেনা ও ITBP-র মধ্যে আন্তঃসংযোগ
  • নিরাপদ যোগাযোগ প্রোটোকল
  • আকাশসীমা ব্যবস্থাপনা
  • মানুষ চালিত ও চালকবিহীন উভয় প্ল্যাটফর্মের সমন্বিত ব্যবহার

একই সঙ্গে যুদ্ধক্ষেত্রকে ভূমি, আকাশ, সাইবার ও মহাকাশ—সব ডোমেইনের সমন্বিত আকারে কল্পনা করে অনুশীলন চালানো হয়।


ভারতের পাল্টা-ড্রোন অস্ত্রাগার

DRDO-র ডি-ফোর (D4) সিস্টেম

DRDO D4 system

ভারতের সবচেয়ে বড় অগ্রগতি নিঃসন্দেহে DRDO-র তৈরি D4 সিস্টেম।

  • সফট-কিল: জ্যামিং ও স্পুফিং
  • হার্ড-কিল: লেজার দ্বারা ধ্বংস
  • X-band রাডার, RF ডিটেকশন, EO/IR ক্যামেরা
  • ৩ কিমি দূরত্বে মাইক্রো-ড্রোন শনাক্ত ও জ্যাম করতে সক্ষম
  • AI-ভিত্তিক সনাক্তকরণ ব্যবস্থা, যা পাখি বা ঘুড়ি আর ড্রোনকে আলাদা করতে পারে

বেসরকারি খাতের অবদান

ভারতের প্রতিরক্ষা শিল্পে এখন বেসরকারি কোম্পানির সক্রিয় ভূমিকা:

  • Solar Defence-এর ভর্গবাস্ত্র: মাইক্রো-মিসাইল ভিত্তিক পাল্টা-ড্রোন ব্যবস্থা (রেঞ্জ ২.৫ কিমি)
  • Grene Robotics-এর ইন্দ্রজাল: ৪,০০০ বর্গকিমি জুড়ে ড্রোন ডোম প্রটেকশন ব্যবস্থা

আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও কৌশলগত বার্তা

প্রতিরোধ ও প্রতিরক্ষা অবস্থান

অরুণাচল প্রদেশের সীমান্তবর্তী এলাকায় মহড়া আয়োজন করে ভারত স্পষ্ট বার্তা দিয়েছে—

  • চীনের আক্রমণাত্মক প্রস্তুতির জবাব দিতে ভারত প্রস্তুত
  • প্রযুক্তিগত প্রাধান্য ভারতের হাতে রয়েছে
  • সীমান্তে অগ্রণী প্রতিরক্ষা অবস্থান ভারত ছাড়তে নারাজ

অপারেশন সিন্ধুর শিক্ষা

২০২৫ সালের মে মাসে পাকিস্তানের ৩০০-৫০০ ড্রোন আক্রমণ প্রতিহত করার অভিজ্ঞতা (অপারেশন সিন্ধুর) থেকে শিক্ষা নিয়ে ড্রোন কভচ পরিকল্পনা করা হয়েছিল।
সেই অভিজ্ঞতায় DRDO D4 এবং বহুস্তর প্রতিরক্ষা কার্যকারিতা প্রমাণিত হয়েছিল। এই অভিজ্ঞতাই মহড়ার বাস্তববাদী চিত্রনাট্যে প্রতিফলিত হয়।


ভবিষ্যৎ যুদ্ধ প্রস্তুতি

সেনার আধুনিকীকরণের রূপরেখা

"ড্রোন কভচ" কেবল একটি মহড়া নয়, এটি ভারতের সেনা আধুনিকীকরণের বৃহত্তর কৌশলের অংশ।

  • এক্সারসাইজ দিব্যদৃষ্টি (সিকিম)
  • এক্সারসাইজ ড্রোন প্রহার (ত্রিপুরা)

এই ধারাবাহিক মহড়াগুলি ভারতকে নেটওয়ার্ক-কেন্দ্রিক যুদ্ধ ও ডিজিটাল যুদ্ধক্ষেত্রের জন্য প্রস্তুত করছে।

"ডেকেড অফ ট্রান্সফরমেশন"

ভারতীয় সেনার দশকব্যাপী আধুনিকীকরণ নীতিতে ড্রোন যুদ্ধকে ভবিষ্যৎ লড়াইয়ের কেন্দ্রে রাখা হয়েছে।

  • স্বয়ংক্রিয় সিস্টেম
  • তথ্য সংহতি
  • দ্রুত সিদ্ধান্তগ্রহণ
    এই তিনটি উপাদানই আগামী যুদ্ধক্ষেত্রে জয়-পরাজয় নির্ধারণ করবে।

আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট

ভারতের এই অগ্রগতি বৈশ্বিক বাজারেও প্রভাব ফেলছে।

  • D4 সিস্টেমে আগ্রহী একাধিক দেশ
  • প্রতিরক্ষা রপ্তানিতে নতুন দিগন্ত
  • কৌশলগত স্বনির্ভরতা ও অর্থনৈতিক লাভ—উভয়ই নিশ্চিত

সীমান্ত নিরাপত্তা ও নতুন সামরিক মতবাদ

ড্রোন কভচ থেকে প্রাপ্ত শিক্ষা সরাসরি সীমান্ত নিরাপত্তা নীতিতে প্রভাব ফেলবে।

  • বাস্তবসম্মত গোয়েন্দা তথ্য প্রক্রিয়াকরণ
  • দ্রুত প্রতিক্রিয়া ব্যবস্থা
  • কঠিন উচ্চভূমিতে প্রযুক্তি ব্যবহারের সক্ষমতা

নতুন TTPs তৈরি হওয়ায় ইউনিট-লেভেলেই আধুনিকীকরণের প্রভাব পড়ছে। এই নীচু স্তর থেকে শুরু হওয়া পরিবর্তন সামগ্রিক সামরিক মতবাদকে রূপান্তরিত করবে।


উপসংহার

"এক্সারসাইজ ড্রোন কভচ" নিঃসন্দেহে ভারতের সামরিক ইতিহাসে এক জলবিভাজক মুহূর্ত।

  • সীমান্তের জটিল ভূপ্রকৃতিতে সফল ড্রোন ও পাল্টা-ড্রোন অনুশীলন
  • DRDO D4-সহ দেশীয় প্রযুক্তির সাফল্য
  • সেনা ও ITBP-র সমন্বিত প্রস্তুতি
  • আঞ্চলিক নিরাপত্তায় শক্ত বার্তা

ভারতের প্রতিরক্ষা আধুনিকীকরণ এখন শুধু প্রতিরোধ নয়, বরং ভবিষ্যৎ যুদ্ধে আধিপত্য বিস্তারের দিকে দৃঢ়ভাবে এগোচ্ছে।
যখন আঞ্চলিক শক্তি ভারসাম্য ক্রমেই পরিবর্তিত হচ্ছে, তখন "ড্রোন কভচ" ভারতের প্রতিরক্ষা প্রস্তুতির জন্য এক দৃঢ় ভিত্তি স্থাপন করেছে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

যদি আপনার কোনও বিষয়ে ডাউট থাকে বা কোনও বিষয় suggest করতে চান তাহলে মেল করুন!

নবীনতর পূর্বতন

banglafacts 4