মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কি আফগানিস্তানের বাগরাম এয়ারবেসে ফিরতে পারবে: ভূ-রাজনৈতিক পরিণতি ও আঞ্চলিক প্রভাব


ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রেসিডেন্সি পুনরায় শুরু হওয়ার সাথে সাথে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত প্রশ্ন সামনে এসেছে। ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বরে ট্রাম্প ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কেয়ার স্টারমারের সাথে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে ঘোষণা করেছেন যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানের বাগরাম এয়ারবেস পুনরায় দখলের জন্য তালিবানের সাথে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। এই ঘোষণা তাৎক্ষণিক তালিবানের তীব্র প্রতিক্রিয়া এবং আঞ্চলিক শক্তিগুলোর মধ্যে উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে। বাগরাম এয়ারবেস, যা একসময় আফগানিস্তানে মার্কিন ও ন্যাটো বাহিনীর সবচেয়ে বড় সামরিক স্থাপনা ছিল, এখন তালিবানের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। এই ঘটনাক্রম শুধুমাত্র আফগানিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয় নয়, বরং পুরো মধ্য এশিয়া ও দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনীতিতে ব্যাপক প্রভাব ফেলতে পারে।
USA return to Afghanistan


বাগরাম এয়ারবেসের কৌশলগত গুরুত্ব

বাগরাম এয়ারবেস কাবুলের উত্তরে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে পারওয়ান প্রদেশে অবস্থিত এবং সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১,৪৯২ মিটার উচ্চতায় অবস্থান করছে। ১৯৫০ এর দশকে সোভিয়েত ইউনিয়ন কর্তৃক নির্মিত এই বিমানবন্দরটি দুটি কংক্রিট রানওয়ে রয়েছে - প্রধান রানওয়েটি ১১,৮১৯ ফুট দীর্ঘ এবং দ্বিতীয়টি ৯,৬৮৭ ফুট দীর্ঘ, যা বৃহত্তম সামরিক বিমান পরিচালনায় সক্ষম।

২০০১ সাল থেকে ২০২১ সালের মার্কিন প্রত্যাহার পর্যন্ত বাগরাম ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সামরিক কেন্দ্র। এটিতে ৫০ শয্যার একটি হাসপাতাল, তিনটি অপারেশন থিয়েটার, ১১০টিরও বেশি বিমান পার্কিং স্পেস এবং ১০,০০০ সৈন্য মোতায়েনের সুবিধা রয়েছে। ২০১২ সালে এর সর্বোচ্চ সময়ে এখানে ১ লক্ষেরও বেশি মার্কিন সৈন্য অবস্থান করেছিল।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফিরে আসার সম্ভাবনা

তালিবানের দৃঢ় অবস্থান
বাগরাম এয়ারবেসে মার্কিন ফিরে আসার সম্ভাবনা বর্তমানে অত্যন্ত কম। তালিবান কর্মকর্তারা ট্রাম্পের ঘোষণার পরপরই এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে। তালিবান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা জাকির জালাল স্পষ্ট করে বলেছেন, "আফগানিস্তান এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একে অপরের সাথে সম্পর্ক রাখতে পারে... কিন্তু আফগানিস্তানের কোথাও মার্কিন সামরিক উপস্থিতি ছাড়াই"।

তালিবান মুখপাত্র জবিহুল্লাহ মুজাহিদ আরও জোর দিয়ে বলেছেন, "বাগরামের এক ইঞ্চি জমিও ছেড়ে দেওয়া হবে না" এবং "আমেরিকানদের বাগরামে ফিরে আসার কল্পনা হাস্যকর"। এই অবস্থান ঐতিহাসিকভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ, কারণ আফগানদের বিদেশি সামরিক উপস্থিতি প্রত্যাখ্যানের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে।

আইনি ও রাজনৈতিক বাধা

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তালিবান সরকারকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেয়নি, যা দ্বিপক্ষীয় আলোচনাকে জটিল করে তুলেছে। ২০২০ সালে ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে তালিবানের সাথে যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল, তাতে আফগানিস্তান থেকে সম্পূর্ণ মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহারের শর্ত ছিল।

মার্কিন ফিরে আসার পেছনে কৌশলগত কারণসমূহ

চীনা হুমকি মোকাবেলা

ট্রাম্প বাগরাম পুনরায় দখলের প্রধান কারণ হিসেবে চীনের সাথে কৌশলগত প্রতিযোগিতাকে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, "আমরা এই বেসটি চাই কারণ এটি চীনের পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির স্থান থেকে মাত্র এক ঘণ্টার দূরত্বে অবস্থিত"। চীনের জিনজিয়াং প্রদেশে হামি এলাকায় শত শত ভূগর্ভস্থ ক্ষেপণাস্ত্র সাইলো এবং লপ নুর পারমাণবিক পরীক্ষা কেন্দ্রের সম্প্রসারণ মার্কিন নিরাপত্তা কৌশলবিদদের উদ্বিগ্ন করেছে।

চীন এই ভূ-অঞ্চলে তার পারমাণবিক সক্ষমতা দ্রুততার সাথে বৃদ্ধি করছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, চীনের বর্তমানে ৫০০+ পারমাণবিক ওয়ারহেড রয়েছে এবং ২০৩০ সালের মধ্যে এটি ১,০০০ এর বেশি হতে পারে। বাগরাম থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চীনের এই কার্যক্রমের উপর নজরদারি এবং গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ করতে পারবে।

আফগানিস্তানের খনিজ সম্পদের প্রভাব

আফগানিস্তানে বিশাল খনিজ সম্পদ রয়েছে, বিশেষ করে লিথিয়াম, যাকে "লিথিয়ামের সৌদি আরব" বলা হয়। ২০১০ সালের পেন্টাগনের একটি মেমো অনুযায়ী, আফগানিস্তানের খনিজ সম্পদের মূল্য ১ ট্রিলিয়ন ডলারেরও বেশি। চীন আফগানিস্তানের সাথে খনিজ উত্তোলন এবং বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভে অন্তর্ভুক্তির বিষয়ে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে।

২০২৫ সালের আগস্টে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই কাবুল সফর করে তালিবানের সাথে খনিজ আহরণ এবং বেল্ট অ্যান্ড রোডে আফগানিস্তানের যোগদানের বিষয়ে আলোচনা করেছেন। চীনা কোম্পানিগুলো ইতিমধ্যে ১০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।

সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান

বাগরাম পুনরায় দখলের আরেকটি কারণ হল সন্ত্রাসবিরোধী কার্যক্রম। আইএসআইএস-কে এবং অন্যান্য সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর জন্য এই বেস ব্যবহার করা যেতে পারে। এছাড়া, আফগান অভ্যন্তরে আটক মার্কিন নাগরিকদের উদ্ধারেও এটি সহায়ক হতে পারে।

প্রতিবেশী দেশসমূহের উপর ভূ-রাজনৈতিক প্রভাব

চীনের উদ্বেগ ও প্রতিক্রিয়া

চীন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাগরাম ফিরে আসার সম্ভাবনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র লিন জিয়ান বলেছেন, "আঞ্চলিক উত্তেজনা বৃদ্ধি এবং সংঘাত সৃষ্টি জনগণের আকাঙ্ক্ষার বিরোধী"। চীন আফগানিস্তানের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব এবং আঞ্চলিক অখণ্ডতার প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করেছে।

মার্কিন উপস্থিতি চীনের জিনজিয়াং প্রদেশের নিরাপত্তার জন্য সরাসরি হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। জিনজিয়াং চীনের সবচেয়ে সংবেদনশীল অঞ্চল, যেখানে উইঘুর মুসলিম জনগোষ্ঠী রয়েছে। বাগরাম থেকে মার্কিন গোয়েন্দা তৎপরতা চীনের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য গুরুতর চ্যালেঞ্জ হবে।

চীন সম্ভাব্য মার্কিন প্রত্যাবর্তনের জবাবে রাশিয়া ও ইরানের সাথে আরও ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা গড়ে তুলতে পারে। এছাড়া, চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোরের (সিপেক) প্রকল্পগুলো ত্বরান্বিত করতে পারে আফগানিস্তানকে সম্পূর্ণভাবে বাইপাস করে।

পাকিস্তানের জটিল অবস্থান

পাকিস্তানের জন্য মার্কিন বাগরামে ফিরে আসা একটি জটিল পরিস্থিতি সৃষ্টি করবে। একদিকে, পাকিস্তান ঐতিহাসিকভাবে মার্কিন মিত্র এবং তালিবানের সাথে পাকিস্তানি গভীর রাষ্ট্রের যোগসূত্র রয়েছে। কিন্তু অন্যদিকে, তালিবান পুনরায় ক্ষমতায় আসায় পাকিস্তানের "কৌশলগত গভীরতা" বৃদ্ধি পেয়েছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, বাগরামে মার্কিন উপস্থিতি পাকিস্তানের কৌশলগত গভীরতা হ্রাস করবে, বিশেষত যদি এটি তালিবানের ইসলামাবাদের উপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে দেয়। এছাড়া, তেহরিক-ই-তালিবান পাকিস্তান (টিটিপি) এর সাথে লড়াইয়ে পাকিস্তানের জন্য এটি চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠতে পারে, কারণ আফগানিস্তান থেকে প্রাপ্ত মার্কিন অস্ত্র এখন পাকিস্তানি জঙ্গি গোষ্ঠীগুলোর হাতে পৌঁছেছে।

ইরানের আঞ্চলিক কৌশল

ইরান দীর্ঘদিন ধরে প্রতিবেশী দেশে বিদেশি সামরিক উপস্থিতির বিরোধী। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আফগানিস্তান থেকে প্রত্যাহারকে ইরান তাদের "প্রতিরোধের অক্ষ" (Axis of Resistance) কৌশলের বিজয় হিসেবে দেখেছে।

বাগরামে মার্কিন ফিরে আসা ইরানের জন্য কয়েকটি কারণে উদ্বেগজনক:

  • এটি ইরানকে পূর্ব ও পশ্চিম দুই দিক থেকে মার্কিন সামরিক ঘেরাওয়ের মধ্যে ফেলবে
  • ইরানের চাবাহার বন্দর প্রকল্প এবং আফগানিস্তানের সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক প্রভাবিত হবে
  • ইরান আরও বেশি রাশিয়া ও চীনের দিকে ঝুঁকতে বাধ্য হবে

রাশিয়ার কেন্দ্রীয় এশিয়ার নিয়ন্ত্রণ

রাশিয়া কেন্দ্রীয় এশিয়াকে তার একচেটিয়া প্রভাব অঞ্চল মনে করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যদি বাগরামে ফিরে আসে, তাহলে এটি রাশিয়ার কৌশলগত গভীরতা হ্রাস করবে। রাশিয়া ইতিমধ্যে তাজিকিস্তান ও কিরগিজস্তানে তার সামরিক ঘাঁটির প্রস্তুতি বৃদ্ধি করেছে মার্কিন মধ্য এশিয়ায় ফিরে আসার আশঙ্কায়।

২০০৫ সালে উজবেকিস্তান এবং ২০১৪ সালে কিরগিজস্তান থেকে রাশিয়া ও চীনের চাপে মার্কিন ঘাঁটি বন্ধ করার ইতিহাস রয়েছে। রাশিয়া শাংহাই সহযোগিতা সংস্থা (SCO) ও সম্মিলিত নিরাপত্তা চুক্তি সংস্থার (CSTO) মাধ্যমে কেন্দ্রীয় এশিয়ায় মার্কিন প্রভাব সীমিত রাখার চেষ্টা করছে।

ভারতের কৌশলগত সুবিধা

ভারতের জন্য বাগরামে সম্ভাব্য মার্কিন ফিরে আসা কয়েকটি কৌশলগত সুবিধা এনে দিতে পারে। প্রথমত, এটি পাকিস্তানের কৌশলগত গভীরতা হ্রাস করবে এবং তালিবানের উপর ইসলামাবাদের প্রভাব কমিয়ে দেবে। দ্বিতীয়ত, ভারত চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড সম্প্রসারণ এবং আঞ্চলিক প্রভাব বৃদ্ধির বিরোধী, তাই মার্কিন উপস্থিতি এ ক্ষেত্রে সহায়ক হতে পারে।

তবে ভারতের জন্য এটি দ্বিমুখী চ্যালেঞ্জও সৃষ্টি করবে। ইরানের সাথে সম্পর্ক বজায় রাখা, তালিবানের সাথে সংযোগ অব্যাহত রাখা এবং মুস্লিম বিশ্বে ভারতের ভাবমূর্তি রক্ষা করা জটিল হয়ে উঠবে।

আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার প্রভাব

মধ্য এশিয়ায় নতুন মহাশক্তির প্রতিযোগিতা

বাগরামে সম্ভাব্য মার্কিন ফিরে আসা মধ্য এশিয়ায় নতুন "মহাগেম" (Great Game) এর সূচনা করতে পারে। ইতিহাসে ১৯ শতকে ব্রিটিশ ও রুশ সাম্রাজ্যের মধ্যে এই অঞ্চলে প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতা হয়েছিল। বর্তমানে এতে যুক্ত হয়েছে চীন।

শাংহাই সহযোগিতা সংস্থা (SCO), যাতে রাশিয়া, চীন, পাকিস্তান, ইরান এবং মধ্য এশিয়ার প্রজাতন্ত্রসমূহ রয়েছে, মার্কিন উপস্থিতির বিরোধী। SCO "সন্ত্রাসবাদ, বিচ্ছিন্নতাবাদ ও চরমপন্থা"র বিরুদ্ধে লড়াইয়ের নামে মার্কিন প্রভাব সীমিত রাখার চেষ্টা করছে।

অস্ত্র পাচার ও সন্ত্রাসবাদের সমস্যা

২০২১ সালে মার্কিন প্রত্যাহারের সময় প্রায় ৭ বিলিয়ন ডলারের সামরিক সরঞ্জাম আফগানিস্তানে ছেড়ে যাওয়া হয়েছিল। এর মধ্যে ৩১৬,০০০+ অস্ত্র, ৭৩টি বিমান, ৭০টি MRAP যান এবং বিভিন্ন অত্যাধুনিক সরঞ্জাম রয়েছে।

জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, তালিবানের দখলে থাকা প্রায় ৫ লক্ষ অস্ত্র এখন হারিয়ে গেছে, বিক্রি হয়ে গেছে বা জঙ্গি গোষ্ঠীর কাছে পাচার হয়েছে। এই অস্ত্রগুলো আল-কায়েদার সহযোগী সংগঠন, তেহরিক-ই-তালিবান পাকিস্তান এবং বিভিন্ন বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীর হাতে পৌঁছেছে।

মাদক পাচার ও অর্থনৈতিক প্রভাব

আফগানিস্তান বিশ্বের আফিমের ৮০% উৎপাদন করে, যা রাশিয়াসহ আঞ্চলিক দেশগুলোতে মাদকাসক্তির সমস্যা সৃষ্টি করছে। মার্কিন উপস্থিতি এই সমস্যা মোকাবেলায় সহায়ক হতে পারে, কিন্তু প্রতিবেশী দেশগুলো এই যুক্তিতে সন্দেহ প্রকাশ করে।

তালিবানের সামরিক সক্ষমতা ও নিয়ন্ত্রণ

বাগরামে বর্তমান অবস্থা

২০২১ সালের ১৫ আগস্ট তালিবান বাগরাম এয়ারবেস সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়। তারা পারওয়ান ডিটেনশন সেন্টারের সকল বন্দি মুক্ত করে, যার মধ্যে অনেক আল-কায়েদা ও ISIS সদস্য ছিল। এর মধ্যে আব্দুল রহমান আল লোগারি নামের একজন ISIS সদস্য পরবর্তীতে কাবুল বিমানবন্দরে আত্মঘাতী হামলা চালিয়ে ১৮২ জনকে হত্যা করে।

স্যাটেলাইট ইমেজ অনুযায়ী, ২০২০ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত বাগরামে খুবই সীমিত কার্যক্রম দেখা যাচ্ছে এবং চীনা উপস্থিতির কোনো প্রমাণ মিলেনি। তবে তালিবানের কাছে প্রচুর মার্কিন সরঞ্জাম রয়েছে, যদিও অত্যাধুনিক সরঞ্জাম পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষিত জনবল ও প্রযুক্তিগত সহায়তা তাদের নেই।

তালিবানের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির প্রচেষ্টা

তালিবান আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির জন্য চেষ্টা করছে এবং বিভিন্ন দেশের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। রাশিয়া প্রথম দেশ হিসেবে তালিবান সরকারকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিয়েছে। চীনও তালিবানের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলেছে এবং আফগানিস্তানে প্রথম রাষ্ট্রদূত নিয়োগ দিয়েছে।

অর্থনৈতিক কূটনীতি ও সংস্থানের যুদ্ধ

চীনের অর্থনৈতিক আগ্রাসন

চীন তালিবানের সাথে ক্রমাগত অর্থনৈতিক সম্পর্ক গভীর করছে। দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ইতিমধ্যে ১ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। চীনা কোম্পানি গোচিন ১০ বিলিয়ন ডলারের লিথিয়াম প্রসেসিং প্ল্যান্ট নির্মাণের প্রস্তাব দিয়েছে। তালিবান ইতিমধ্যে ৬.৫ বিলিয়ন ডলার মূল্যের সাতটি খনন চুক্তি স্বাক্ষর করেছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যদি বাগরামে ফিরে আসে, তাহলে চীনা বিনিয়োগের নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়বে। এটি চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যা মধ্য এশিয়া ও দক্ষিণ এশিয়ার সংযোগ স্থাপনের জন্য অপরিহার্য।

আঞ্চলিক শক্তির ভারসাম্য

মধ্য এশিয়ায় বর্তমানে তিনটি প্রধান শক্তি কেন্দ্র রয়েছে:

  • রাশিয়ার নেতৃত্বে: CSTO ও EAEU এর মাধ্যমে কেন্দ্রীয় এশিয়ার প্রজাতন্ত্রগুলোর উপর নিয়ন্ত্রণ
  • চীনের নেতৃত্বে: BRI ও SCO এর মাধ্যমে অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক প্রভাব
  • মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র: NATO সহযোগিতা ও দ্বিপক্ষীয় চুক্তির মাধ্যমে সীমিত উপস্থিতি

বাগরামে মার্কিন ফিরে আসা এই ভারসাম্য মৌলিকভাবে পরিবর্তন করবে এবং নতুন জোট গঠনে বাধ্য করবে সকল পক্ষকে।

সম্ভাব্য পরিণতি ও ভবিষ্যৎ দৃশ্যপট

স্বল্পমেয়াদী প্রভাব

যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাগরাম পুনরায় দখলে সক্ষম হয়, তাহলে স্বল্পমেয়াদে নিম্নলিখিত প্রভাবগুলো দেখা যেতে পারে:

  • তাৎক্ষণিক নিরাপত্তা উত্তেজনা: চীন ও রাশিয়া তাদের সামরিক প্রস্তুতি বৃদ্ধি করবে। জিনজিয়াং প্রদেশে চীনা সামরিক কার্যক্রম তীব্র হবে এবং রাশিয়া তাজিকিস্তান ও কিরগিজস্তানে অতিরিক্ত সৈন্য মোতায়েন করতে পারে।
  • কূটনৈতিক বিচ্ছিন্নতা: তালিবান অন্যান্য দেশের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক আরও জোরদার করার চেষ্টা করবে মার্কিন চাপ মোকাবেলার জন্য।
  • অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা: চীন ও রাশিয়া আফগানিস্তানে তাদের বিনিয়োগ ত্বরান্বিত করতে পারে মার্কিন প্রভাব সীমিত রাখার জন্য।

দীর্ঘমেয়াদী পরিণতি
  • নতুন ঠান্ডা যুদ্ধের সূচনা: মধ্য এশিয়া নতুন ঠান্ডা যুদ্ধের প্রধান রণক্ষেত্র হয়ে উঠতে পারে। মার্কিন-চীন-রাশিয়ার মধ্যে প্রতিযোগিতা তীব্র হবে।
  • আঞ্চলিক অস্ত্র প্রতিযোগিতা: সকল শক্তি তাদের সামরিক সক্ষমতা বৃদ্ধি করবে। পারমাণবিক অস্ত্রের প্রসারণ ত্বরান্বিত হতে পারে।
  • অর্থনৈতিক ব্লক গঠন: পূর্ব-পশ্চিম অর্থনৈতিক ব্লক আরও স্পষ্ট হয়ে উঠবে। চীনের BRI এবং মার্কিন-ইউরোপীয় অর্থনৈতিক জোটের মধ্যে প্রতিযোগিতা তীব্র হবে।

সর্বোচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ দৃশ্যপট
সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতিতে, বাগরাম নিয়ে উত্তেজনা আঞ্চলিক সংঘাতে রূপ নিতে পারে। তবে পারমাণবিক অস্ত্রধারী শক্তিগুলোর মধ্যে সরাসরি সংঘাতের সম্ভাবনা কম, কারণ সকলেই ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কে সচেতন।

উপসংহার ও পুর্বাভাস
বাগরাম এয়ারবেসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফিরে আসার সম্ভাবনা বর্তমানে অত্যন্ত ক্ষীণ। তালিবানের দৃঢ় অবস্থান, আন্তর্জাতিক আইনি জটিলতা এবং আঞ্চলিক শক্তিগুলোর বিরোধিতার কারণে এই উদ্যোগ সফল হওয়ার সম্ভাবনা কম। তবে এই প্রচেষ্টা নিজেই একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূ-রাজনৈতিক সংকেত যা আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ব্যাপক প্রভাব ফেলছে।

ট্রাম্প প্রশাসনের এই কৌশল মূলত চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব মোকাবেলা এবং "আমেরিকা ফার্স্ট" নীতির অংশ। তবে ২১ শতকের বহুপোলার বিশ্বে একক শক্তির পক্ষে কোনো অঞ্চলে একচেটিয়া আধিপত্য বিস্তার করা ক্রমশ কঠিন হয়ে উঠছে। মধ্য এশিয়ায় রাশিয়া-চীনের জোট, ইরানের প্রতিরোধ এবং আঞ্চলিক দেশগুলোর বহুমুখী কূটনীতির কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য পুরানো আধিপত্য পুনরুদ্ধার করা অসম্ভব।

আফগানিস্তান ও প্রতিবেশী দেশগুলোর জন্য সবচেয়ে ভালো হবে যদি বৈশ্বিক শক্তিগুলো প্রতিযোগিতার পরিবর্তে সহযোগিতার মাধ্যমে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা, উন্নয়ন এবং শান্তি প্রতিষ্ঠায় কাজ করে। তা না হলে আফগানিস্তান আবারও "সাম্রাজ্যের কবরস্থান" এর অভিশাপে আবদ্ধ হয়ে থাকবে এবং পুরো অঞ্চল অস্থিতিশীলতার শিকার হবে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

যদি আপনার কোনও বিষয়ে ডাউট থাকে বা কোনও বিষয় suggest করতে চান তাহলে মেল করুন!

নবীনতর পূর্বতন

banglafacts 4