যুক্তরাজ্য, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ার ফিলিস্তিন রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি: একটি ঐতিহাসিক মোড়

গত ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ তারিখে বিশ্ব কূটনৈতিক অঙ্গনে একটি যুগান্তকারী ঘটনা ঘটেছে। যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া এবং পর্তুগাল একযোগে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি প্রদান করেছে। এই সিদ্ধান্ত বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ কারণ এর মাধ্যমে প্রথমবারের মতো জি-৭ গোষ্ঠীর কোনো দেশ ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রীয়তাকে স্বীকৃতি দিয়েছে, যা দীর্ঘদিনের পশ্চিমা পররাষ্ট্রনীতিতে এক বিরাট পরিবর্তনের সংকেত দিচ্ছে।

UK, Australia, and Canada recognise Palestine as a nation 2025"


ঐতিহাসিক স্বীকৃতির পটভূমি

ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কির স্টার্মার তার ভিডিও বার্তায় বলেছেন, "আজ, ফিলিস্তিনি এবং ইসরায়েলিদের মধ্যে শান্তির আশা পুনর্জীবিত করতে এবং দুই-রাষ্ট্র সমাধানকে এগিয়ে নিতে, যুক্তরাজ্য আনুষ্ঠানিকভাবে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিচ্ছে।" কানাডিয়ান প্রধানমন্ত্রী মার্ক কার্নি এবং অস্ট্রেলিয়ান প্রধানমন্ত্রী অ্যান্থনি আলবানিজও একই ধরনের ঘোষণা দিয়েছেন

এই স্বীকৃতি আসার পেছনে রয়েছে গাজায় দীর্ঘ প্রায় দুই বছর ধরে চলমান যুদ্ধ এবং মানবিক সংকট। ইসরায়েলি বাহিনী গাজায় যে ব্যাপক সামরিক অভিযান চালিয়েছে, তাতে ৬৫,০০০ এরও বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে, যাদের অধিকাংশই নিরপরাধ নাগরিক। স্টার্মার গাজায় ইসরায়েলের "নিরলস এবং ক্রমবর্ধমান বোমাবর্ষণ"কে "সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য" বলে বর্ণনা করেছেন

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া এবং বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট

বর্তমানে জাতিসংঘের ১৯৩টি সদস্য রাষ্ট্রের মধ্যে ১৪৫টি দেশ ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিয়েছে, যা সমগ্র সদস্যের তিন-চতুর্থাংশেরও বেশি। এই তালিকায় রয়েছে রাশিয়া, চীন, ভারত এবং প্রায় সব আরব, আফ্রিকান ও লাতিন আমেরিকান দেশ। তবে যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েল এবং তাদের অধিকাংশ মিত্র দেশ এখনো ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেয়নি

সৌদি আরব, কুয়েত, ওমান, জর্ডান এবং উপসাগরীয় সহযোগিতা পরিষদ (জিসিসি) এই স্বীকৃতিকে স্বাগত জানিয়েছে। সৌদি আরব এটিকে "দুই-রাষ্ট্র সমাধানের দিকে শান্তি প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ" বলে অভিহিত করেছে

ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের তীব্র প্রতিক্রিয়া

ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিজামিন নেতানিয়াহু এই স্বীকৃতিকে তীব্র ভর্ত্সনা করেছেন। তিনি বলেছেন, "যারা ৭ অক্টোবরের ভয়াবহ ঘটনার পর ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিচ্ছেন, তাদের কাছে আমার একটি স্পষ্ট বার্তা রয়েছে: আপনারা সন্ত্রাসবাদকে পুরস্কৃত করছেন।" তিনি আরও বলেছেন যে জর্ডান নদীর পশ্চিমে কোনো ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবে না

যুক্তরাষ্ট্র এই স্বীকৃতিকে "প্রদর্শনমূলক অঙ্গভঙ্গি" বলে অভিহিত করেছে। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র বলেছেন, "আমাদের মনোযোগ প্রদর্শনমূলক অঙ্গভঙ্গিতে নয়, বরং গুরুতর কূটনীতিতে। আমাদের অগ্রাধিকার স্পষ্ট: জিম্মিদের মুক্তি, ইসরায়েলের নিরাপত্তা, এবং সমগ্র অঞ্চলের জন্য শান্তি ও সমৃদ্ধি।"

দুই-রাষ্ট্র সমাধান: আশা ও চ্যালেঞ্জ

দুই-রাষ্ট্র সমাধান হলো ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতের একটি প্রস্তাবিত সমাধান, যেখানে পশ্চিম তীর ও গাজা উপত্যকায় একটি স্বাধীন ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র গঠন করা হবে, যার রাজধানী হবে পূর্ব জেরুজালেম। এই সমাধানের মূলভিত্তি ছিল ১৯৯৩ সালের অসলো চুক্তি, কিন্তু গত তিন দশকে ইসরায়েলি বসতি স্থাপনের কারণে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠেছে

বর্তমানে পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুজালেমে ইসরায়েলি বসতিবাসীর সংখ্যা ৬,৯৫,০০০ এ পৌঁছেছে, যা ১৯৯৩ সালের ২,৫০,০০০ থেকে প্রায় তিনগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী এই বসতি স্থাপন অবৈধ।

বাংলাদেশ ও ফিলিস্তিন: একটি দীর্ঘ বন্ধুত্বের ইতিহাস

বাংলাদেশ ১৯৮৮ সালের ১৫ নভেম্বর ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা ঘোষণার পর থেকেই ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিয়েছে। বাংলাদেশ-ফিলিস্তিন সম্পর্কের সূত্রপাত হয় ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকেই। ১৯৭৩ সালে ইসরায়েল-আরব যুদ্ধের সময় বাংলাদেশ ফিলিস্তিনিদের পক্ষে চিকিৎসা দল ও ত্রাণ সামগ্রী পাঠায়

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৪ সালে জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনে তার প্রথম ভাষণে ফিলিস্তিনি জনগণের অধিকারের কথা বলেছিলেন। বাংলাদেশের সংবিধানের ২৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, বাংলাদেশ "সাম্রাজ্যবাদ, ঔপনিবেশিকতা বা বর্ণবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামরত বিশ্বের সর্বত্র নিপীড়িত জনগণের সাথে একাত্মতা" প্রকাশ করে

গাজার মানবিক সংকট: ভয়াবহ পরিসংখ্যান

বর্তমান গাজা যুদ্ধে হতাহতের পরিমাণ অভূতপূর্ব। ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত গাজায় ৬১,৭২২ জন ফিলিস্তিনি নিহত এবং ১,৫৪,৫২৫ জন আহত হয়েছে। নিহতদের মধ্যে ৭০% নারী ও শিশু। জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা এই পরিস্থিতিকে "গণহত্যা" বলে অভিহিত করেছেন

গাজার জনসংখ্যার ৯০% বাস্তুচ্যুত হয়েছে এবং এলাকায় ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। বিশ্বব্যাপী শিশু বিকলাঙ্গের হারের দিক থেকে গাজা এখন শীর্ষে রয়েছে

আন্তর্জাতিক আইনি অবস্থান

জাতিসংঘের বিভিন্ন কমিশন ও আন্তর্জাতিক আদালত ইসরায়েলের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ তুলেছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে গ্রেপতারি পরোয়ানা জারি করেছে। আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) দক্ষিণ আফ্রিকা ইসরায়েলের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ এনেছে

বাংলাদেশও এই আইনি প্রক্রিয়ায় সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছে। দেশটি আইসিজে-তে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডের আইনগত পরিণতি সংক্রান্ত মতামত প্রদানের জন্য লিখিত বিবৃতি দাখিল করেছে এবং মৌখিক শুনানিতে অংশগ্রহণ করেছে

পরবর্তী পদক্ষেপ এবং ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা

আজ (২২ সেপ্টেম্বর) জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনে ফ্রান্স, বেলজিয়াম, লুক্সেমবার্গ এবং মাল্টাও ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রত্যাশা রয়েছে। ফ্রান্স ও সৌদি আরব যৌথভাবে দুই-রাষ্ট্র সমাধানের উপর একটি সম্মেলনের আয়োজন করছে

ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের রাষ্ট্রদূত জাতিসংঘে জানিয়েছেন যে আরও প্রায় ১০টি দেশ এই সপ্তাহে ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিতে পারে। এই স্বীকৃতিগুলি মূলত প্রতীকী হলেও, এর মাধ্যমে ইসরায়েলের উপর আন্তর্জাতিক চাপ বৃদ্ধির আশা করা হচ্ছে।

দক্ষিণ এশিয়ার অবস্থান

দক্ষিণ এশিয়ায় প্রায় সব দেশই ফিলিস্তিনের পক্ষে। বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, মালদ্বীপ এবং শ্রীলঙ্কা সকলেই ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিয়েছে। তবে ভারতের অবস্থান জটিল, যেখানে দেশটি ঐতিহাসিকভাবে ফিলিস্তিনকে সমর্থন করলেও বর্তমানে ইসরায়েলের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলেছে

ফিলিস্তিন-ইসরায়েল সংঘাত দক্ষিণ এশিয়ায় ব্যাপক জনসমর্থন পেয়েছে, বিশেষ করে মুসলিম জনগোষ্ঠীর মধ্যে। তবে বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন যে এই সংঘাত উগ্রবাদী গোষ্ঠীগুলিকে নতুন সদস্য সংগ্রহের সুযোগ দিতে পারে

উপসংহার: একটি নতুন দিগন্তের সম্ভাবনা

যুক্তরাজ্য, কানাডা এবং অস্ট্রেলিয়ার ফিলিস্তিন স্বীকৃতি নিঃসন্দেহে একটি যুগান্তকারী ঘটনা। এই সিদ্ধান্ত যদিও মূলত প্রতীকী, তবে এর মাধ্যমে পশ্চিমা বিশ্বে ফিলিস্তিনি ন্যায্যতার প্রতি ক্রমবর্ধমান সমর্থনের ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।

বাংলাদেশের মতো দেশগুলি, যারা নিজেরাই স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করেছে, ফিলিস্তিনি জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের সাথে গভীরভাবে একাত্মতা বোধ করে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের মতোই, ফিলিস্তিনিরাও তাদের মাতৃভূমিতে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখে।

তবে স্বীকৃতি মাত্রই সমাধান নয়। প্রকৃত শান্তির জন্য প্রয়োজন ইসরায়েল-ফিলিস্তিন উভয় পক্ষের মধ্যে অর্থবহ আলোচনা, গাজায় যুদ্ধবিরতি, মানবিক সহায়তার নিরবচ্ছিন্ন প্রবাহ, এবং দুই-রাষ্ট্র সমাধানের বাস্তবায়নের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সম্মিলিত প্রচেষ্টা।

আজকের এই স্বীকৃতি হয়তো সেই দীর্ঘ যাত্রার একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক, যা ফিলিস্তিনি জনগণকে তাদের ন্যায্য অধিকার এবং মর্যাদাসম্পন্ন স্বাধীনতার এক ধাপ কাছে নিয়ে এসেছে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

যদি আপনার কোনও বিষয়ে ডাউট থাকে বা কোনও বিষয় suggest করতে চান তাহলে মেল করুন!

নবীনতর পূর্বতন

banglafacts 4