ভূমিকা
মধ্যপ্রাচ্য ও বৃহত্তর ইসলামী বিশ্বের ভূ-রাজনীতি আজ এক নতুন মোড়ে এসে দাঁড়িয়েছে। ইসরায়েলের সেপ্টেম্বর ২০২৫–এর কাতার আক্রমণের পর থেকে আরব ও ইসলামী দেশগুলির মধ্যে যৌথ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়েছে। এই প্রেক্ষাপটেই আবার সামনে এসেছে “আরব ইসলামিক ন্যাটো” বা Arab Islamic NATO–এর ধারণা। মূলত ন্যাটো (North Atlantic Treaty Organization)–র আদলে গড়ে ওঠা এক সামরিক জোট, যা আরব ও ইসলামী দেশগুলিকে একীভূত সামরিক ছাতার নিচে আনতে চায়।

এই ধারণা মোটেই নতুন নয়। ইতিহাসে আরব লিগ, জিসিসি (GCC) কিংবা ইসলামী সামরিক জোটের একাধিক উদ্যোগ এই প্রয়াসের ভিত্তি তৈরি করেছে। তবে সাম্প্রতিক ঘটনাবলি এই উদ্যোগকে নতুন করে গুরুত্ব এনে দিয়েছে। প্রশ্ন হলো – এই জোট কি সত্যিই কার্যকর সামরিক শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারবে, নাকি আগের মতোই কেবল ঘোষণাতেই সীমাবদ্ধ থাকবে?
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
আরব লিগের যৌথ প্রতিরক্ষা চুক্তি (১৯৫০)
১৯৫০ সালে আরব লিগ একটি যৌথ প্রতিরক্ষা ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষর করে। সেখানে বলা হয়েছিল – "কোনো একটি সদস্য দেশের ওপর আক্রমণ মানেই সব সদস্য দেশের ওপর আক্রমণ হিসেবে গণ্য হবে"। এটি ছিল মূলত এক প্রকার collective defense–এর প্রাথমিক কাঠামো।
Arab League Overview – Britannica
উপসাগরীয় সহযোগিতা পরিষদ (GCC) ও পেনিনসুলা শিল্ড ফোর্স
১৯৮৪ সালে উপসাগরীয় সহযোগিতা পরিষদ (GCC) Peninsula Shield Force গঠন করে। এর লক্ষ্য ছিল উপসাগরীয় রাষ্ট্রগুলিকে যৌথভাবে রক্ষা করা এবং বহিঃশত্রুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা।
ইসলামিক মিলিটারি কাউন্টার টেরোরিজম কোয়ালিশন (IMCTC)
২০১৫ সালের ডিসেম্বরে সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান ঘোষণা করেন একটি ইসলামী সামরিক জোটের, যা মূলত সন্ত্রাসবাদ দমনের উদ্দেশ্যে গঠিত হয়েছিল। প্রথমে এতে ৩৪টি দেশ যোগ দিলেও বর্তমানে এর সদস্য সংখ্যা ৪৩। এর সদর দফতর রিয়াধে অবস্থিত।
এই ইতিহাস দেখায় যে মুসলিম বিশ্ব বহুদিন ধরেই যৌথ সামরিক সহযোগিতার চেষ্টা করছে, যদিও বাস্তবিক সাফল্য সীমিত।
সাম্প্রতিক পুনরুত্থান : দোহা জরুরি সম্মেলন ২০২৫
ইসরায়েল কাতারে হামাস নেতাদের উপর আঘাত হানার পর ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে দোহায় এক জরুরি সম্মেলন ডাকা হয়। সেখানে ৪০টিরও বেশি আরব ও ইসলামী দেশ একত্রিত হয়। আলোচনার মূল কেন্দ্রবিন্দু ছিল – কীভাবে একক সামরিক কাঠামো তৈরি করে ইসরায়েলের মতো হুমকির মোকাবিলা করা যায়।
মিশরের প্রস্তাব : "আরব ন্যাটো"
মিশর প্রস্তাব করে কায়রো-ভিত্তিক একটি সামরিক জোটের, যেখানে প্রাথমিকভাবে প্রায় ২০,০০০ সেনা থাকবে।
- একটি চার-তারকা জেনারেল হবেন সর্বাধিনায়ক।
- স্থল, নৌ, বিমান ও কমান্ডো – সব ধরনের ইউনিট অন্তর্ভুক্ত থাকবে।
- আরব লিগের সদস্যদের মধ্যে নেতৃত্ব পর্যায়ক্রমে ঘুরে ঘুরে যাবে।
পাকিস্তানের প্রস্তাব : "ইসলামিক টাস্ক ফোর্স"
পাকিস্তান, যেটি মুসলিম বিশ্বের একমাত্র পারমাণবিক শক্তিধর দেশ, একটি Islamic Task Force গঠনের কথা বলে। প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ স্পষ্ট জানান যে পাকিস্তান নেতৃত্ব ও সম্পদ দিতে প্রস্তুত। মূল লক্ষ্য – "ইসরায়েলের আঞ্চলিক পরিকল্পনা পর্যবেক্ষণ"।
ইরানের প্রস্তাব : বৃহত্তর ইসলামী জোট
ইরান আরও বৃহত্তর জোটের আহ্বান জানায়। বিপ্লবী গার্ড বাহিনী সতর্ক করে বলে – যদি দ্রুত পদক্ষেপ না নেওয়া হয়, তবে ভবিষ্যতে সৌদি আরব, তুরস্ক ও ইরাকও ইসরায়েলের লক্ষ্যবস্তু হতে পারে।
প্রস্তাবিত কাঠামো
সদর দফতর ও নেতৃত্ব
- সদর দফতর : কায়রো প্রস্তাবিত
- নেতৃত্ব : চার তারকা জেনারেল, ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন আরব রাষ্ট্র নেতৃত্ব নেবে
- সহকারী কমান্ড : সৌদি আরব ও জিসিসি দেশগুলি অর্থ ও উন্নত অস্ত্রশস্ত্র যোগাবে
সামরিক সক্ষমতা
- বহুমুখী বাহিনী : স্থল, নৌ, বিমান ও বিশেষ বাহিনী
- প্রশিক্ষণ ও লজিস্টিক্স : সমন্বিত প্রশিক্ষণ কর্মসূচি
- গোয়েন্দা তথ্য আদানপ্রদান : যৌথ গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক
- পারমাণবিক প্রতিরোধ : পাকিস্তানের অস্ত্রাগারকে সম্ভাব্য "চূড়ান্ত প্রতিরোধ" হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে
বর্তমান সমর্থন ও সদস্যপদ
প্রধান সমর্থক দেশ
- মিশর : প্রস্তাবক ও সবচেয়ে বড় সেনাবাহিনী নিয়ে নেতৃত্ব দিতে ইচ্ছুক
- পাকিস্তান : পারমাণবিক শক্তি ও সামরিক নেতৃত্ব দিতে প্রস্তুত
- তুরস্ক : ন্যাটো সদস্য, রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক চাপ প্রয়োগে সহায়ক
- ইরাক : প্রধানমন্ত্রী আল-সুদানি শক্তভাবে ইসলামী জোটের পক্ষে
- ইরান : শিয়া রাষ্ট্র হলেও বৃহত্তর ইসলামী ঐক্যের পক্ষে সক্রিয়
উপসাগরীয় সহযোগিতা পরিষদ (GCC)
GCC ইতিমধ্যে তাদের যৌথ প্রতিরক্ষা চুক্তি সক্রিয় করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। দোহায় শিগগিরই ইউনিফাইড মিলিটারি কমান্ড বৈঠক বসবে।
সৌদি-পাকিস্তান প্রতিরক্ষা চুক্তি (১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫)
এই চুক্তি অনুযায়ী – "এক দেশের উপর আক্রমণ মানে অন্য দেশের উপরও আক্রমণ"। এটি ভবিষ্যৎ আরব ইসলামিক ন্যাটোর ভিত্তি হতে পারে।
চ্যালেঞ্জ ও সীমাবদ্ধতা
অভ্যন্তরীণ বিভাজন
- সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা : জোটটি মূলত সুন্নি রাষ্ট্রভিত্তিক হয়ে পড়তে পারে, ফলে ইরান, ইরাক, সিরিয়ার মতো শিয়া সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ বাদ পড়তে পারে।
- সার্বভৌমত্ব নিয়ে সংশয় : অনেক দেশ কেন্দ্রীয় কমান্ডকে মানতে চায় না।
- ভিন্ন স্বার্থ : হুমকির সংজ্ঞা ও আঞ্চলিক অগ্রাধিকার ভিন্ন হওয়ায় ঐক্যবদ্ধ পদক্ষেপ কঠিন।
বাস্তব সমস্যাবলি
- দোহা সম্মেলনে আসলে মূলত নিন্দা ও প্রতিশ্রুতিই দেওয়া হয়েছে, কিন্তু বাঁধাধরা কর্মপরিকল্পনা কম।
- অর্থায়ন কীভাবে হবে, স্পষ্ট নয়।
- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বিদ্যমান নিরাপত্তা চুক্তি এ ধরনের জোটকে জটিল করে তুলতে পারে।
বিশেষজ্ঞ বিশ্লেষণ
কৌশলগত মূল্যায়ন
অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, এই উদ্যোগ আরব দুনিয়ার মধ্যে মার্কিন নিরাপত্তা ছাতার প্রতি হতাশার প্রতিফলন। আরব গালফ স্টেটস ইনস্টিটিউটের হোসেইন ইবিশ বলেন –
"আরব সরকারগুলি ধৈর্য হারাচ্ছে...তাদের মনে হচ্ছে আর কোনো বিকল্প নেই।"
তবে সমালোচকেরা এটিকে বাস্তবতার বদলে প্রতীকী পদক্ষেপ মনে করছেন। লেখক হোসেইন আবুবকর মনসুরের ভাষায় –
"আরব ন্যাটো যদি মিশরের প্রস্তাব হয় আর মুসলিম ন্যাটো যদি ইরানের প্রস্তাব হয়, তবে এটিই প্রমাণ করে সবটাই ভাসাভাসা কল্পনা।"
ভূ-রাজনৈতিক তাৎপর্য
- মার্কিন নির্ভরতা হ্রাস : আমেরিকান নিরাপত্তা নিশ্চয়তা থেকে স্বাধীন হতে চাইছে আরব বিশ্ব।
- আঞ্চলিক শক্তির পুনর্বিন্যাস : মিশর, পাকিস্তান ও সৌদি আরব কেন্দ্রীয় ভূমিকায় আসবে।
- ইসরায়েলের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ : যৌথ সামরিক ছাতার মাধ্যমে ইসরায়েলি সম্প্রসারণবাদের মোকাবিলা।
বর্তমান অবস্থা ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
সেপ্টেম্বর ২০২৫ পর্যন্ত আরব ইসলামিক ন্যাটো মূলত একটি ধারণাই। বাস্তবে এটি কার্যকর সামরিক জোটে রূপ নেওয়ার জন্য দরকার –
- অভ্যন্তরীণ বিভাজন নিরসন
- স্থায়ী কমান্ড কাঠামো
- অর্থায়নের টেকসই ব্যবস্থা
সৌদি-পাকিস্তান প্রতিরক্ষা চুক্তি নিঃসন্দেহে একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ। তবে পুরো আরব ও ইসলামী বিশ্বকে এক ছাতার নিচে আনা সহজ নয়। ইরান-সৌদি প্রতিদ্বন্দ্বিতা, তুরস্কের স্বতন্ত্র নীতি, কিংবা কাতার-সংযুক্ত আরব আমিরাতের বিরোধ সবই বড় অন্তরায়।
উপসংহার
আরব ইসলামিক ন্যাটোর ধারণা মুসলিম বিশ্বের সামরিক ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ বাঁক নির্দেশ করছে। এটি বাস্তবায়িত হলে মধ্যপ্রাচ্যের নিরাপত্তা স্থাপত্যে এক বড় পরিবর্তন আসতে পারে। তবে এটির সফলতা নির্ভর করবে –
- মুসলিম বিশ্বের অভ্যন্তরীণ বিভাজন কতটা কমানো যায়,
- কার্যকর নেতৃত্ব ও অর্থায়ন কতটা নিশ্চিত হয়,
- এবং বহিরাগত শক্তির (বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের) সঙ্গে সম্পর্ক কীভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ রাখা যায়।
যতক্ষণ না এই জোট কথার বদলে কাজে রূপ নেয়, ততক্ষণ এটিকে এক সম্ভাবনাময় কিন্তু অনিশ্চিত প্রয়াস হিসেবেই দেখা যেতে বাধ্য। তবু এটা স্পষ্ট যে, মুসলিম বিশ্ব এক নতুন নিরাপত্তা ব্যবস্থার সন্ধানে রয়েছে এবং “আরব ইসলামিক ন্যাটো” সেই আকাঙ্ক্ষারই সর্বশেষ প্রতিফলন।