জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে (ইউএনএসসি) ভারতের স্থায়ী সদস্যপদের দাবি নতুন মাত্রা পেয়েছে ২০২৫ সালে। যদিও চীন এখনও সরাসরি বিরোধিতার অবস্থানে রয়েছে, তবু বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে ভারতের পক্ষে ক্রমবর্ধমান সমর্থন একটি ঐতিহাসিক পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে।
সাম্প্রতিক উন্নয়ন: ব্রিকস থেকে ইউএনজিএ পর্যন্ত
২০২৫ সালের সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৮০তম অধিবেশনে ভারতের স্থায়ী আসনের দাবি নতুন গতি পেয়েছে। রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ স্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছেন যে মস্কো ভারত ও ব্রাজিলের স্থায়ী আসনের আবেদনকে সমর্থন করে। এর মাধ্যমে রাশিয়া একমাত্র স্থায়ী সদস্য হিসেবে ভারতের পক্ষে খোলাখুলি অবস্থান নিয়েছে।
ভুটানের প্রধানমন্ত্রী শেরিং তোবগে এক শক্তিশালী বক্তব্যে বলেছেন, "একটি সংস্কারকৃত নিরাপত্তা পরিষদে অবশ্যই ভারত ও জাপানের মতো যোগ্য দেশগুলিকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে"। মরিশাসের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ধনঞ্জয় রামফুলও বলেছেন, "ভারত এখন একটি প্রধান বৈশ্বিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে এবং বিশ্ব বিষয়ে তার গঠনমূলক ভূমিকার সাথে সামঞ্জস্য রেখে পরিষদে স্থায়ী আসন পাওয়া উচিত"।
ব্রিকস ঘোষণা: একটি গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি
২০২৫ সালের জুলাইে রিও ডি জেনিরোতে অনুষ্ঠিত ১৭তম ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলনে একটি যুগান্তকারী ঘোষণা আসে। ব্রিকস নেতারা বলেন, "চীন ও রাশিয়া, জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য হিসেবে, ব্রাজিল ও ভারতের আকাঙ্ক্ষার প্রতি তাদের সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করে যাতে তারা জাতিসংঘে, বিশেষ করে নিরাপত্তা পরিষদে আরও বড় ভূমিকা পালন করতে পারে"।
এই ঘোষণাটি বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ কারণ এতে চীনও লিখিতভাবে ভারতের "বৃহত্তর ভূমিকা"র কথা স্বীকার করেছে, যদিও এটি সরাসরি স্থায়ী আসনের সমর্থন নয়।
বর্তমান সমর্থনের অবস্থা
যারা সমর্থন করে:
- রাশিয়া: দীর্ঘদিনের মিত্র হিসেবে স্পষ্ট সমর্থন
- ফ্রান্স: ভারতের দাবিকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন করে
- যুক্তরাজ্য: ভারতের অন্তর্ভুক্তিকে সমর্থন করে
- যুক্তরাষ্ট্র: নীতিগতভাবে সমর্থন, তবে কিছু শর্তসাপেক্ষে
চীনের অবস্থান: পরিবর্তনের ইঙ্গিত
চীন ঐতিহ্যগতভাবে ভারতের স্থায়ী আসনের বিরোধিতা করে এসেছে প্রাথমিকভাবে আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও কৌশলগত কারণে। তবে ২০২৫ সালের ব্রিকস ঘোষণায় চীনের "বৃহত্তর ভূমিকা"র স্বীকৃতি একটি সূক্ষ্ম কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন যে বৈশ্বিক চাপ ও ভারতের ক্রমবর্ধমান প্রভাবের কারণে চীনের অবস্থান ধীরে ধীরে নরম হতে পারে। যদিও এটি এখনও সরাসরি সমর্থন নয়, তবু এটি একটি ইতিবাচক দিক।
ভারতের যোগ্যতা ও প্রাপ্যতা
জনতাত্ত্বিক ও গণতান্ত্রিক শক্তি
ভারত বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র এবং ১.৪ বিলিয়নেরও বেশি জনসংখ্যার প্রতিনিধিত্ব করে - যা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রায় এক-ষষ্ঠাংশ। একটি বহুত্ববাদী, আইনের শাসন ও মানবাধিকারের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ দেশ হিসেবে ভারত জাতিসংঘের মূল নীতিগুলির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
অর্থনৈতিক শক্তি
ভারত বর্তমানে বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতি এবং ক্রয়ক্ষমতার সমতার ভিত্তিতে তৃতীয় বৃহত্তম। দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, ডিজিটাল রূপান্তর ও শিল্প উন্নয়নের মাধ্যমে ভারত বৈশ্বিক বাণিজ্য ও অর্থায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
শান্তিরক্ষায় অবদান
ভারত জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে অন্যতম বৃহত্তম সৈন্য প্রদানকারী দেশ। নিরস্ত্রীকরণ, বর্ণবাদ বিরোধিতা ও শান্তিপূর্ণ বিরোধ নিষ্পত্তিতে ভারতের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে।
গ্লোবাল সাউথের নেতৃত্ব
ভারত উন্নয়নশীল দেশগুলির কণ্ঠস্বর হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে এবং L-69 গ্রুপের (৪২টি দেশ) নেতৃত্ব দেয় যারা ইউএনএসসি সংস্কারের পক্ষে। আন্তর্জাতিক সৌর জোট (ISA) ও দক্ষিণ-দক্ষিণ সহযোগিতার মতো উদ্যোগের মাধ্যমে ভারত উন্নয়নশীল দেশগুলিকে সহায়তা করছে।
চ্যালেঞ্জ ও বাধাসমূহ
ভেটো ক্ষমতার প্রশ্নে মতভেদ
ইউনাইটিং ফর কনসেনসাস (UfC) নামক একটি জোট - যার নেতৃত্বে ইতালি এবং সদস্যদের মধ্যে কানাডা, মেক্সিকো, স্পেন, পাকিস্তান, দক্ষিণ কোরিয়া ও তুরস্ক রয়েছে - তারা ভেটো ক্ষমতা ছাড়াই অস্থায়ী সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধির পক্ষে। তবে ভারতের অবস্থান হলো যে নতুন স্থায়ী সদস্যদের অবশ্যই ভেটো ক্ষমতা থাকতে হবে।
আঞ্চলিক বিরোধিতা
পাকিস্তান ধারাবাহিকভাবে ভারতের দাবির বিরোধিতা করে এসেছে ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনার কারণে। এছাড়াও দক্ষিণ এশিয়ার কিছু দেশ ভারতের আঞ্চলিক নেতৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।
কাঠামোগত জটিলতা
জাতিসংঘ সনদের ১০৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, সংস্কারের জন্য সাধারণ পরিষদের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের সমর্থন এবং সকল স্থায়ী সদস্যের (P5) অনুমোদন প্রয়োজন। এটি একটি জটিল ও সময়সাপেক্ষ প্রক্রিয়া।
ভবিষ্যতের সম্ভাবনা
G4 জোটের শক্তি
ভারত, জার্মানি, জাপান ও ব্রাজিল নিয়ে গঠিত G4 জোট একে অপরের দাবিকে সমর্থন করে। এই ঐক্যবদ্ধ অবস্থান ইউএনএসসি সংস্কারের জন্য একটি শক্তিশালী চাপ সৃষ্টি করছে।
ক্রমবর্ধমান বৈশ্বিক সমর্থন
জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস নিজেই বলেছেন যে নিরাপত্তা পরিষদকে "২০২৫ সালের বিশ্বের প্রতিনিধিত্ব করতে হবে, ১৯৪৫ সালের নয়"। তিনি ভারতকে "বহুপক্ষীয় ব্যবস্থায় একটি গুরুত্বপূর্ণ কণ্ঠস্বর" হিসেবে অভিহিত করেছেন।
কূটনৈতিক চাপ বৃদ্ধি
ইউএনজিএ ২০২৫-এ বিভিন্ন দেশের সমর্থনের মাধ্যমে ভারতের অবস্থান আরও শক্তিশালী হয়েছে। এই ক্রমবর্ধমান আন্তর্জাতিক চাপ অবশেষে চীনকেও তার অবস্থান পুনর্বিবেচনায় বাধ্য করতে পারে।
উপসংহার: একটি ঐতিহাসিক মোড়
যদিও চীন এখনও সরাসরি ভারতের স্থায়ী আসনকে সমর্থন করেনি, তবু ২০২৫ সালের ঘটনাগুলি একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়। ব্রিকস ঘোষণায় চীনের সহযোগিতা, রাশিয়ার স্পষ্ট সমর্থন, এবং ক্রমবর্ধমান আন্তর্জাতিক সমর্থন ভারতের দাবিকে নতুন মাত্রা দিয়েছে।
বৈশ্বিক শক্তির ভারসাম্য যখন পরিবর্তিত হচ্ছে এবং বহুমেরুকেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থা গড়ে উঠছে, তখন ভারতের মতো একটি প্রভাবশালী গণতান্ত্রিক শক্তির জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে স্থায়ী আসন পাওয়া শুধু ন্যায়সঙ্গত নয়, বরং বিশ্ব শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্যও প্রয়োজনীয়।
ভারতের দীর্ঘ কূটনৈতিক সংগ্রাম এবং ক্রমবর্ধমান বৈশ্বিক প্রভাবের ফলে, ইউএনএসসিতে স্থায়ী আসন পাওয়ার স্বপ্ন আর শুধু একটি আকাঙ্ক্ষা নয় - বরং একটি অনিবার্য বাস্তবতার দিকে এগিয়ে চলেছে। আগামী কয়েক বছরে এই ঐতিহাসিক পরিবর্তন সাক্ষী হতে পারে বিশ্ব।
