ভারতীয় বিমানবাহিনীর ইতিহাসে সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী এবং বিতর্কিত যুদ্ধবিমান মিকোয়ান-গুরেভিচ মিগ-২১ অবশেষে তার চূড়ান্ত উড়ান সম্পন্ন করেছে। ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, চণ্ডীগড় বিমানঘাঁটিতে একটি জাঁকজমকপূর্ণ বিদায় অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এই কিংবদন্তি যুদ্ধবিমানটি ৬২ বছরের গৌরবময় সেবার পর অবসর গ্রহণ করেছে। ১৯৬৩ সালে প্রথম ভারতীয় অতিধ্বনিক যুদ্ধবিমান হিসেবে এর যাত্রা শুরু থেকে, একাধিক যুদ্ধে অংশগ্রহণ এবং ২০১৯ সালে পাকিস্তানি F-16 বিমান ধ্বংস করার মতো ঐতিহাসিক কৃতিত্ব অর্জন পর্যন্ত, মিগ-২১ ভারতের বায়ু শক্তির মেরুদণ্ড হিসেবে কাজ করেছে।

সোভিয়েত প্রযুক্তি থেকে ভারতীয় আত্মনির্ভরতার সূচনা
মিগ-২১ কেবল একটি যুদ্ধবিমান ছিল না, বরং এটি ভারত-রাশিয়া কৌশলগত অংশীদারিত্বের একটি জীবন্ত প্রতীক। ১৯৬০-এর দশকের প্রথম দিকে, পাকিস্তান ও চীনের সাথে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনার পরিপ্রেক্ষিতে ভারত একটি আধুনিক অতিধ্বনিক যুদ্ধবিমানের প্রয়োজন অনুভব করে। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর সরকার তিনটি প্রধান বিকল্পের মুখোমুখি হয়েছিল: আমেরিকার F-104 স্টারফাইটার, ফ্রান্সের মিরাজ এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের মিগ-২১।
যা সোভিয়েত ইউনিয়নের পক্ষে সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করেছিল তা হলো সম্পূর্ণ প্রযুক্তি হস্তান্তরের প্রস্তাব যা ভারতকে নিজে বিমান তৈরি করার সুযোগ দিয়েছিল। ভারত শর্ত দিয়েছিল যে যেকোনো চুক্তিতে অবশ্যই প্রযুক্তি হস্তান্তর অন্তর্ভুক্ত থাকতে হবে, যেখানে সংযোজন এবং পরবর্তী উৎপাদন দেশের অভ্যন্তরে হবে। আমেরিকা পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ককে অগ্রাধিকার দিয়ে ভারতের সাথে F-104 চুক্তিতে খুব একটা আগ্রহ দেখায়নি, অনুরূপভাবে ফ্রান্স তার মিরাজ প্রযুক্তি ভাগাভাগি করতে দ্বিধাগ্রস্ত ছিল।
কংগ্রেস নেতা জয়রাম রমেশ উল্লেখ করেছেন, "এটি সোভিয়েত ইউনিয়নের ভারতের শর্তাবলী HAL দ্বারা স্থানীয় উৎপাদন এবং প্রযুক্তি হস্তান্তরের জন্য গ্রহণ যা যুক্তরাজ্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স এবং সুইডেনের প্রতিযোগীদের উপর সোভিয়েত বিমানের পছন্দকে প্রভাবিত করেছিল"। নেহরু এবং তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রী ভি.কে. কৃষ্ণ মেনন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য থেকে তীব্র চাপ সত্ত্বেও দৃঢ় থেকেছিলেন।
১৯৬২ সালের ২২ আগস্ট ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে মিগ-২১ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যা প্রতিরক্ষা খাতে গভীর ভারত-সোভিয়েত সহযোগিতার পথ প্রশস্ত করে। এই চুক্তি হিন্দুস্তান অ্যারোনটিক্স লিমিটেড (HAL) কে মিগ-২১ উৎপাদনের লাইসেন্স প্রাপ্তির সুযোগ দেয়, যা ভারতের জন্য একটি যুগান্তকারী পরিবর্তন প্রমাণিত হয়।
মিগ-২১: ভারতীয় বিমানবাহিনীর মেরুদণ্ড
১৯৬৩ সালে চণ্ডীগড়ে ২৮ স্কোয়াড্রনে প্রথম ছয়টি মিগ-২১ বিমান অন্তর্ভুক্ত হয়, যা "প্রথম সুপারসনিক" নামে পরিচিত হয়ে ওঠে। ভারতের প্রথম অতিধ্বনিক যুদ্ধবিমান হিসেবে এর গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। সোভিয়েত ইউনিয়নের বাইরে ভারত ছিল মিগ-২১-এর সবচেয়ে বড় ব্যবহারকারী, যেখানে HAL দেশীয়ভাবে প্রায় ৬০০টি যুদ্ধবিমান উৎপাদন করে মোট ৮৭২টি বিমানের মধ্যে যা ১৯৬৬ থেকে ১৯৮০ সালের মধ্যে ভারতীয় বিমানবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল।
মিগ-২১ কেবল ভারতীয় বিমানবাহিনীর সংখ্যাগত শক্তিই ছিল না, বরং এটি তার মোট জীবনকালের দুই-তৃতীয়াংশ সময় ধরে ভারতের প্রধান যুদ্ধবিমান হিসেবে কাজ করেছে। সোভিয়েত মিকোয়ান-গুরেভিচ ডিজাইন ব্যুরো দ্বারা ১৯৫০-এর দশকে ডিজাইন করা এই বিমানটি ১৯৬৩ সালে ভারতীয় বিমানবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার সময় একটি প্রযুক্তিগত বিস্ময় ছিল।
বিভিন্ন দশক জুড়ে এবং একাধিক আপগ্রেডের মাধ্যমে, মিগ-২১ ভারতের বিভিন্ন সংঘাতে তার দক্ষতা প্রমাণ করেছে, যার মধ্যে রয়েছে ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ, ১৯৭১ সালের বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ এবং ১৯৯৯ সালের কারগিল সংঘাত।
যুদ্ধক্ষেত্রে মিগ-২১-এর গৌরবগাথা
১৯৭১ সালের যুদ্ধ: প্রাথমিক প্রমাণ
একজন পশ্চিমা সামরিক বিশ্লেষকের মতে, মিগ-২১FL স্পষ্টভাবে মিগ-২১FL এবং F-104A স্টারফাইটারের মধ্যে প্রত্যাশিত বায়ু যুদ্ধে "জয়ী" হয়েছিল। ভারতের মিগ-২১-এর পারফরম্যান্সের কারণে ইরাকসহ বেশ কয়েকটি দেশ ভারতের কাছে মিগ-২১ পাইলট প্রশিক্ষণের জন্য যোগাযোগ করে।
কারগিল যুদ্ধ: উচ্চ উচ্চতায় শ্রেষ্ঠত্ব
১৯৯৯ সালের কারগিল যুদ্ধে, অপারেশন সফেদ সাগরে - ভারতীয় সেনাবাহিনীর অপারেশন বিজয়ে ভারতীয় বিমানবাহিনীর সহায়তায় - মিগ-২১ মিরাজ ২০০০, মিগ-২৯, মিগ-২৩, মিগ-২৭ এবং জাগুয়ারের সাথে উড়েছিল, হিমালয়ের বিশ্বের কঠোরতম যুদ্ধ ভূখণ্ডে শাস্তিমূলক আঘাত হানে। এই বিমানগুলি তাদের নির্ধারিত ক্ষমতার বাইরে অস্ত্র ব্যবহার করে সেই উচ্চতায় শত্রুর কমান্ড এবং নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র ধ্বংস করেছিল, যা পাইলটদের দক্ষতা এবং প্রশিক্ষণের গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে কার্যকর হওয়ার প্রমাণ।
২০১৯: ইতিহাস সৃষ্টিকারী F-16 সংহার
বালাকোট অভিযানের পরবর্তী ঘটনা
২০১৯ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি, মিগ-২১ বিশ্বব্যাপী শিরোনাম হয়ে ওঠে যখন উইং কমান্ডার অভিনন্দন বর্তমান তার মিগ-২১ বাইসন বিমান দিয়ে একটি পাকিস্তানি F-16 যুদ্ধবিমান ধ্বংস করেন। এই ঘটনা ঘটেছিল পাকিস্তানের প্রতিশোধমূলক আক্রমণের প্রচেষ্টার পর, যা ভারত ২৬ ফেব্রুয়ারি জইশ-ই-মোহাম্মদের সন্ত্রাসী শিবিরে বালাকোট বিমান হামলার পর করেছিল।
২৭ ফেব্রুয়ারি সকাল ৯:৫৫ টার দিকে, পাকিস্তান বিমানবাহিনীর একটি বিশাল বাহিনী যা উন্নত চতুর্থ প্রজন্মের F-16 এবং JF-17 নিয়ে গঠিত, নিয়ন্ত্রণ রেখার দিকে এগিয়ে আসতে দেখা যায়। কয়েক মিনিটের মধ্যে, তৎকালীন উইং কমান্ডার অভিনন্দন বিমানগুলি আটক করার জন্য উড্ডয়ন করেন এবং তার মিগ-২১ বাইসনের এয়ারবর্ন ইন্টারসেপ্ট (AI) রাডার দিয়ে নিম্ন উচ্চতার আকাশসীমা স্ক্যান করেন।
কৌশলগত শ্রেষ্ঠত্ব ও সাহসিকতা
অভিনন্দনের বীরত্বের জন্য পরবর্তীতে প্রদত্ত বীর চক্র সম্মাননার উদ্ধৃতিতে বলা হয়েছে: "ব্যতিক্রমী বায়ু যুদ্ধ দক্ষতা এবং শত্রুর কৌশল সম্পর্কে জ্ঞান প্রদর্শন করে, অভিনন্দন তার এয়ারবর্ন ইন্টারসেপ্ট (AI) রাডার দিয়ে নিম্ন উচ্চতার আকাশসীমা স্ক্যান করেন এবং একটি শত্রু বিমান শনাক্ত করেন যা ভারতীয় যুদ্ধবিমান প্রতিরোধকারী বিমানগুলির উপর অতর্কিত আক্রমণের জন্য নিচু দিয়ে উড়ছিল"।
অভিনন্দন অন্যান্য গঠন পাইলটদের এই আকস্মিক হুমকি সম্পর্কে সতর্ক করেন এবং শত্রু পাকিস্তানি জেটের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক গঠনে তার উইংম্যানকে সংগঠিত করেন। অভিনন্দনের "সাহসী এবং আক্রমণাত্মক কৌশল" শত্রু বিমানকে "কৌশলগত বিশৃঙ্খলায়" বাধ্য করে। পশ্চাদপসরণকারী F-16 যুদ্ধবিমানটি অনুসরণ করে অভিনন্দন তার অনবোর্ড ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে সেটি ধ্বংস করেন।
তবে, এই সংঘর্ষে শত্রু বিমানগুলির মধ্যে একটি একাধিক উন্নত BVR ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে, যার মধ্যে একটি তার বিমানে আঘাত করে তাকে শত্রু ভূখণ্ডে নিক্ষেপ করতে বাধ্য করে। তিনি পাকিস্তান-অধিকৃত কাশ্মীরে (PoK) শত্রুদের দ্বারা বন্দী হন এবং ১ মার্চ ২০১৯ সালে প্রত্যাবর্তিত হন।
বিতর্ক ও প্রমাণ
এই F-16 ধ্বংসের দাবি নিয়ে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ব্যাপক বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। ভারতীয় বিমানবাহিনী একটি AIM-120 AMRAAM ক্ষেপণাস্ত্রের অংশ প্রদর্শন করে প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করে, যা কেবল F-16 দ্বারা নিক্ষেপ করা যেতে পারে। ভারতীয় বিমানবাহিনী দাবি করে যে তারা সংঘর্ষে জড়িত বিমানগুলির ইলেকট্রনিক স্বাক্ষর শনাক্ত করেছে এবং F-16-এর ব্যবহার নিশ্চিত করেছে।
পাকিস্তান এই দাবি অস্বীকার করেছে এবং বলেছে যে পাকিস্তান বিমানবাহিনী কোনো ক্ষতির সম্মুখীন হয়নি। ২০১৯ সালের এপ্রিলে, ফরেন পলিসি ম্যাগাজিন দুজন নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক মার্কিন প্রতিরক্ষা কর্মকর্তার উদ্ধৃতি দিয়ে রিপোর্ট করে যে একটি নিরীক্ষায় কোনো পাকিস্তানি F-16 অনুপস্থিত পাওয়া যায়নি। তবে পরদিন মার্কিন প্রতিরক্ষা বিভাগ জানায় যে তারা এ ধরনের কোনো তদন্ত সম্পর্কে "অবগত নন"।
"উড়ন্ত কফিন" বিতর্ক: সত্য নাকি কুসংস্কার?
মিগ-২১-এর সবচেয়ে বিতর্কিত দিক হলো এর "উড়ন্ত কফিন" এবং "বিধবা সৃষ্টিকারী" ডাকনাম। ১৯৭০ সাল থেকে ভারতে ১৭০ জনের বেশি পাইলট এবং ৪০ জন বেসামরিক ব্যক্তি মিগ-২১ দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন। ১৯৬৬ থেকে ১৯৮৪ সালের মধ্যে নির্মিত ৮৪০টি বিমানের অর্ধেকেরও বেশি দুর্ঘটনায় হারিয়ে গেছে।
তবে এই পরিসংখ্যানগুলির একটি গভীর বিশ্লেষণ ভিন্ন চিত্র তুলে ধরে। ২৬ সেপ্টেম্বরে একটি সেমিনারে উপস্থাপিত প্রাক্তন ভারতীয় বিমানবাহিনী প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল বি.এস. ধনোয়ার তথ্য অনুযায়ী, মিগ-২১-এর দুর্ঘটনার হার ২.৯৫ - যা গ্ন্যাট (৬.৮৮) এবং হান্টার (৪.২৬) থেকে কম এবং মিগ-২৩ (২.৯৫) ও মিগ-২৭ (৩.০৪) এর প্রায় সমান।
প্রাক্তন ভারতীয় বিমানবাহিনী প্রধানের মতে, মিগ-২১ মোট ১৫,৮৪,৫২২ ঘণ্টা সেবামূলক উড্ডয়ন সম্পন্ন করেছে এবং ৪৬৮টি দুর্ঘটনার সম্মুখীন হয়েছে। তুলনামূলকভাবে, গ্ন্যাট ৯২টি, হান্টার ৮৬টি, মিগ-২৩ ৬৯টি এবং মিগ-২৭ ৬৪টি দুর্ঘটনা দেখেছে।
এয়ার মার্শাল ধনোয়া বলেছেন, "এই বিমানটিকে কোনো অন্ধকার ডাকনাম বা বিবরণ দিয়ে ট্যাগ করা অন্যায় ছিল। মিগ-২১-এর সাথে তার প্রজন্মের অন্যান্য বিমানের উড্ডয়ন সময় এবং নথিভুক্ত দুর্ঘটনার তুলনা, এবং প্রতি ঘণ্টায় সর্টির সংখ্যার দিকে তাকালে, মিগ-২১ আসলে সবচেয়ে কম দুর্ঘটনার হার ছিল। (মার্কিন) F-104 স্টারফাইটার নিরাপত্তার কারণে পর্যায়ক্রমে বন্ধ করা হয়েছিল, কিন্তু মিগ-২১ পর্যায়ক্রমে বন্ধ করা হচ্ছে কারণ এর মোট প্রযুক্তিগত জীবন শেষ - নিরাপত্তার সমস্যার কারণে নয়"।
আকর্ষণীয়ভাবে, ২০০০-এর দশকের পরে মিগ-২১-এর দুর্ঘটনার হার উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে। সরকারি তথ্য অনুযায়ী ছয় দশকে রেকর্ড করা ৪৮০টির বেশি দুর্ঘটনার মধ্যে ২০১০ সালের পর মাত্র প্রায় ২০টি ঘটেছে - মোট সংখ্যার ৫% এরও কম।
রাশিয়ার প্রযুক্তি: ভারতের আত্মনির্ভরতার ভিত্তি
মিগ-২১ চুক্তি ভারত ও রাশিয়ার মধ্যে প্রতিরক্ষা সহযোগিতার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিল যা আজও অব্যাহত রয়েছে। এই চুক্তি একটি সাধারণ ক্রেতা-বিক্রেতার সম্পর্ক থেকে যৌথ গবেষণা, ডিজাইন উন্নয়ন এবং অত্যাধুনিক সামরিক প্ল্যাটফর্ম উৎপাদনে বিকশিত হয়েছে। বর্তমানে চলমান দ্বিপক্ষীয় প্রকল্পগুলির মধ্যে রয়েছে T-90 ট্যাঙ্কের স্বদেশীয় উৎপাদন এবং Su-30-MKI বিমান, মিগ-২৯-কে বিমান ও কামভ-৩১ এবং Mi-17 হেলিকপ্টার সরবরাহ, মিগ-২৯ বিমানের আপগ্রেড।
প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং মিগ-২১-এর বিদায় অনুষ্ঠানে বলেছেন, "মিগ-২১ কেবল একটি বিমান নয় বরং ভারত ও রাশিয়ার গভীর সম্পর্কের একটি উজ্জ্বল উদাহরণ"। তিনি এই কিংবদন্তি জেটটিকে একটি "শক্তিশালী যন্ত্র, জাতীয় গর্ব এবং প্রতিরক্ষা ঢাল" হিসেবে প্রশংসা করেছেন যা দেশের আত্মবিশ্বাস গঠন করেছে এবং প্রজন্মের পর প্রজন্মের বিমান যোদ্ধাদের অনুপ্রেরণা দিয়েছে।
ব্রহ্মোস ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র উৎপাদন এই প্রবণতার একটি উদাহরণ। দুই দেশ পঞ্চম প্রজন্মের ফাইটার এয়ারক্রাফট এবং মাল্টি-রোল ট্রান্সপোর্ট এয়ারক্রাফটের যৌথ ডিজাইন ও উন্নয়নেও নিযুক্ত রয়েছে।
মিগ-২১ অবসরের পর ভারতের ভবিষ্যৎ বায়ু শক্তি
বর্তমান চ্যালেঞ্জ ও স্কোয়াড্রন সংকট
মিগ-২১-এর অবসরের সাথে সাথে ভারতীয় বিমানবাহিনী এখন ২৯টি ফাইটার স্কোয়াড্রনে নেমে এসেছে, যা বিমানবাহিনীর অনুমোদিত শক্তির ৭০% এরও কম। এটি উদ্বেগজনক কারণ এই সংখ্যা ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় ভারতীয় বিমানবাহিনীর স্কোয়াড্রন সংখ্যার চেয়েও কম, যখন তার ৩২টি স্কোয়াড্রন ছিল।
যুগান্তকারী সোভিয়েত-যুগের ফাইটারগুলি যে এত দীর্ঘকাল সেবায় রয়েছে তা ভারতীয় বিমানবাহিনীর সামনে স্থায়ী চ্যালেঞ্জের প্রমাণ। যখন তারা ১৯৬ৣ সালে সেবায় প্রবেশ করেছিল, তখন ভারতীয় বিমানবাহিনীর প্রধান ইন্টারসেপ্টর হিসেবে - রক্ষণাত্মক বিমান থেকে বিমান যুদ্ধের জন্য ব্যবহৃত ফাইটার, শত্রু বিমান 'আটক' করতে - মিগ-২১গুলি যুক্তিযুক্তভাবে গ্রহে সেরা ফাইটার ছিল।
প্রতিস্থাপনের পরিকল্পনা ও নতুন প্রজন্মের বিমান
মিগ-২১-এর প্রাথমিক উত্তরসূরি হলো HAL তেজস LCA, যা মূলত মিগ-২১-এর কম্প্যাক্ট, চপল প্রোফাইল প্রতিস্থাপনের জন্য চতুর্থ প্রজন্মের প্রযুক্তি অন্তর্ভুক্ত করে ডিজাইন করা হয়েছে। ৪০টিরও বেশি তেজস Mk1 দুটি স্কোয়াড্রনে কর্মক্ষম রয়েছে, ২০২১ সালে ৮৩টি Mk1A অর্ডার করা হয়েছে এবং ২০২৫ সালে আরও ৯৭টি, যা মোট ১৮০ ইউনিট GE F404 ইঞ্জিন দ্বারা চালিত।
Mk1A এর বৈশিষ্ট্য রয়েছে AESA রাডার, উন্নত জ্যামার এবং অস্ত্র BVR ক্ষেপণাস্ত্রের মতো স্বদেশী যুদ্ধাস্ত্র, যা ভারতীয় আকাশসীমার মধ্যে রক্ষণাত্মক ভূমিকার জন্য উপযুক্ত। ৩ নম্বর এবং ২৩ নম্বর স্কোয়াড্রনের মতো স্কোয়াড্রনগুলি Mk1A গ্রহণ করবে, যা সরাসরি মিগ-২১ প্রতিস্থাপন করবে।
মাল্টিরোল মিশনের জন্য, পাইলটরা ২০১৬ সাল থেকে অন্তর্ভুক্ত ৩৬টি দাসাউল্ট রাফালে স্থানান্তরিত হতে পারে, যার মাল্টি-রোল ফাইটার এয়ারক্রাফট (MRFA) প্রোগ্রামের অধীনে আরও ১১৪টির পরিকল্পনা রয়েছে। রাফালের টুইন-ইঞ্জিন ডিজাইন উচ্চতর পরিসর এবং অগ্নিশক্তি প্রদান করে, যা আক্রমণাত্মক অপারেশনের জন্য আদর্শ।
এছাড়াও, আপগ্রেড করা Su-30MKI (২৭২টি সেবায় রয়েছে) ভারী মাল্টিরোল ক্ষমতা প্রদান করে, মিগ-২১ পটভূমির পাইলটদের ক্রস-ট্রেইনিং এর সম্ভাবনা রয়েছে।
ভবিষ্যৎ প্রযুক্তি ও উন্নয়ন
দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনায়, ২০২৫ সালে প্রত্যাশিত তেজস Mk2 প্রোটোটাইপ, ২০২৭ সালে প্রথম উড্ডয়ন মিরাজ ২০০০, মিগ-২৯ এবং জাগুয়ার প্রতিস্থাপন করবে, যা আরও বেশি স্থায়িত্ব এবং স্টিলথ সহ। পঞ্চম প্রজন্মের অ্যাডভান্সড মিডিয়াম কমব্যাট এয়ারক্রাফট (AMCA) ২০৩২ সালের মধ্যে অন্তর্ভুক্তির লক্ষ্য রেখে বহরকে পরিপূরক করবে।
বর্তমানে ইঞ্জিন প্রযুক্তি হস্তান্তরে (যেমন, Mk2 এর জন্য GE F414) এবং উৎপাদনে বিলম্ব চ্যালেঞ্জ তুলে ধরছে, তবে প্রতিরক্ষা উৎপাদনে ২৭% স্বদেশী বৃদ্ধি এই পরিবর্তনকে সমর্থন করছে।
উপসংহার: একটি যুগের সমাপনী ও নতুন সূচনা
মিগ-২১-এর অবসর শুধুমাত্র একটি বিমানের প্রস্থান নয়, বরং ভারতীয় বিমানবাহিনীর ইতিহাসে একটি সম্পূর্ণ যুগের সমাপনী। ৬২ বছরের গৌরবময় সেবায় এই কিংবদন্তি যুদ্ধবিমান ভারতের বায়ু প্রতিরক্ষার মেরুদণ্ড হিসেবে কাজ করেছে, একাধিক যুদ্ধে বিজয় এনেছে এবং শেষ পর্যন্ত একটি আধুনিক চতুর্থ প্রজন্মের F-16 কে পরাজিত করে তার শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করেছে।
সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে প্রযুক্তি হস্তান্তর চুক্তি থেকে শুরু করে স্বদেশী উৎপাদনের মাধ্যমে ভারতের আত্মনির্ভরতার যাত্রায় মিগ-২১ একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এই বিমানটি শুধু ভারতকে রক্ষা করেনি, বরং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য প্রতিরক্ষা স্বনির্ভরতার পথ দেখিয়েছে।
"উড়ন্ত কফিন" ডাকনাম সত্ত্বেও, পরিসংখ্যান এবং বিশেষজ্ঞদের মতামত প্রমাণ করে যে মিগ-২১ আসলে তার সমসাময়িকদের তুলনায় নিরাপদ ছিল। এর দুর্ঘটনাগুলি মূলত দীর্ঘমেয়াদী ব্যবহার এবং ট্রেনার হিসেবে অনুপযুক্ত ব্যবহারের ফলাফল ছিল, প্রযুক্তিগত ত্রুটির কারণে নয়।
এখন যখন ভারতীয় বিমানবাহিনী তেজস, রাফালে এবং ভবিষ্যতের AMCA এর মতো আধুনিক বিমানের দিকে এগিয়ে চলেছে, মিগ-২১-এর উত্তরাধিকার তাদের পথ দেখাতে থাকবে। এই কিংবদন্তি বিমানটি প্রমাণ করেছে যে সঠিক কৌশল, দক্ষ পাইলট এবং দৃঢ় সংকল্প দিয়ে এমনকি পুরনো প্রযুক্তিও আধুনিক হুমকির বিরুদ্ধে কার্যকর হতে পারে।
মিগ-২১ এর চূড়ান্ত উড্ডয়ন ভারতীয় বিমানবাহিনীর জন্য একটি আবেগময় মুহূর্ত, কিন্তু এটি একইসাথে একটি নতুন যুগের সূচনাও করেছে - এমন একটি যুগ যেখানে ভারতের বায়ু শক্তি আরও শক্তিশালী, আরও আধুনিক এবং আরও আত্মনির্ভরশীল হবে।