আগামী অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে ভারত তার ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ত্রিবাহিনী ড্রোন ও কাউন্টার-ড্রোন মহড়া "অপারেশন কোল্ড স্টার্ট ২০২৫" পরিচালনা করতে চলেছে। মধ্যপ্রদেশে অনুষ্ঠিতব্য এই যুগান্তকারী সামরিক অনুশীলনে ভারতীয় সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনী যৌথভাবে অংশগ্রহণ করবে। এই মহড়া শুধুমাত্র ভারতের প্রতিরক্ষা সক্ষমতার প্রদর্শন নয়, বরং পাকিস্তানের প্রতি একটি শক্তিশালী কৌশলগত বার্তাও বটে।

অপারেশন সিন্দূর থেকে কোল্ড স্টার্ট: প্রেক্ষাপট ও বিবর্তন
২০২৫ সালের মে মাসে সংঘটিত অপারেশন সিন্দূরের পর ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে প্রথমবারের মতো ব্যাপক ড্রোন যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। পাহালগাম সন্ত্রাসী হামলার জবাবে ভারত যে নির্ভুল ও সীমিত পরিসরের পাল্টা আক্রমণ পরিচালনা করেছিল, তার পরবর্তী পাকিস্তানি প্রতিক্রিয়া ভবিষ্যত যুদ্ধের চেহারাকে আমূল পরিবর্তন করে দিয়েছে।
পাকিস্তান তার প্রতিক্রিয়ায় ৩০০-৫০০ ড্রোন দিয়ে ভারতের ২৪টি শহরে সমন্বিত হামলা চালানোর চেষ্টা করেছিল, যার মধ্যে তুর্কি নির্মিত এএসজিইউএআরডি সংগার যুদ্ধবিমান ও নিরীক্ষণ ড্রোনও ছিল। কিন্তু ভারতের শক্তিশালী সমন্বিত কাউন্টার-ড্রোন গ্রিড ও বহুস্তরীয় বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এই আক্রমণসূচি সফলভাবে প্রতিহত করেছে।
অপারেশন কোল্ড স্টার্ট ২০২৫: লক্ষ্য ও কৌশল
এই বিশাল সামরিক মহড়ার মূল উদ্দেশ্যগুলি হলো:
সোয়ার্ম ট্যাকটিক্স: একসাথে শত শত ড্রোনের সমন্বিত আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা
ইলেক্ট্রনিক ওয়ারফেয়ার: জিপিএস জ্যামিং ও ইলেক্ট্রনিক কাউন্টার মেজার পরীক্ষা
লয়টারিং মিউনিশন: আত্মঘাতী ড্রোনের বিরুদ্ধে কার্যকর প্রতিরোধ ব্যবস্থা
স্তরীভূত বিমান প্রতিরক্ষা: বহুমুখী হুমকির বিরুদ্ধে সমন্বিত প্রতিরক্ষা কৌশল
মহড়াটি অক্টোবর ৬-১০ তারিখ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হবে এবং এতে প্রতিরক্ষা শিল্প, গবেষণা সংস্থা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরাও অংশগ্রহণ করবেন। হেডকোয়ার্টার ইন্টিগ্রেটেড ডিফেন্স স্টাফ (এইচকিউ আইডিএস) এই মহড়ার আয়োজক।
ড্রোন প্রযুক্তিতে ভারতের অগ্রগতি
স্বদেশি ড্রোন উন্নয়ন
ভারত তার আত্মনির্ভর প্রতিরক্ষা কৌশলের অংশ হিসেবে একাধিক উন্নত ড্রোন প্রযুক্তি বিকশিত করেছে:
ভীষণ লয়টারিং মিউনিশন সিস্টেম: ৩০ কিলোমিটার পাল্লার এই স্বদেশি আত্মঘাতী ড্রোন সিস্টেমটি সোয়ার্ম ক্যাপাবিলিটি সংবলিত এবং একসাথে একাধিক লক্ষ্যবস্তুতে নির্ভুল আঘাত হানতে পারে।
রুদ্রাস্ত্র হাইব্রিড ভিটিওএল ইউএভি: ১৭০ কিলোমিটার পাল্লার এই কৌশলগত ড্রোনটি পার্বত্য ও দুর্গম অঞ্চলে রিয়েল-টাইম নিরীক্ষণ ও উচ্চ গতির যুদ্ধে ব্যবহৃত হয়।
এমবিসি২ সোয়ার্ম ড্রোন: হাতের তালু আকারের এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন ড্রোনগুলি স্বয়ংক্রিয়ভাবে শত্রু সৈন্যদের খুঁজে বের করে নির্মূল করতে পারে।
কাউন্টার-ড্রোন প্রযুক্তি
ভারত আক্রমণাত্মক ড্রোনের পাশাপাশি কাউন্টার-ড্রোন প্রযুক্তিতেও উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধন করেছে:
ভার্গবাস্ত্র: সোলার ডিফেন্স অ্যান্ড অ্যারোস্পেস লিমিটেড কর্তৃক উন্নয়নকৃত এই সিস্টেমটি ১৬ সেকেন্ডে ৬৪টি মাইক্রো রকেট নিক্ষেপ করে ড্রোন সোয়ার্ম ধ্বংস করতে পারে।
ইন্দ্রজাল: হায়দ্রাবাদ ভিত্তিক একটি স্টার্টআপ কর্তৃক উন্নয়নকৃত এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা চালিত প্রতিরক্ষা গ্রিড ৪,০০০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা নিরাপত্তা প্রদান করতে পারে।
ডিআরডিও অ্যান্টি-ড্রোন সিস্টেম: ৩৬০ ডিগ্রি রাডার কভারেজ সহ এই সিস্টেম ৪ কিলোমিটার পর্যন্ত ড্রোন শনাক্ত করে ১ কিলোমিটার পরিসরে নিরপেক্ষ করতে পারে।
মিশন সুদর্শন চক্র: ভবিষ্যতের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা
অপারেশন কোল্ড স্টার্ট ভারতের উচ্চাভিলাষী "মিশন সুদর্শন চক্র" প্রকল্পের একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। ২০৩৫ সালের মধ্যে সম্পূর্ণ হওয়ার কথা থাকা এই বহুস্তরীয় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ইসরায়েলের আয়রন ডোমের মতো কার্যকারিতা প্রদান করবে।
এই সিস্টেমে থাকবে:
- স্পেস-বেসড ট্র্যাকিং: মহাকাশভিত্তিক হুমকি নিরীক্ষণ
- এআই-পাওয়ার্ড কমান্ড সেন্টার: কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা চালিত স্বয়ংক্রিয় প্রতিক্রিয়া ব্যবস্থা
- মাল্টি-লেয়ার ইন্টারসেপ্টর: বিভিন্ন পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরোধ ব্যবস্থা
- ডিরেক্টেড এনার্জি ওয়েপন: লেজার ভিত্তিক উচ্চশক্তি অস্ত্র ব্যবস্থা
কৌশলগত তাৎপর্য: পাকিস্তানের প্রতি বার্তা
এই মহড়ার মাধ্যমে ভারত পাকিস্তানের প্রতি স্পষ্ট বার্তা পাঠাচ্ছে যে:
প্রযুক্তিগত শ্রেষ্ঠত্ব: ভারতের ড্রোন ও কাউন্টার-ড্রোন প্রযুক্তি পাকিস্তানের চেয়ে অনেক এগিয়ে
দ্রুত প্রতিক্রিয়া: ভবিষ্যতে যেকোনো আগ্রাসনের জবাব হবে আরো দ্রুত ও কার্যকর
পারমাণবিক নিরুৎসাহকরণ: উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে পাকিস্তানের পারমাণবিক হুমকি প্রশমন
পাকিস্তানের কৌশল ও ভারতের পাল্টা কৌশল
পাকিস্তান ভারতের কোল্ড স্টার্ট ডক্ট্রিনের বিরুদ্ধে কৌশলগত পারমাণবিক অস্ত্র (টিএনডব্লিউ) ব্যবহারের হুমকি দিয়ে এসেছে। নাসর ক্ষেপণাস্ত্রের মতো স্বল্প পাল্লার পারমাণবিক অস্ত্র দিয়ে ভারতীয় যুদ্ধক্ষেত্রে আক্রমণের পরিকল্পনা রয়েছে পাকিস্তানের।
কিন্তু ভারতের ড্রোন-কেন্দ্রিক যুদ্ধ কৌশল এই হুমকির প্রভাব কমিয়ে দিয়েছে:
- নির্ভুলতা: ড্রোন আক্রমণ এতই নির্ভুল যে পাকিস্তান পারমাণবিক প্রতিক্রিয়ার ন্যায্যতা প্রমাণ করতে পারবে না
- দ্রুততা: দ্রুত আঘাতের কারণে আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপের সময় পাওয়া যাবে না
- স্বল্প ক্ষয়ক্ষতি: মানুষের প্রাণহানি কম থাকায় এসকেলেশনের সম্ভাবনা হ্রাস পাবে
ভবিষ্যতের যুদ্ধের চেহারা
অপারেশন কোল্ড স্টার্ট ২০২৫ শুধুমাত্র একটি সামরিক মহড়া নয়, এটি ভবিষ্যতের যুদ্ধের নতুন দিগন্তের প্রতিনিধিত্ব করে। আধুনিক যুদ্ধে ড্রোনের ভূমিকা এখন আর সহায়তাকারী নয়, বরং মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করছে।
রাশিয়া-ইউক্রেইন যুদ্ধ থেকে প্রাপ্ত শিক্ষা ভারতের কৌশলগত পরিকল্পনায় গভীর প্রভাব ফেলেছে। স্বল্প খরচের ড্রোন দিয়ে কীভাবে ব্যয়বহুল সামরিক লক্ষ্যবস্তু ধ্বংস করা যায়, তার প্রমাণ এই যুদ্ধে স্পষ্ট হয়েছে।
আত্মনির্ভর প্রতিরক্ষার সাফল্য
অপারেশন সিন্দূরে ব্যবহৃত স্বদেশি প্রযুক্তির সাফল্য ভারতের আত্মনির্ভর প্রতিরক্ষা নীতির যৌক্তিকতা প্রমাণ করেছে। ডিআরডিওর উন্নয়নকৃত লয়টারিং মিউনিশন, এস-৪০০ সিস্টেম, বরাক-৮ ও আকাশ ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থার কার্যকারিতা বিশ্বমানের বলে প্রমাণিত হয়েছে।
২০২৪-২৫ অর্থবছরে ভারতের প্রতিরক্ষা রপ্তানি ২৪,০০০ কোটি টাকার রেকর্ড অতিক্রম করেছে, আর ২০২৯ সালের মধ্যে ৫০,০০০ কোটি টাকার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। স্বদেশি উৎপাদন ৩ লাখ কোটি টাকায় পৌঁছানোর লক্ষ্য রয়েছে ভারতের।
উপসংহার: নতুন যুগের সূচনা
অপারেশন কোল্ড স্টার্ট ২০২৫ কেবল একটি সামরিক মহড়া নয়, এটি দক্ষিণ এশিয়ার নিরাপত্তা কৌশলে একটি নতুন যুগের সূচনা করেছে। ড্রোন প্রযুক্তিতে ভারতের দক্ষতা ও আত্মনির্ভরতা এই অঞ্চলের শক্তির ভারসাম্য পরিবর্তন করে দিয়েছে।
পাকিস্তানের পারমাণবিক হুমকি এখন আর ভারতীয় নীতিনির্ধারকদের ততটা ভীত করতে পারছে না। প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতা, দ্রুত পরিনিয়োজন ক্ষমতা ও নির্ভুল আঘাতের সামর্থ্য ভারতকে একটি নতুন কৌশলগত অবস্থান প্রদান করেছে।
ভবিষ্যতের যুদ্ধ হবে প্রযুক্তি নির্ভর, দ্রুত ও অত্যন্ত নির্ভুল। অপারেশন কোল্ড স্টার্ট ২০২৫ সেই ভবিষ্যতের জন্য ভারতের প্রস্তুতির একটি উজ্জ্বল প্রমাণ। মিশন সুদর্শন চক্রের মাধ্যমে ২০৩৫ সালের মধ্যে ভারত বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী সমন্বিত বিমান ও ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার অধিকারী হবে। সেদিন ভারতের নিরাপত্তা হবে অভেদ্য এবং তার আঘাত হবে অপ্রতিরোধ্য।