২০২৫ সালের এপ্রিল-জুন ত্রৈমাসিকে ভারতের অর্থনীতি যেন বিশ্বকে একেবারে চমকে দিয়েছে। জাতীয় পরিসংখ্যান দপ্তর (NSO)-এর রিপোর্ট অনুযায়ী, এই সময়ে ভারতের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার দাঁড়িয়েছে ৭.৮%— যা গত পাঁচ ত্রৈমাসিকের মধ্যে সর্বোচ্চ।
এই খবরে শুধু ভারত নয়, গোটা বিশ্বের অর্থনৈতিক মহলই অবাক হয়ে গেছে। কারণ, যখন আন্তর্জাতিক বাজারে অস্থিরতা, আমেরিকার উচ্চ সুদের হার, মুদ্রাস্ফীতি আর নানা ভূরাজনৈতিক ঝড় বইছে— তখন ভারতের এই প্রবল উত্থানকে অনেকেই ‘অর্থনৈতিক ধাক্কা’ হিসেবে দেখছেন।
আর মজার বিষয় কী জানেন? এই প্রবৃদ্ধির খবরটা এসেছে ঠিক কয়েকদিন পরেই, যখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ভারতীয় আমদানির উপর নতুন শুল্ক বসিয়েছিলেন। ট্রাম্প ভেবেছিলেন, ভারতের রপ্তানি কমে যাবে, অর্থনীতি হোঁচট খাবে। কিন্তু উল্টোটাই হলো— ভারতীয় অর্থনীতি আরও গর্জে উঠলো। যেন ট্রাম্পের নাকের ডগায় বসে ভারত তাকে ব্যঙ্গ করে বলছে:
👉 “শুল্ক বসিয়ে তোরা ভেবেছিলি ভারত থেমে যাবে? ভুল ভেবেছিস প্রেসিডেন্ট সাহেব!”
প্রবৃদ্ধির মূল চালক: ট্রাম্পকে ভোলাল ভারত
ভারতের এই প্রবল জিডিপি প্রবৃদ্ধি হাওয়ায় তৈরি হয়নি। এর পিছনে কয়েকটি বড় কারণ কাজ করেছে—
১. শক্তিশালী দেশীয় চাহিদা
ভারতের অর্থনীতির প্রায় ৬০ শতাংশ নির্ভর করে গৃহস্থালী ভোগ ও পরিষেবা খাতে। মানুষ খাচ্ছে, ঘুরছে, অনলাইনে কেনাকাটা করছে— এই ব্যয়বহুল জীবনধারা অর্থনীতিকে প্রাণ দিচ্ছে। বাইরের বাজার বন্ধ হলেও দেশের ভেতরের এই “দোকানদারি” এতটাই জোরালো যে ট্রাম্পের শুল্ক তার সামনে কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি।
২. সরকারের অবকাঠামো বিনিয়োগ
ভারত সরকার সাম্প্রতিক বছরগুলোতে রেল, সড়ক, বিমানবন্দর, মেট্রো, ডিজিটাল অবকাঠামোতে বিপুল বিনিয়োগ করেছে। অর্থনীতিবিদরা বলেন, এ ধরনের ব্যয় “মাল্টিপ্লায়ার এফেক্ট” তৈরি করে। অর্থাৎ, এক জায়গায় টাকা ঢাললে তার ঢেউ ছড়িয়ে পড়ে নানা সেক্টরে। এভাবে নতুন কর্মসংস্থান ও উৎপাদনশীলতা বেড়ে গেছে।
৩. পরিষেবা ও উৎপাদন খাতের উত্থান
বিশেষ করে আইটি, ফাইন্যান্স, ই-কমার্স, ট্যুরিজম ও ম্যানুফ্যাকচারিং খাতের উত্থান ভারতের অর্থনীতিকে এগিয়ে দিয়েছে। এখন বিশ্বের বহু দেশ যখন উৎপাদন ঘাটতিতে ভুগছে, ভারত তখন ‘মেড ইন ইন্ডিয়া’ মন্ত্রে ভর করে শক্তিশালী বিকল্প হয়ে উঠছে।
৪. ডিজিটাল বিপ্লব
UPI, ডিজিটাল ব্যাংকিং, ই-গভর্ন্যান্স— এগুলো শুধু দৈনন্দিন জীবন সহজ করছে না, অর্থনীতিকে গতিশীলও করছে। ট্রাম্প হয়তো এখনো চেক লিখে ব্যাংকে জমা দিতে পছন্দ করেন, কিন্তু ভারতীয় গৃহিণীও এখন QR কোড স্ক্যান করে বাজার সেরে নিচ্ছেন। এটাই ভারতীয় অর্থনীতির আসল শক্তি।
৫. কাঠামোগত সংস্কার
GST, কর সংস্কার, ব্যবসা সহজীকরণ— এই ধারাবাহিক নীতি ভারতীয় অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করেছে। ফলে বিদেশি বিনিয়োগও বাড়ছে।
ট্রাম্পের শুল্কের ব্যঙ্গাত্মক পরিণতি
ডোনাল্ড ট্রাম্প সবসময় শুল্ক আর আমেরিকা-প্রথম নীতি নিয়ে গর্ব করেন। তিনি ভেবেছিলেন ভারতকে কোণঠাসা করলে আমেরিকায় সস্তায় কাজ হবে। কিন্তু বাস্তব হলো, ভারতীয় অর্থনীতি উল্টে তার সিদ্ধান্তকে নিয়ে হাসাহাসি করছে।
ট্রাম্প হয়তো এখন টুইট করে লিখবেন—
🗨️ “India is cheating America. Their GDP is growing because of my tariffs!”
কিন্তু বাস্তব হলো, ভারতের এই প্রবৃদ্ধি শুল্কের কারণে নয়, বরং দেশীয় ভোগ ও নীতিগত শক্তির কারণে। অর্থাৎ ট্রাম্পের শুল্ক যেন ভারতীয় অর্থনীতিকে শাপে বর দিয়েছে।
বৈশ্বিক প্রভাব: ভারত হলো ইঞ্জিন, ট্রাম্প রইলেন দর্শক
বিশ্বের অন্যান্য বড় অর্থনীতি যখন ধুঁকছে, ভারত তখন গর্জে উঠছে। IMF, World Bank থেকে শুরু করে EY-এর মতো পরামর্শক সংস্থাগুলো বলছে—
- ২০২৮ সালের মধ্যেই ভারত বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি হতে চলেছে।
- ২০৩৮ সালে ভারত ক্রয়ক্ষমতার বিচারে (PPP) দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি।
এখন প্রশ্ন হলো, যখন ভারত বিশ্ব অর্থনীতির ইঞ্জিন হয়ে উঠবে, তখন ট্রাম্প কী করবেন?
হয়তো হোয়াইট হাউস থেকে দাঁড়িয়ে বলবেন—
👉 “আমেরিকার জিডিপি যদি কমে, তবে দায় ভারতের। সব দোষ মোদির!”
ভবিষ্যৎ: ভারতের স্বপ্ন, ট্রাম্পের দুঃস্বপ্ন
ভারতের অর্থনীতি যে পথে এগোচ্ছে, তাতে আগামী দশকে তিনটি বড় চিত্র ফুটে উঠবে—
১. দেশীয় শিল্প ও ‘স্বদেশি’র পুনরুত্থান
ট্রাম্পের শুল্কই ভারতকে আরও বেশি করে দেশীয় উৎপাদন বাড়াতে উদ্বুদ্ধ করেছে। ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ আর ‘ভোকাল ফর লোকাল’-এর জোড়ে আগামী দিনে ভারত শুধু নিজের বাজার নয়, আফ্রিকা, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও ল্যাটিন আমেরিকারও বড় সরবরাহকারী হয়ে উঠবে।
২. প্রযুক্তি ও ডিজিটাল নেতৃত্ব
AI, ব্লকচেইন, সেমিকন্ডাক্টর উৎপাদন, ফিনটেক— এসব ক্ষেত্রে ভারত একের পর এক সাফল্য পাবে। ট্রাম্প হয়তো তখনও চীনকে দোষ দেবেন, কিন্তু বাস্তবে আমেরিকান কোম্পানিগুলো ভারত ছাড়া বাঁচতে পারবে না।
৩. বৈশ্বিক ভূরাজনীতিতে ভারতের ওজন
চীন যখন নিজের ঋণ কূটনীতিতে ফেঁসে যাবে, তখন ভারত তার স্থিতিশীল প্রবৃদ্ধির কারণে বৈশ্বিক দক্ষিণের আসল মুখপাত্র হয়ে উঠবে। ট্রাম্প হয়তো তখনও “Make America Great Again” স্লোগান দেবেন, কিন্তু বাস্তবে বিশ্বের বাজার তখন ভারতকেই “নতুন আমেরিকা” বলবে।
শেষ কথা
ভারতের এই ৭.৮% প্রবৃদ্ধি যেন ট্রাম্পের অহংকারে এক বিরাট ব্যঙ্গচিহ্ন। তিনি ভেবেছিলেন আমেরিকার শুল্কনীতিতেই বিশ্ব কাঁপবে, অথচ ভারত প্রমাণ করলো—
👉 “আমাদের ভবিষ্যৎ আমাদের হাতেই। আমেরিকার শুল্ক শুধু খবরের কাগজে শিরোনাম হয়, ভারতের জিডিপি হয়ে ওঠে ইতিহাসের মোড় ঘোরানো শক্তি।”
তবে, এই সাফল্যের পরেও কিছু চ্যালেঞ্জ সামনে রয়েছে। পরের ত্রৈমাসিকে GDP প্রবৃদ্ধি কিছুটা মন্থর হতে পারে বলে অর্থনীতিবিদরা সতর্ক করেছেন। এর প্রধান কারণ হতে পারে সম্প্রতি কার্যকর হওয়া মার্কিন শুল্ক, যা ভারতের রপ্তানি খাতকে প্রভাবিত করতে পারে। এছাড়া, বেসরকারি বিনিয়োগের ধীর গতি এবং কিছু অঞ্চলে অসম বৃষ্টির কারণে কৃষিক্ষেত্রে সম্ভাব্য প্রভাবও উদ্বেগের বিষয়।
সংক্ষেপে, ভারতের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বিশ্বকে চমকে দিলেও, এর পথ পুরোপুরি মসৃণ নয়। অভ্যন্তরীণ শক্তি এবং সরকারি নীতি এই প্রবৃদ্ধিকে টিকিয়ে রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। আগামী দিনে এই গতি ধরে রাখতে হলে রপ্তানি বৃদ্ধি, বেসরকারি বিনিয়োগ আকর্ষণ এবং কৃষি খাতের স্থিতিশীলতার উপর জোর দিতে হবে। ভারতের এই অর্থনৈতিক উত্থান প্রমাণ করে যে, সঠিক দিকনির্দেশনা ও শক্তিশালী অভ্যন্তরীণ ভিত্তি থাকলে যেকোনো প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও একটি দেশ উন্নতির পথে এগিয়ে যেতে পারে।