"মেড ইন ইন্ডিয়া" স্মার্টফোন: ভারতের উত্থান এবং বৈশ্বিক ভূ-অর্থনৈতিক রূপান্তর

 

"২০২৫ সালে ভারত থেকে আমেরিকায় স্মার্টফোন রপ্তানির তুলনামূলক বিশ্লেষণ"

বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ আমেরিকায় বর্তমানে প্রতি তিনটি স্মার্টফোনের মধ্যে একটি ভারত-নির্মিত—এই তথ্য নিঃসন্দেহে ভারতের প্রযুক্তি ও উৎপাদন খাতে এক বিপ্লবের সূচনা নির্দেশ করে। শুধুমাত্র অর্থনৈতিক দিক থেকেই নয়, এর রাজনৈতিক, কূটনৈতিক এবং বৈশ্বিক সরবরাহ শৃঙ্খলের দিক থেকেও এর ব্যাপক গুরুত্ব রয়েছে।

ভারতের উত্থান: স্মার্টফোন উৎপাদনে বিপুল সাফল্য

2025 সালের প্রথম পাঁচ মাসে আমেরিকার স্মার্টফোন আমদানির 36% এসেছে ভারত থেকে, যেখানে 2024 সালে সেই হার ছিল মাত্র 11%। অর্থাৎ আমেরিকায় এখন "Made in India" ট্যাগযুক্ত মোবাইল ফোনের চাহিদা চোখে পড়ার মতো বেড়েছে। এই সাফল্যের পেছনে মূল চালিকাশক্তি অ্যাপল, যারা তাদের উৎপাদনের বিশাল একটি অংশ ধীরে ধীরে চীন থেকে ভারতে স্থানান্তর করছে।

অ্যাপল সিইও টিম কুক মে ২০২৫-এ জানান, এপ্রিল-জুন সময়কালে আমেরিকায় বিক্রি হওয়া অধিকাংশ আইফোনই ভারতে তৈরি। বর্তমানে অ্যাপলের বৈশ্বিক উৎপাদনের প্রায় ২০% ভারতেই হচ্ছে, যেখানে কয়েক বছর আগেও এই হার ছিল প্রায় শূন্য।

চীনের অংশ কমছে, ভারতের অংশ বাড়ছে

চীনের বাজার দখলের হার ২০২৪-এ যেখানে ছিল ৮২%, ২০২৫-এর প্রথমার্ধে তা নেমে এসেছে ৪৯%-এ। যদিও চীন এখনো প্রধান সরবরাহকারী, তবে ভারতের দ্রুত উত্থান একটি বড় পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত আমেরিকা ভারতে তৈরি ২১.৩ মিলিয়ন স্মার্টফোন আমদানি করেছে, যা গত বছরের তুলনায় তিন গুণ বেশি। এর আর্থিক মূল্য ১৮২% বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ৯.৩৫ বিলিয়ন ডলারে, যেখানে ২০২৪ সালের পুরো বছরে ছিল প্রায় ৭ বিলিয়ন ডলার।

সরকারের ভূমিকা: উৎপাদন সংযুক্ত প্রণোদনা (PLI)

ভারত সরকারের ২০২০ সালে চালু করা উৎপাদন সংযুক্ত প্রণোদনা (PLI) প্রকল্প এই বিপ্লবের অন্যতম ভিত্তি। এই প্রকল্পের অধীনে দেশীয় উৎপাদন বাড়ালে আর্থিক প্রণোদনা দেওয়া হয়। অ্যাপল, ফক্সকন, উইস্ট্রন এবং পেগাট্রনের মতো প্রতিষ্ঠান এতে উৎসাহিত হয়ে ভারতে বিনিয়োগ করছে। সম্প্রতি ফক্সকন তামিলনাড়ুতে প্রায় $১.৪৯ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের ঘোষণা দিয়েছে।

বর্তমানে ভারতের মোবাইল উৎপাদনের মোট মূল্য পৌঁছে গেছে ₹৫.৪৫ লক্ষ কোটি টাকায় (প্রায় $৬৫ বিলিয়ন), এবং মোবাইল রপ্তানি ₹২ লক্ষ কোটি টাকা (প্রায় $২৪ বিলিয়ন)-এ পৌঁছেছে। ভারত এখন বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম মোবাইল রপ্তানিকারক।


ভূ-অর্থনৈতিক গুরুত্ব

১. ভারতের অর্থনৈতিক বৈচিত্র্য ও বৃদ্ধি

  • রপ্তানি এবং বৈদেশিক মুদ্রা বৃদ্ধি: মোবাইল রপ্তানি বৃদ্ধির মাধ্যমে ভারতের রপ্তানি আয় ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ছে, যা অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
  • চাকরি সৃষ্টি: ইলেকট্রনিক্স শিল্পে ১৭ লক্ষেরও বেশি চাকরি তৈরি হয়েছে, যা দেশের যুব সমাজের কর্মসংস্থানের সুযোগ প্রসারিত করছে।
  • স্থানীয় উপাদান উৎপাদন: এখনো বেশিরভাগ প্রক্রিয়া অ্যাসেম্বলি পর্যায়ে সীমাবদ্ধ হলেও, সরকার স্থানীয় উপাদান উৎপাদন বাড়াতে তৎপর। বর্তমানে DVA (Domestic Value Addition) ২৩%-এ পৌঁছেছে।
  • বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ: PLI-এর সাফল্য ও ভারতের নীতি পরিবেশ বহু বৈদেশিক বিনিয়োগ (FDI) আকর্ষণ করছে।
  • "Make in India" বাস্তবায়ন: এই বিপ্লব ভারতের আত্মনির্ভরতা বাড়িয়ে বৈশ্বিক উৎপাদন কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করছে।

২. বৈশ্বিক কোম্পানিগুলোর জন্য সরবরাহ শৃঙ্খলের স্থিতিশীলতা

  • “চায়না প্লাস ওয়ান” কৌশল: কোভিড এবং ভূরাজনৈতিক উত্তেজনার কারণে বহু বহুজাতিক সংস্থা এখন একাধিক দেশে উৎপাদন ছড়িয়ে দিতে চায়। ভারত সেই কৌশলের বড় উপকারভোগী।
  • ঝুঁকি হ্রাস: চীন-নির্ভরতা কমিয়ে উৎপাদন ছড়ালে ভূ-রাজনৈতিক বা প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রভাব কম পড়ে।
  • বৃহৎ অভ্যন্তরীণ বাজার: ভারতের বিশাল ও ক্রমবর্ধমান স্মার্টফোন ব্যবহারকারী শ্রেণি কোম্পানিগুলোর জন্য বাড়তি সুবিধা।

৩. বৈশ্বিক বাণিজ্য ভারসাম্যের পরিবর্তন

  • বাণিজ্য ভারসাম্যে পরিবর্তন: আমেরিকার ভারতের থেকে আমদানি বৃদ্ধি পাওয়ায় চীনের উপর নির্ভরতা হ্রাস পাচ্ছে এবং নতুন বাণিজ্য সম্পর্ক তৈরি হচ্ছে।
  • প্রতিযোগিতা ও দাম হ্রাস: ভারতীয় উৎপাদন বৃদ্ধিতে বাজারে প্রতিযোগিতা বাড়ছে, যার ফলে ভবিষ্যতে দামও কমতে পারে।

ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব

১. ভারত-আমেরিকা সম্পর্কের দৃঢ়তা

  • কৌশলগত অংশীদারিত্ব: প্রযুক্তি উৎপাদনের ক্ষেত্রে সহযোগিতা ভারত-আমেরিকা সম্পর্ককে আরো মজবুত করছে।
  • চীন-বিরোধী কৌশল: আমেরিকার দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী, চীনের উপর নির্ভরতা হ্রাস করে ভারতকে বিকল্প হিসেবে গড়ে তোলা একটি কৌশলগত প্রয়াস।
  • বিশ্বস্ত অংশীদার: ভারত এখন আমেরিকার জন্য একটি "বিশ্বস্ত উৎপাদন অংশীদার" হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।

২. ভারতের বৈশ্বিক অবস্থানের উন্নতি

  • অর্থনৈতিক কূটনীতি: ভারতের উৎপাদন দক্ষতা বৈশ্বিক অর্থনৈতিক আলোচনায় ভারতকে শক্তিশালী কণ্ঠ দেয়।
  • সফট পাওয়ার বৃদ্ধি: প্রযুক্তি ও উৎপাদনে অগ্রগতি ভারতের মর্যাদা বাড়িয়ে দিচ্ছে বিশ্বমঞ্চে।

৩. চ্যালেঞ্জ ও ভবিষ্যতের করণীয়

  • রক্ষাণশীল নীতি: কিছু মার্কিন রাজনীতিক ভারতের রপ্তানির উপর শুল্ক আরোপের কথা বলেছেন, যেমন প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। এর মোকাবিলায় দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তি জরুরি।
  • উপাদান সরবরাহ ব্যবস্থার দুর্বলতা: চীনের তুলনায় ভারতে এখনো বহু গুরুত্বপূর্ণ মোবাইল যন্ত্রাংশ তৈরি হয় না। অ্যাপলের ১৫০০ চীনা সাপ্লায়ার থাকলেও ভারতের ক্ষেত্রে সেই সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম।
  • দক্ষ জনবল ও অবকাঠামো: ভবিষ্যতের চাহিদা মেটাতে অবকাঠামো, স্কিল ট্রেনিং এবং ব্যবসার সহজতা বাড়ানো প্রয়োজন।

উপসংহার

ভারতের স্মার্টফোন উৎপাদনে উত্থান নিছক অর্থনৈতিক ঘটনা নয়—এটি এক বৈশ্বিক সরবরাহ কাঠামোর রূপান্তর। যুক্তরাষ্ট্র, চীন এবং ভারত এই নতুন ভূ-অর্থনৈতিক ত্রিভুজে প্রবেশ করেছে, যেখানে ভারতের সম্ভাবনা আকাশচুম্বী। তবে এই সাফল্য বজায় রাখতে হলে কাঠামোগত সংস্কার, নীতি সহায়তা এবং টেকসই বিনিয়োগ নিশ্চিত করাই হবে মূল চাবিকাঠি। "মেড ইন ইন্ডিয়া" এখন শুধুই একটি স্লোগান নয়, বরং বিশ্বমানের বাস্তবতা।

পড়ুন এবং শেয়ার করুন, যাতে আরো মানুষ জানে ভারতের এই অসাধারণ উত্থানের গল্প!


 FAQs 


প্রশ্ন: কেন অ্যাপল ভারতে আইফোন তৈরি করছে?

উত্তর: PLI স্কিমের প্রণোদনা ও চীন-নির্ভরতা কমানোর জন্য অ্যাপল ভারতকে নতুন উৎপাদন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলছে।


প্রশ্ন: ভারতের কোন রাজ্যে সবচেয়ে বেশি মোবাইল উৎপাদন হয়?

উত্তর: তামিলনাড়ু, কর্ণাটক ও মহারাষ্ট্র এই খাতে অগ্রগামী।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

যদি আপনার কোনও বিষয়ে ডাউট থাকে বা কোনও বিষয় suggest করতে চান তাহলে মেল করুন!

নবীনতর পূর্বতন

banglafacts 4