ভূমিকা
বিশ্বব্যাপী অর্থনীতি যখন ধীরে ধীরে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের দিকে অগ্রসর হচ্ছে, তখন করনীতির ক্ষেত্রেও পরিবর্তন অবধারিত। ভারতের ডিজিটাল কর বা Equalisation Levy (EL) এর মাধ্যমে ভার্চুয়াল জগতে চলমান ব্যবসাগুলিকে করের আওতায় আনার চেষ্টা ছিল একটি সাহসী পদক্ষেপ। তবে এই পদক্ষেপ যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলির সঙ্গে ভারতের বাণিজ্য সম্পর্কেও নানা প্রশ্ন তুলেছে। ২০২৪-২৫ সালে এই কর বাতিল করার সিদ্ধান্ত এবং তার প্রেক্ষিতে মার্কিন প্রতিক্রিয়া একটি বড় আন্তর্জাতিক আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে।

Equalisation Levy: সূচনা ও প্রসার
ভারত প্রথম ডিজিটাল কর হিসেবে Equalisation Levy চালু করে ২০১৬ সালে। এই কর মূলত বিদেশি ডিজিটাল সংস্থাগুলিকে লক্ষ্য করে প্রণয়ন করা হয়, যারা ভারতে শারীরিক উপস্থিতি ছাড়াই বিশাল পরিমাণে আয় করত।
✅ ২০১৬: প্রাথমিক Equalisation Levy
-
৬% কর ধার্য হয় অনলাইন বিজ্ঞাপন পরিষেবার উপর।
-
যারা ভারতীয় সংস্থা বা ব্যক্তি বিদেশি ডিজিটাল সংস্থার কাছ থেকে বিজ্ঞাপন পরিষেবা নিত, তাদের উপর এই করের দায়িত্ব বর্তায়।
-
এই করকে অনেকেই “গুগল ট্যাক্স” নামে ডাকত।
✅ ২০২০: বর্ধিত Equalisation Levy
-
১ এপ্রিল ২০২০ থেকে EL-এর পরিধি বাড়িয়ে ২% করা হয়।
-
লক্ষ্য ছিল সমস্ত বিদেশি ই-কমার্স অপারেটর যারা ভারতীয় গ্রাহকদের উদ্দেশ্যে পণ্য বা পরিষেবা সরবরাহ করে।
-
এর আওতায় পড়ে স্ট্রিমিং, ক্লাউড পরিষেবা, সফটওয়্যার বিক্রি, অনলাইন মার্কেটপ্লেস, এমনকি বিদেশি কোম্পানির ওয়েবসাইটে পণ্যের বিক্রয়ও।
-
বার্ষিক আয় ২০ মিলিয়ন রুপি (প্রায় ২.৪ লাখ ডলার) পার করলেই কর দিতে হত।
✅ করের যুক্তি
-
সমতার নীতি: যেসব দেশীয় কোম্পানি ভারতে কাজ করে তাদের আয় কর দিতে হয়। কিন্তু বিদেশি ডিজিটাল কোম্পানিগুলি শারীরিক উপস্থিতি ছাড়াই বিশাল আয় করে, অথচ আয়কর দেয় না।
-
আন্তর্জাতিক সহযোগিতার অপেক্ষা: ডিজিটাল অর্থনীতিতে করের বিষয়টি নিয়ে যখন ওইসিডি (OECD) বৈশ্বিক সমাধানের দিকে এগোচ্ছে, তখন ভারতের EL ছিল একটি অন্তর্বর্তীকালীন পদক্ষেপ।
যুক্তরাষ্ট্রের আপত্তি ও Section 301 তদন্ত
এই কর যুক্তরাষ্ট্রের বহু নামী সংস্থার আয়কে প্রভাবিত করে — যেমন গুগল, অ্যামাজন, মেটা, নেটফ্লিক্স, অ্যাপল ইত্যাদি। ফলে যুক্তরাষ্ট্র তাৎক্ষণিকভাবে তীব্র আপত্তি তোলে।
-
মার্কিন বাণিজ্য প্রতিনিধি (USTR) Section 301 তদন্ত শুরু করে।
-
তাদের মতে, এই কর:
-
কেবলমাত্র মার্কিন সংস্থাকেই লক্ষ্য করে
-
রাজস্বের উপর কর ধার্য করে, আয়ের উপর নয় (যা আন্তর্জাতিকভাবে অনুচিত)
-
অতিরিক্ত প্রশাসনিক বোঝা তৈরি করে
-
-
যুক্তরাষ্ট্র হুঁশিয়ারি দেয়, ভারতীয় পণ্যের উপর প্রতিশোধমূলক শুল্ক আরোপ করা হতে পারে।
২% EL বাতিল ও ভারতের নতুন পদক্ষেপ (২০২৪-২৫)
২০২৪ সালের বাজেটে ভারত ঘোষণা করে যে ১ আগস্ট ২০২৪ থেকে ২% Equalisation Levy বাতিল করা হবে। তবে ২০১৬ সালের ৬% কর (বিজ্ঞাপন পরিষেবার ক্ষেত্রে) এখনও বহাল রয়েছে।
এই সিদ্ধান্তের পেছনের কারণ:
-
ওইসিডি ও G20-এর যৌথ উদ্যোগে গৃহীত “দুই স্তরের (Two-Pillar)” ডিজিটাল ট্যাক্স ফ্রেমওয়ার্ক অনুসরণ করতে ভারতের আগ্রহ।
-
বৈশ্বিক পরিসরে সমন্বিত কর কাঠামো তৈরি হলে, এককভাবে EL আরোপ করা অপ্রয়োজনীয় হয়ে যায়।
-
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক উন্নয়ন ও মার্কিন বাণিজ্য চাপ সামাল দেওয়ার কৌশল হিসেবেও এই সিদ্ধান্ত গুরুত্বপূর্ণ।
মার্কিন চাপ: ভবিষ্যতে কর আরোপের নিষেধাজ্ঞা?
EL বাতিলের পর যুক্তরাষ্ট্র চায় ভারত তার বাণিজ্য চুক্তিতে একটি ধারা যুক্ত করুক, যাতে ভবিষ্যতে আর কোনো ধরনের ডিজিটাল কর আরোপ না করা যায়।
ভারত সরকারের প্রতিক্রিয়া:
-
ভারতের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছে।
-
তাদের মতে, এই ধরনের একতরফা শর্ত ভবিষ্যতের জন্য “বিপজ্জনক দৃষ্টান্ত” তৈরি করতে পারে।
-
ভারতও মার্কিন বাজারে বিপুল ডিজিটাল পরিষেবা রপ্তানি করে, তাই ভারসাম্য বজায় রাখাই সঠিক কৌশল।
ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক: কূটনৈতিক গভীরতা বনাম বাণিজ্যিক টানাপোড়েন
🌐 শক্তিশালী অংশীদারিত্বের ক্ষেত্র:
-
গ্লোবাল স্ট্র্যাটেজিক পার্টনারশিপ: দুই দেশই গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও নিরাপত্তা লক্ষ্যে একত্রিত।
-
প্রতিরক্ষা ও প্রযুক্তি:
-
U.S.-India COMPACT ও INDUS-X প্রকল্পের মাধ্যমে যৌথ প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি ও শিল্প সহযোগিতা।
-
ভারত এখন যুক্তরাষ্ট্র, ইজরায়েল ও ফ্রান্স থেকে বেশি প্রতিরক্ষা উপকরণ আমদানি করছে।
-
-
স্ট্র্যাটেজিক টেকনোলজি:
-
U.S.-India TRUST প্রকল্পের মাধ্যমে AI, স্পেস, এনার্জি ও গবেষণায় যৌথ বিনিয়োগ।
-
-
মানবসম্পর্ক ও ডায়াস্পোরা:
-
আমেরিকায় বৃহৎ ভারতীয় প্রবাসী ও ছাত্র-সম্প্রদায়।
-
-
QUAD ও ইনডো-প্যাসিফিক:
-
উভয় দেশই চীনা প্রভাব মোকাবেলায় কৌশলগত মিত্রতা জোরদার করছে।
-
🚧 বাণিজ্য ক্ষেত্রে প্রধান সমস্যা:
-
চুক্তি জট:
-
বহু আলোচনা সত্ত্বেও দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তি সম্পন্ন হয়নি।
-
যুক্তরাষ্ট্র চায় কৃষিপণ্য, দুগ্ধজাত দ্রব্যের জন্য ভারতের বাজার উন্মুক্ত হোক।
-
ভারত এর বিরোধিতা করে কৃষকের স্বার্থ ও সাংস্কৃতিক বাধার কারণে।
-
-
শুল্ক ও ট্যারিফ:
-
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভারতের উচ্চ আমদানি শুল্ক নিয়ে আপত্তি তোলে।
-
ভারত আবার চায় মার্কিন স্টিল ও অটো পার্টসের উপর শুল্ক ছাড়।
-
বাইডেন প্রশাসন বা ট্রাম্প প্রশাসন, উভয়েই এখন ১০-১৫% ট্যারিফকে ‘নিউ নর্মাল’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে।
-
-
ডিজিটাল বাজার ও ডেটা:
-
মার্কিন কোম্পানিরা ভারতের ডেটা লোকালাইজেশন আইনকে বাধা মনে করে।
-
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চায় তাদের প্রযুক্তি কোম্পানির জন্য ভারতীয় বাজার আরও সহজলভ্য হোক।
-
-
একতরফা চাপ ও রাজনীতিকরণ:
-
অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্র তার স্ট্র্যাটেজিক সম্পর্ক থাকলেও বাণিজ্যের ক্ষেত্রে প্রায়শ unilateral (একতরফা) শর্ত চাপিয়ে দেয়।
-
ভারত এতে “blackmailing” বা চাপ প্রয়োগের প্রবণতা দেখতে পায়।
-
উপসংহার
ভারতের Equalisation Levy বাতিল একদিকে যেমন আন্তর্জাতিক করনীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য বজায় রাখার ইঙ্গিত দেয়, অন্যদিকে মার্কিন বাণিজ্যিক চাপ মোকাবেলায় ভারতের আত্মবিশ্বাসও প্রতিফলিত করে। যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের কৌশলগত সম্পর্ক শক্তিশালী হলেও বাণিজ্য ক্ষেত্রে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব এখনো স্পষ্ট। কৃষি, ডিজিটাল বাজার, শুল্ক কাঠামো — এসব বিষয়ে মতানৈক্য থাকলেও ভবিষ্যতে যদি উভয় পক্ষ বাস্তবভিত্তিক সমাধান খুঁজে পায়, তবে একটি শক্তিশালী ও ভারসাম্যপূর্ণ বাণিজ্য চুক্তি ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে নতুন মাত্রা যোগ করতে পারে।
🔍 আপনার মতামত কী? আপনি কি মনে করেন ডিজিটাল কর পুরোপুরি তুলে নেওয়া উচিত ছিল? মন্তব্যে জানান!
📌 শেয়ার করে নিন এই গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আপনার বন্ধুদের সঙ্গেও।