নতুন এশিয়া: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে এশিয়ার বিপ্লব ও স্বাধীনতার পথচলা


“The Birth of Modern Asia”

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ যখন এশিয়ায় শেষ হয়, তখন জাপান কার্যত পরাজিত অবস্থায় এবং গোটা মহাদেশটি এক গভীর রাজনৈতিক ও সামাজিক বিপ্লবের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে ছিল। চিন, কোরিয়া এবং ভিয়েতনামে যুদ্ধকালীন সময়ে কমিউনিস্ট দলগুলোর শক্তি ব্যাপকভাবে বেড়ে যায় এবং তারা ক্ষমতার জন্য লড়াই করার মতো অবস্থানে পৌঁছে যায়। অন্যদিকে ইন্দোনেশিয়া ও ভারতে চরমপন্থী জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠীগুলো ব্রিটিশ ও ডাচ উপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে পূর্ণ স্বাধীনতার দাবিতে সরব হয়ে ওঠে। এশিয়ায় যেন এক ‘পারফেক্ট স্টর্ম’-এর সৃষ্টি হয়েছিল: একদিকে জাপানের সাম্রাজ্যবাদী শক্তির পতন, অন্যদিকে ইউরোপীয় উপনিবেশিক ব্যবস্থা দ্রুত ভেঙে পড়ছিল।

কমপক্ষে একশো বছরের মধ্যে এই প্রথমবারের মতো এশীয়রা নিজেদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণের সুযোগ পেল, যদিও সেই স্বপ্ন ও পরিকল্পনাগুলোর ভিত্তি ইউরোপীয় জাতীয়তাবাদ ও গণতন্ত্রের ধারণার ওপর নির্মিত হলেও, তা স্থানীয় সংস্কৃতির আলোকে এক ভিন্ন রূপ ধারণ করে।

এশীয় বিপ্লবের তিনটি মুখ

যুদ্ধ-পরবর্তী এশীয় বিপ্লবের প্রবাহকে তিনটি প্রধান ধারা হিসেবে চিহ্নিত করা যায়।

  1. উপনিবেশিক শক্তির প্রতিরোধ:
    ইউরোপীয় উপনিবেশবাদী শক্তিগুলো এবং তাদের স্থানীয় সহযোগীরা নিজেদের প্রভাব রক্ষার জন্য লড়াই চালিয়ে যায়। তবে তারা কৌশল পরিবর্তন করে ক্ষমতা হস্তান্তরের মাধ্যমে এমন একটি শ্রেণি প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল, যারা তাদের সঙ্গে আলোচনা করে সমঝোতায় আসতে পারে। কিন্তু সেই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। যুদ্ধকালীন সময়েই চিনে সব বিদেশি বিশেষাধিকার বাতিল করা হয় (হংকং ও ম্যাকাও বাদে), এবং ভারতে ব্রিটিশ সরকার জাপানের আক্রমণের সম্ভাবনা মাথায় রেখে স্বাধীনতার প্রতিশ্রুতি দেয়।

  2. সুপারপাওয়ারের ভুমিকা:
    দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর উদিত দুটি পরাশক্তি—যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন—উপনিবেশবাদের বিরোধিতা করে (যদিও নিজের ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম করে)। তারা ইউরোপীয় শক্তিগুলোর দ্রুত ও পূর্ণ প্রত্যাহারের পক্ষে অবস্থান নেয়।

  3. অর্থনৈতিক বাস্তবতা:
    ইউরোপীয় দেশগুলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসস্তূপ থেকে পুনর্গঠনে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। জনগণ চেয়েছিল ঘরোয়া পুনর্গঠন, বিদেশে উপনিবেশ রক্ষায় অর্থ ব্যয় নয়। এই বাস্তবতা ইউরোপের উপনিবেশবাদকে ‘গর্ব’ থেকে রূপান্তরিত করে এক সমস্যায়। এক দশকের মধ্যেই উপনিবেশবাদ ইউরোপীয়দের জন্য গর্বের পরিবর্তে এক নৈতিক ও রাজনৈতিক বোঝায় পরিণত হয়।

জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের উত্থান

এশিয়ার সর্বত্র জাতীয়তাবাদী আন্দোলনগুলো শক্তি সঞ্চয় করতে থাকে। বেশিরভাগ নেতাই অতীত গৌরবের উপর ভিত্তি করে জাতীয় চেতনার ধারণা গড়ে তুলেছিলেন, যার সঙ্গে আধুনিকায়ন ও রাষ্ট্র-পরিকল্পনার মতবাদ যুক্ত হয়।

চিন ও ভারতে—দুই বৃহৎ রাষ্ট্রেই—জাতীয়তাবাদী সংগঠনগুলো (চিনের গুয়োমিনডাং বা ন্যাশনাল পিপলস পার্টি এবং ভারতের ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস) ছিল বৃহৎ, বহুমুখী মতাদর্শে পরিপূর্ণ সংগঠন, যাদের নেতৃত্বে ছিলেন অত্যন্ত জনপ্রিয়, ক্যারিশম্যাটিক নেতা। তারা রাষ্ট্র-ভিত্তিক পরিকল্পনা এবং শক্তিশালী নির্বাহী শাসনব্যবস্থার পক্ষে অবস্থান নেয়। তবে উভয় দেশের মধ্যেই কমিউনিস্ট পার্টিগুলোর শক্তিশালী উপস্থিতি ছিল, যাদের সঙ্গে প্রতিনিয়ত রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব চলছিল।

ইন্দোনেশিয়ার ভিন্নধর্মী ধারণা

ইন্দোনেশিয়ার পরিস্থিতি ছিল অন্যরকম। ১৭ হাজার দ্বীপ নিয়ে গঠিত এই রাষ্ট্রটির সংস্কৃতি ও ইতিহাস ছিল ভিন্নধর্মী ও বিচিত্র। ডাচ উপনিবেশের ভিত্তিতে গঠিত একটি কেন্দ্রিক রাষ্ট্র ধারণা করা হয়, যেখানে "জাতি" মানে ছিল সব স্থানীয় মানুষের জন্য একটি অভিন্ন মাতৃভূমি। সেই সময়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় একটি প্রবল বিশ্বাস গড়ে ওঠে—স্থানীয় জনগণ এবং মুসলিম পরিচয় এক ও অভিন্ন। ফলে ইন্দোনেশিয়ার জাতীয়তাবাদীরা এককেন্দ্রিক ও একীকৃত মুসলিম রাষ্ট্রের ধারণাকে সামনে নিয়ে আসে।

উপসংহার

একদিকে যখন শীতল যুদ্ধ শুরু হচ্ছে, তখন অন্যদিকে এশিয়ার জাতীয়তাবাদীরা নিজেদের নতুন রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার জন্য অগ্রসর হচ্ছিল। ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদের পতনের মধ্য দিয়ে এশিয়ার ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায় সূচিত হয়—নতুন এশিয়ার জন্ম, যার ভিত্তি ছিল স্বাধীনতা, আধুনিকতা ও রাষ্ট্র গঠনের অঙ্গীকার।



Suggested Tags:
#দ্বিতীয়_বিশ্বযুদ্ধ #নতুন_এশিয়া #এশিয়ার_ইতিহাস #উপনিবেশবাদ #জাতীয়তাবাদ #চিন #ভারত #ইন্দোনেশিয়া #স্বাধীনতা


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

যদি আপনার কোনও বিষয়ে ডাউট থাকে বা কোনও বিষয় suggest করতে চান তাহলে মেল করুন!

নবীনতর পূর্বতন

banglafacts 4