পাকিস্তান-বাংলাদেশ ভিসা-মুক্ত চুক্তি: দক্ষিণ এশীয় কূটনৈতিক মানচিত্রে এক নতুন পালা

২৩ জুলাই ২০২৫: এই তারিখটি পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ মোড়ের সূচক হয়ে উঠেছে। এই দিনে ইসলামাবাদে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়—দুই দেশের কূটনৈতিক এবং সরকারি কর্মচারী পাসপোর্টধারীদের জন্য ভিসা-মুক্ত ভ্রমণের অনুমোদন।
এই সিদ্ধান্ত শুধুমাত্র একটি ভ্রমণ চুক্তি নয়, বরং দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনৈতিক সমীকরণে এক উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনের ইঙ্গিত বহন করে। দীর্ঘদিন ধরে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষিতে পাকিস্তান ও বাংলাদেশের সম্পর্ক তিক্ত এবং অনাস্থাপূর্ণ ছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সেই সম্পর্ক ধীরে ধীরে উষ্ণতার দিকে এগিয়ে চলেছে, বিশেষ করে বাংলাদেশে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ক্ষমতায় আসার পর থেকে।
এই প্রবন্ধে আমরা আলোচনা করব—
- চুক্তির মূল বিষয়বস্তু ও গুরুত্ব
- ভারত, চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়া ও সম্ভাব্য প্রভাব
- ভবিষ্যতের কূটনৈতিক সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ
চুক্তির বিস্তারিত ও তাৎপর্য
পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত ভিসা-মুক্ত চুক্তির আওতায় শুধুমাত্র সরকারি ও কূটনৈতিক পাসপোর্টধারীরা উভয় দেশে যাতায়াত করতে পারবেন কোনও ভিসা ছাড়াই। যদিও এটি সাধারণ জনগণের জন্য নয়, তবুও কূটনীতিক ও সরকারি পর্যায়ে যোগাযোগ সহজতর হওয়া দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের নতুন অধ্যায়ের সূচনা বলে ধরা হচ্ছে।
আলোচ্য বিষয়ে সহমত:
এই বৈঠকে শুধু ভিসা-মুক্ত ভ্রমণের বিষয়েই নয়, আরও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ নিরাপত্তা ও সহযোগিতার খাতে আলোচনা হয়েছে—
- অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা সংক্রান্ত সহযোগিতা
- পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনীর প্রশিক্ষণ
- মাদকবিরোধী অভিযান
- মানব পাচার রোধ
- সন্ত্রাসবিরোধী উদ্যোগ
এই বিষয়গুলিতে একযোগে কাজ করার অঙ্গীকার দু’দেশের মধ্যে পারস্পরিক আস্থা বৃদ্ধিতে সাহায্য করবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।
ভারতের প্রতিক্রিয়া ও সম্ভাব্য নিরাপত্তা উদ্বেগ
ভারতীয় দৃষ্টিকোণ থেকে উদ্বেগ:
ভারত এই চুক্তির প্রতি গভীর নজর রাখছে এবং এর নিরাপত্তাজনিত প্রভাব নিয়ে উদ্বিগ্ন। বিশেষ করে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা ISI (Inter-Services Intelligence)-এর ভূমিকা নিয়ে দিল্লি সতর্ক। ভারতের আশঙ্কা—এই সহজ যাতায়াতের সুযোগে ISI বাংলাদেশে প্রভাব বিস্তারের সুযোগ পেতে পারে, যা উত্তর-পূর্ব ভারতের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে হুমকি হয়ে উঠতে পারে।
উত্তর-পূর্ব ভারতের নিরাপত্তা পরিস্থিতি বরাবরই সংবেদনশীল। অতীতে এই অঞ্চলে বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে পাকিস্তানি সংযোগের অভিযোগ উঠেছিল। এই প্রেক্ষাপটে পাকিস্তান ও বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠতা ভারতীয় গোয়েন্দা মহলে উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে।
কৌশলগত সমীকরণে পরিবর্তন:
ভারত বরাবরই বাংলাদেশকে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত অংশীদার হিসেবে বিবেচনা করে এসেছে। দিল্লির কাছে ঢাকা কেবলমাত্র বাণিজ্যিক বা সাংস্কৃতিক দিক থেকেই গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং তা পূর্ব ভারতের নিরাপত্তা ও আঞ্চলিক ভারসাম্যের দিক থেকেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
এখন, যদি পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যে রাজনৈতিক এবং নিরাপত্তা সহযোগিতা বেড়ে যায়, তাহলে ভারতের প্রভাব কিছুটা হ্রাস পেতে পারে। বিশেষ করে চীন যখন একইসাথে বাংলাদেশে তার প্রভাব বৃদ্ধির চেষ্টা করছে, তখন পাকিস্তানের সক্রিয় অংশগ্রহণ দক্ষিণ এশিয়ার কৌশলগত মানচিত্রে জটিলতা তৈরি করতে পারে। পাকিস্তান আবার চিন থেকে লোন পেলে, চীনের ডানহাত হিসাবেও বাংলাদেশে কাজ করতে পারে। সম্প্রতি পাকিস্তানের সর্বেসর্বা ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনির চিন সফরে গেছিলেন।
চীনের কৌশলগত সুবিধা
আঞ্চলিক সংযোগের প্রসার:
চীন দক্ষিণ এশিয়ায় তার প্রভাব বাড়ানোর জন্য বহুদিন ধরেই কৌশলগতভাবে কাজ করে চলেছে। বাংলাদেশের সঙ্গে তাদের অর্থনৈতিক ও প্রতিরক্ষা সম্পর্ক ইতোমধ্যেই অনেক গভীর হয়েছে। পাকিস্তানের সঙ্গে তো চীনের সম্পর্ক ঐতিহাসিকভাবেই ‘অল-ওয়েদার ফ্রেন্ডশিপ’ হিসেবে পরিচিত।
পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যে এই চুক্তি চীনের জন্য লাভজনক কারণ এতে তার দুই প্রধান দক্ষিণ এশীয় সহযোগীর মধ্যে সংযোগ আরও মজবুত হবে। একে চীন তার 'বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ' (BRI)-এর পরিপূরক হিসেবে ব্যবহার করতে পারে।
ভারতের প্রভাব হ্রাসে সহায়তা:
এই ধরনের কৌশলগত বন্ধুত্ব ভারতকে দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র নেতৃত্ব থেকে সরিয়ে দিতে সাহায্য করতে পারে, যা চীনের দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্য। চীন ইতোমধ্যেই বাংলাদেশে নানা অবকাঠামোগত বিনিয়োগ করেছে—যেমন কর্ণফুলী টানেল, পায়রা বন্দর ইত্যাদি।
পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যেকার সম্পর্কের উন্নতি, বিশেষ করে যদি তা চীনা বিনিয়োগ ও বাণিজ্যিক চুক্তির মাধ্যমে আরও প্রসারিত হয়, তাহলে তা ভারতের আঞ্চলিক নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারে।
কিছুদিন আগে চীনে গিয়ে বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা মো ইউনুস নিজেকে বঙ্গোপসাগরের গার্ডিয়ান বলে এসেছেন, তিনি হয়তো আন্দামান দ্বীপ এবং আরো বিভিন্ন ভারতের নৌসেনা বন্দরগুলোর কথা ভুলে গেছিলেন।
অর্থনৈতিক সম্ভাবনা:
যদিও বর্তমান চুক্তিটি শুধু সরকারি পাসপোর্টধারীদের জন্য, তবুও এটি দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের এক ইতিবাচক গতি নির্দেশ করে। ভবিষ্যতে যদি বাণিজ্যিক সম্পর্ক বা সাধারণ যাত্রীর জন্যও সুবিধা প্রসারিত হয়, তাহলে চীনের বিনিয়োগকারীদের জন্য নতুন বাজার ও পথ খুলে যেতে পারে। এতে কিন্তু বেসিক্যালি লাভ সব দিক দিয়ে চীনের ই হবে, কারণ পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ কারোর ইকোনমি ঠিকঠাক নাই।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পর্যবেক্ষণ ও অবস্থান
প্রত্যক্ষ প্রভাব সীমিত হলেও নজরদারিতে:
যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এই চুক্তির তেমন সরাসরি প্রভাব নেই। কারণ, এটি মূলত আঞ্চলিক স্তরের একটি কূটনৈতিক উদ্যোগ। তবুও, দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিটি কৌশলগত পরিবর্তন আমেরিকার নজরে থাকে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান লক্ষ্য হলো—
- আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা
- সন্ত্রাসবিরোধী উদ্যোগে সহায়তা
- গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ রক্ষা
এই চুক্তির মাধ্যমে যদি পাকিস্তান ও বাংলাদেশ মিলে সন্ত্রাসবাদ বা চোরাচালান রোধে বাস্তবিক পদক্ষেপ গ্রহণ করে, তাহলে তা মার্কিন নীতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ থেকে চেয়েছিল একটা এয়ার-ফিল্ড বা নৌ বন্দর, বর্তমানে চিন এবং ভবিষ্যতে ভারতকে কাউন্টার করার জন্য। এক্স পিএম হাসিনা ইউএসএ র এই দাবি মেনে নেন নি, তাই হঠাৎ করে বাংলাদেশে একটা কালার revolution ঘটে গেলো। Pakistan কিন্তু আবার যুক্তরাষ্ট্রের পুরোনো সৈনিক, আসলে পাকিস্তান যার থেকে টাকা পাবে তার ই সৈনিক। এরপর কি হতে পারে সেটা সময় বলবে।
ভারতের উদ্বেগকে গুরুত্ব দেওয়া:
যদি ভারত যুক্তরাষ্ট্রকে বোঝাতে সক্ষম হয় যে এই চুক্তি ISI-এর অপব্যবহারের সুযোগ করে দিচ্ছে এবং এর ফলে উত্তর-পূর্ব ভারতে অশান্তি তৈরি হচ্ছে, তাহলে বিষয়টি ওয়াশিংটনের আলোচনায় আসতে পারে। কারণ চীনের সাথে যুদ্ধের সময়, ইউএসএ র কিন্তু ভারতের সাহায্য লাগবেই লাগবে। তবে এই পর্যায়ে কোনো তাৎক্ষণিক মার্কিন নীতিগত পরিবর্তনের সম্ভাবনা নেই।
ভবিষ্যতের কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা
চুক্তি আরও প্রসারিত হবে?
এই মুহূর্তে ভিসা-মুক্ত যাতায়াত শুধুমাত্র সরকারি পর্যায়ে সীমিত। কিন্তু আগামী দিনে যদি রাজনৈতিক সদিচ্ছা অব্যাহত থাকে, তাহলে এই চুক্তি বাণিজ্যিক কিংবা সাংস্কৃতিক সম্পর্কের প্রসার ঘটাতে পারে। ভবিষ্যতে শিক্ষার্থী, ব্যবসায়ী কিংবা সাধারণ পর্যটকদের জন্যও কিছু সুযোগ তৈরি হতে পারে। তবে বাংলাদেশে "ডেমোক্রেটিক ইলেকটেড" সরকার এলে, এই চুক্তি টিকবে না। কারণ বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো ভারতের সাথে খারাপ সম্পর্ক চায় নি(একটা পর্যায়ের পর)।
ভারত কিভাবে প্রতিক্রিয়া জানাবে?
ভারতের পক্ষে এখন প্রধান কৌশল হবে—
- বাংলাদেশ সরকারের সাথে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক আরও মজবুত করা
- বাংলাদেশে চীনা ও পাকিস্তানি প্রভাব প্রতিহত করতে কৌশলগত বিনিয়োগ ও সহযোগিতা বৃদ্ধি
- উত্তর-পূর্ব ভারতের নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে আরও কঠোর ও প্রযুক্তিনির্ভর করা
চীন-পাকিস্তান-বাংলাদেশ অক্ষ?
বিশেষজ্ঞদের একাংশ মনে করছেন, ভবিষ্যতে চীন, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের মধ্যে একটি আঞ্চলিক অক্ষ তৈরি হতে পারে, যা ভারতের জন্য কৌশলগতভাবে অস্বস্তিকর পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে। এটি বাস্তবায়িত হলে দক্ষিণ এশিয়ার কূটনৈতিক মানচিত্র নতুনভাবে লিখতে হতে পারে।
উপসংহার
পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যে ২৩ জুলাই ২০২৫ তারিখে স্বাক্ষরিত ভিসা-মুক্ত ভ্রমণ চুক্তি প্রথম দৃষ্টিতে সীমিত আকারে কার্যকর হলেও এর কূটনৈতিক ও ভূরাজনৈতিক তাৎপর্য সুদূরপ্রসারী। এটি দক্ষিণ এশিয়ায় এক নতুন কৌশলগত বাস্তবতার সূচনা করছে।
ভারতের জন্য এটি একটি সতর্ক সংকেত, চীনের জন্য একটি কৌশলগত সুযোগ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একটি পর্যবেক্ষণযোগ্য কূটনৈতিক পরিবর্তন। ভবিষ্যতে এই সম্পর্ক কোথায় গিয়ে পৌঁছাবে, তা নির্ভর করছে এই তিন দেশের নীতিনির্ধারকদের পরবর্তী সিদ্ধান্তের উপর।
পাঠকদের মতামত: আপনার কি মনে হয় এই ভিসা-মুক্ত চুক্তি দক্ষিণ এশিয়ায় শান্তি ও সহযোগিতার সূচনা করবে, নাকি এটি নতুন উত্তেজনার জন্ম দেবে? মন্তব্যে জানান।