শাহ মোহাম্মদ রেজা পাহলভির সময়ে ইরান-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক: মিত্র থেকে বৈরিতা পর্যন্ত এক ইতিহাস

 

শাহ মোহাম্মদ রেজা পাহলভি এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টদের সঙ্গে সাক্ষাৎ


ইরান এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্কের ইতিহাসে শাহ মোহাম্মদ রেজা পাহলভির যুগ (১৯৪১-১৯৭৯) এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এই সময়ে ইরান মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ ও নির্ভরযোগ্য মিত্রে পরিণত হয়েছিল। তবে ১৯৭৯ সালের ইসলামি বিপ্লব এই সম্পর্কের নাটকীয় পরিবর্তন ঘটায়, যা আজও দুই দেশের মধ্যে গভীর অবিশ্বাস ও বৈরিতার রূপে বিরাজমান।

১৯৫৩ সালের অভ্যুত্থান এবং মিত্রতার শুরু

১৯৫১ সালে ইরানের প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ মোসাদ্দেক দেশের তেল শিল্পকে জাতীয়করণ করেন। এর ফলে পশ্চিমা শক্তির বিশেষ করে যুক্তরাজ্য এবং যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ১৯৫৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সিআইএর সহায়তায় পরিচালিত এক অভ্যুত্থানে মোসাদ্দেককে ক্ষমতাচ্যুত করে শাহ মোহাম্মদ রেজা পাহলভিকে পুনরায় ক্ষমতায় বসানো হয়। এই অভ্যুত্থান যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ইরানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে গভীর প্রভাব বিস্তার এবং এক শক্তিশালী মিত্র তৈরি করার পথ সুগম করে।

এই ঘটনার পর ইরান-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের ভিত্তি গড়ে ওঠে এক অটল মিত্রতার ওপর, যা মূলত তেল সম্পদ, সোভিয়েত ইউনিয়নের সম্প্রসারণ রোধ এবং মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব বিস্তারের প্রয়োজনীয়তা দ্বারা চালিত হয়।

ঠান্ডা যুদ্ধ এবং আঞ্চলিক পুলিশমান

শাহ পাহলভি ছিলেন তীব্রভাবে কমিউনিজমবিরোধী। সেই সময় যুক্তরাষ্ট্র ইরানকে মধ্যপ্রাচ্যে সোভিয়েত সম্প্রসারণ রোধের মূল শক্তি হিসেবে বিবেচনা করে। ১৯৬৯ সালে প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের নিক্সন ডকট্রিন অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্র আঞ্চলিক মিত্রদের মাধ্যমে স্থিতিশীলতা রক্ষার নীতি গ্রহণ করে। এর ফলে ইরানকে “আঞ্চলিক পুলিশ” হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়, এবং শাহ বিপুল অঙ্কের তেল আয়ের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র থেকে অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র ক্রয় শুরু করেন।

ইরান-যুক্তরাষ্ট্রের এই সহযোগিতার ফলে যুক্তরাষ্ট্র প্রয়োজন ছাড়াই সরাসরি সেনা মোতায়েন না করেই মধ্যপ্রাচ্যে প্রভাব বিস্তার করতে সমর্থ হয়।

অর্থনৈতিক ও সামরিক সম্পর্ক

শাহের শাসনে ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে ব্যাপক সামরিক এবং অর্থনৈতিক সহযোগিতা শুরু হয়। যুক্তরাষ্ট্র ইরানকে বিশাল সামরিক সহায়তা, প্রশিক্ষণ ও আধুনিক অস্ত্র সরবরাহ করে। এ সময় মার্কিন কোম্পানিগুলো ইরানের তেল উৎপাদনের বড় অংশ নিয়ন্ত্রণ করত। এছাড়া বাণিজ্য ও সাংস্কৃতিক সম্পর্কও বৃদ্ধি পায়।

একই সঙ্গে “অ্যাটমস ফর পিস” কর্মসূচির আওতায় যুক্তরাষ্ট্র ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি শুরু করতে সহায়তা করে, যা প্রথম দিকে শান্তিপূর্ণ লক্ষ্যেই পরিচালিত হয়েছিল।

হোয়াইট রেভলিউশন এবং যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন

শাহ ১৯৬৩ সালে “হোয়াইট রেভলিউশন” নামে পরিচিত এক সিরিজ সংস্কার কর্মসূচি শুরু করেন। এর উদ্দেশ্য ছিল ইরানকে আধুনিক ও ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে পরিণত করা। ভূমি সংস্কার, মহিলাদের অধিকার বৃদ্ধি, শিক্ষার প্রসার সহ একাধিক সংস্কার কার্যক্রমের মাধ্যমে শাহ ইরানকে দ্রুত আধুনিকীকরণের চেষ্টা করেন। যুক্তরাষ্ট্র এই রূপান্তরকে সমর্থন করে, কারণ এটি সোভিয়েত প্রভাব রোধে ইরানকে আরও স্থিতিশীল রাখবে বলে তারা বিশ্বাস করত।

ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিগত সম্পর্ক

শাহের সঙ্গে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি, লিন্ডন জনসন এবং রিচার্ড নিক্সনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। মার্কিন প্রশাসন শাহকে একজন নির্ভরযোগ্য নেতা হিসেবে দেখত, যিনি সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ রক্ষায় সক্ষম।

শাহের শাসনে ক্রমবর্ধমান অস্থিরতা

তবে বাইরে থেকে উন্নত ও স্থিতিশীল মনে হলেও ইরানের ভেতরে শাহের একনায়কতান্ত্রিক শাসন, অত্যধিক পশ্চিমমুখিতা এবং দ্রুত উন্নয়নের ফলে তৈরি আর্থ-সামাজিক বৈষম্য সাধারণ মানুষের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি করতে শুরু করে। গোপন পুলিশ বাহিনী সাভাক (SAVAK), যা সিআইএর সহায়তায় গঠিত হয়েছিল, সরকারের বিরোধীদের দমন করতে নির্দয় নির্যাতনের আশ্রয় নিত। এর ফলে ইরানি জনগণের এক বড় অংশ শাহের শাসনের প্রতি ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে।

খোমেইনির উত্থান

এই পরিস্থিতির মধ্যে শাহ বিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন শিয়াদের প্রভাবশালী ধর্মীয় নেতা আয়াতোল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেইনি। শাহের ধর্মনিরপেক্ষ নীতিকে ইসলামবিরোধী হিসেবে তুলে ধরে তিনি ইরানিদের মধ্যে বিপুল সমর্থন আদায় করেন। ১৯৬৪ সালে শাহ খোমেইনিকে নির্বাসনে পাঠালেও তার বার্তা গোপনে ছড়িয়ে পড়তে থাকে এবং ইরানিদের মধ্যে বিক্ষোভ বাড়তে থাকে।

ইসলামি বিপ্লব (১৯৭৯)

১৯৭৮-৭৯ সালে ব্যাপক গণ-আন্দোলন, ধর্মঘট, এবং রাস্তায় গণ-প্রতিবাদে ইরান অচল হয়ে পড়ে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে শাহ ১৬ জানুয়ারি ১৯৭৯ সালে দেশত্যাগ করেন। ১ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৯ সালে আয়াতোল্লাহ খোমেইনি স্বদেশে ফিরে আসেন এবং ইসলামি প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন। ইসলামী শাসন ব্যবস্থা গড়ে উঠে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে স্পষ্ট অবস্থান নিয়ে।

যুক্তরাষ্ট্র-ইরান বৈরিতার শুরু

শাহকে চিকিৎসার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রয় দেওয়ায় ক্ষুব্ধ ইরানিদের একদল ছাত্র ৪ নভেম্বর ১৯৭৯ সালে তেহরানে মার্কিন দূতাবাস দখল করে ৫২ জন মার্কিন কূটনীতিক ও কর্মীকে জিম্মি করে। এই জিম্মি সংকট ৪৪৪ দিন স্থায়ী হয়, যা দুই দেশের সম্পর্কের স্থায়ী বৈরিতার ভিত্তি তৈরি করে।

কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন

১৯৮০ সালের এপ্রিল মাসে যুক্তরাষ্ট্র ইরানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে। এরপর থেকে দুই দেশের মধ্যে কোনো আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক সম্পর্ক আর পুনঃস্থাপিত হয়নি।

অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা

ইরানে ইসলামি প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্ন সময়ে একের পর এক অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে থাকে, যা ইরানের অর্থনীতি ও জনগণের ওপর গভীর প্রভাব ফেলে। এই নিষেধাজ্ঞা দুই দেশের সম্পর্কের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়।

ইসলামী প্রজাতন্ত্রের নীতি

ইরানের নতুন সরকার যুক্তরাষ্ট্রকে “মহাশয়তান” (Great Satan) হিসেবে ঘোষণা করে এবং পশ্চিমা শক্তির বিরুদ্ধে জেহাদের আহ্বান জানায়। ইরান মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন শিয়া সশস্ত্র গোষ্ঠীকে সহায়তা করতে শুরু করে, যার মধ্যে রয়েছে লেবাননের হিজবুল্লাহ, ইরাক ও ইয়েমেনের শিয়া মিলিশিয়ারা। ফলে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের সঙ্গে ইরানের সম্পর্ক আরও অবনতির দিকে যায়।

ইরান-যুক্তরাষ্ট্র বৈরিতা আজও বহমান

৪০ বছরেরও বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও ইসলামি বিপ্লবের সময় সৃষ্ট বৈরিতা আজও রয়ে গেছে। ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি, সন্ত্রাসবাদে মদত দেওয়ার অভিযোগ, আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা, এবং যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা– সব মিলে সম্পর্ক ক্রমেই জটিল থেকে জটিলতর হয়েছে।

উপসংহার

শাহ মোহাম্মদ রেজা পাহলভির শাসনকালে ইরান ছিল যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মিত্রদের অন্যতম। কিন্তু শাহের স্বৈরশাসন, আভ্যন্তরীণ বৈষম্য, এবং ইসলামী সংস্কৃতির ওপর পাশ্চাত্য প্রভাব চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা– এসব কারণে জনগণের ক্ষোভ এক সময় বিস্ফোরিত হয়। আয়াতোল্লাহ খোমেইনির নেতৃত্বে ইসলামি বিপ্লবের মাধ্যমে শাহের পতন এবং ইসলামী প্রজাতন্ত্রের উত্থান দুই দেশের মধ্যে এক গভীর বৈরিতা শুরু করে, যা এখনও আন্তর্জাতিক রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে রয়েছে।

US ATTACK ON IRAN

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

যদি আপনার কোনও বিষয়ে ডাউট থাকে বা কোনও বিষয় suggest করতে চান তাহলে মেল করুন!

নবীনতর পূর্বতন

banglafacts 4