রাশিয়ার বৃহত্তম ড্রোন-মিসাইল হামলা: ২৮-২৯ জুন ইউক্রেন যুদ্ধের ভয়াবহ রাত

২৮-২৯ জুন ২০২৫ রাতে ইউক্রেনে রাশিয়ার ড্রোন ও মিসাইল হামলার দৃশ্য


২০২৫ সালের ২৮ জুন রাত থেকে ২৯ জুন সকাল পর্যন্ত ইউক্রেনের আকাশ জুড়ে এমন এক ভয়াবহ দৃশ্য দেখা গেল যা ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে শুরু হওয়া পূর্ণমাত্রিক রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ইতিহাসে নজিরবিহীন। ইউক্রেনীয় কর্মকর্তাদের মতে, রাশিয়া এক রাতেই ৫৩৭টিরও বেশি আকাশ-অস্ত্র ব্যবহার করেছে, যার মধ্যে ছিল শেহেদ ড্রোন, ক্রুজ ও ব্যালিস্টিক মিসাইল এবং হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র। এই ভয়ঙ্কর হামলা যুদ্ধের তীব্রতা কতটা বেড়েছে, তা স্পষ্ট করে দিয়েছে।

হামলার ব্যাপ্তি ও ব্যবহৃত অস্ত্রসমূহ

ইউক্রেনীয় বিমান প্রতিরক্ষা বাহিনী জানায়, রাশিয়ার এই হামলায় ব্যবহৃত ৫৩৭টি আকাশ-অস্ত্রের মধ্যে ছিল:

  • ৪৭৭টি শেহেদ টাইপের হামলা ড্রোন ও ডিকয় UAV।
  • ৬০টি বিভিন্ন ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র, যার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিল:
    • ৪টি খ-৪৭এম২ কিনঝাল হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র
    • ৭টি ইস্কান্ডার-এম/KN-২৩ ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র
    • ৪১টি খ-১০১ ও ইস্কান্ডার-কে ক্রুজ মিসাইল

এত বিপুল সংখ্যক ড্রোন ও মিসাইল একসঙ্গে ব্যবহার এই যুদ্ধে প্রথম, যা ইউক্রেনের বেসামরিক ও সামরিক অবকাঠামোতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা বাড়িয়ে দিয়েছে।

উৎক্ষেপণের স্থানসমূহ

রাশিয়ার এই সমন্বিত হামলা একাধিক স্থান থেকে পরিচালিত হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে:

  • কুর্স্ক, ওরিয়ল এবং ব্রায়ান্স্ক শহর
  • শাতালোভো, স্মোলেনস্ক ওবলাস্ট
  • দখলকৃত ক্রিমিয়ার কেইপ চাউডা

বিভিন্ন দিক থেকে একযোগে হামলা চালিয়ে ইউক্রেনের আকাশ প্রতিরক্ষাকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করা হয়, যাতে একসঙ্গে সর্বাধিক ক্ষতি সাধন সম্ভব হয়।

হামলার লক্ষ্যবস্তু

রাশিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা মূলত বেসামরিক স্থাপনা ও অবকাঠামোকে কেন্দ্র করে পরিচালিত হয়, যার মধ্যে রয়েছে:

  • আবাসিক ভবন
  • শিক্ষা প্রতিষ্ঠান
  • রেলপথ ও শিল্প-প্রতিষ্ঠান

টারনোপিল, ইভানো-ফ্রাঙ্কিভস্ক, চেরকাসি, মাইকোলাইভ, লভিভ ও পোলতাভা অঞ্চলে এ ধরনের হামলা সবচেয়ে বেশি লক্ষ্য করা গেছে। ইউক্রেনীয় কর্মকর্তারা বলেন, রাশিয়া এখন এমন কৌশল নিয়েছে যাতে বেসামরিক অঞ্চলে সর্বোচ্চ ক্ষয়ক্ষতি হয়, যাতে মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে এবং সরকারের উপর চাপ বাড়ে।

হতাহত ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ

হামলার কারণে অন্তত ছয়টি অঞ্চলে বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি ও হতাহতের খবর এসেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে কেন্দ্রীয় শহর স্মিলায়, যেখানে একটি শিশুসহ অন্তত ৬ জন আহত হয়।

সবচেয়ে বেদনাদায়ক খবর হলো, ইউক্রেনের এফ-১৬ যুদ্ধবিমানের পাইলট মাক্সিম উস্তিমেঙ্কো হামলা প্রতিহত করতে গিয়ে শহীদ হন। তিনি ৭টি আকাশযান ধ্বংস করেছিলেন। এই নিয়ে যুদ্ধের শুরু থেকে ইউক্রেনের ৩য় এফ-১৬ হারানোর ঘটনা এটি।

বিভিন্ন শিল্প-প্রতিষ্ঠানে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে, কিছু অঞ্চলে বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে এবং বসতবাড়ি ও অফিস-কারখানার ভেতরে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়।

ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা

রাশিয়ার এই বিপুল আকারের হামলা প্রতিহত করতে ইউক্রেন তার সমস্ত প্রতিরক্ষা শক্তি ব্যবহার করেছে। ইউক্রেনীয় বিমানবাহিনী জানায়:

  • ২৪৯টি ড্রোন ও মিসাইল ভূপাতিত করা সম্ভব হয়েছে।
  • আরও ২২৬টি ড্রোন হারিয়ে গেছে, যা সম্ভবত ইলেকট্রনিক জ্যামিংয়ের কারণে অথবা সেগুলি ডিকয় হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ায়।

এই হামলা প্রতিহত করতে ইউক্রেন তার এফ-১৬ যুদ্ধবিমানও মোতায়েন করেছিল, যা যুদ্ধের তীব্রতা বোঝাতে যথেষ্ট।

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া

রাশিয়ার এমন বিশাল আকারের হামলায় কেবল ইউক্রেন নয়, ইউরোপের অন্যান্য দেশও আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। প্রতিবেশী পোল্যান্ড ও তার মিত্র দেশগুলো আকাশপথের সুরক্ষার জন্য দ্রুত যুদ্ধবিমান মোতায়েন করে। পোলিশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানায়, পোল্যান্ডের আকাশসীমা রক্ষার জন্য প্রস্তুত রাখা হয়েছে জঙ্গিবিমান, যাতে রাশিয়ার কোনো ক্ষেপণাস্ত্র বা ড্রোন সীমান্ত অতিক্রম না করতে পারে।

যুদ্ধের বর্তমান প্রেক্ষাপট

২০২২ সালে রাশিয়ার পূর্ণমাত্রিক আক্রমণ শুরু হওয়ার পর থেকে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ একাধিক পর্যায়ে তীব্রতা পেয়েছে। কখনও সামরিক ফ্রন্টলাইনে অগ্রগতি হয়েছে, আবার কখনও দীর্ঘস্থায়ী স্থবিরতা দেখা গেছে। তবে সম্প্রতি রাশিয়া বড় আকারে ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা বাড়িয়েছে। অনেক পর্যবেক্ষক বলছেন, রাশিয়ার এ ধরনের হামলা মূলত ইউক্রেনের জনগণ ও অর্থনীতির মনোবল ভেঙে দেওয়ার কৌশল।

কেন হাইপারসনিক মিসাইল গুরুত্বপূর্ণ?

এই হামলায় রাশিয়া যে ৪টি খ-৪৭এম২ কিনঝাল হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করেছে, তা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ কিনঝাল মিসাইল ১০ গুণ শব্দের বেগে আঘাত হানতে সক্ষম, যা একে বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুতগতির অস্ত্রগুলোর একটি করে তুলেছে। ইউক্রেনের প্রচলিত বিমান প্রতিরক্ষার পক্ষে এ ধরনের মিসাইল থামানো অত্যন্ত কঠিন।

ইউক্রেনের এফ-১৬ বিমান বাহিনীর ভূমিকা

এই হামলায় এফ-১৬ যুদ্ধবিমানের ব্যবহার ইউক্রেনের জন্য একটি বড় পরিবর্তন। পশ্চিমা দেশগুলোর সহায়তায় ইউক্রেন সম্প্রতি এফ-১৬ ব্যবহারের অনুমতি পেয়েছে। এ ধরনের যুদ্ধবিমান শত্রু ড্রোন ও মিসাইল ধ্বংস করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে, কিন্তু এরই মধ্যে তিনটি এফ-১৬ হারানো ইউক্রেনের জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

রাশিয়ার লক্ষ্য কী?

বিশ্লেষকদের মতে, রাশিয়ার এমন একযোগে বড় আকারের হামলা মূলত ইউক্রেনের সামরিক ও বেসামরিক অবকাঠামোতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ঘটিয়ে পশ্চিমা মিত্রদের মধ্যে বিভাজন তৈরি করা। একইসঙ্গে ইউক্রেনীয় জনগণের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে দিয়ে তাদের সরকারকে চাপের মুখে ফেলাই এর উদ্দেশ্য।

ইউক্রেনের জন্য ভবিষ্যত চ্যালেঞ্জ

এই হামলার পর আন্তর্জাতিক মহলে নতুন করে আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে ইউক্রেনের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। বর্তমানে ইউক্রেনের হাতে কিছু পশ্চিমা সরবরাহকৃত প্যাট্রিয়ট ও আইআরআইএস-টি ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা থাকলেও রাশিয়ার বড় আকারের হামলা ঠেকাতে তা পর্যাপ্ত নয়।

যুদ্ধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইউক্রেনকে অবিলম্বে আরও শক্তিশালী ও আধুনিক আকাশ প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম দিতে হবে। তা না হলে এ ধরনের হামলা ভবিষ্যতেও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ডেকে আনতে পারে।

আন্তর্জাতিক সহায়তার গুরুত্ব

পোল্যান্ড ও অন্যান্য ন্যাটো দেশের সতর্কতা যুদ্ধের সম্প্রসারণ নিয়ে নতুন শঙ্কা তৈরি করেছে। ইউক্রেনকে অস্ত্র ও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় সহায়তা অব্যাহত রাখা না গেলে কেবল ইউক্রেন নয়, পুরো ইউরোপেই নিরাপত্তার ঝুঁকি বাড়তে পারে বলে সতর্ক করেছেন বিশ্লেষকরা।

উপসংহার

২৮-২৯ জুনের এই হামলা রাশিয়ার নতুন কৌশল ও যুদ্ধের তীব্রতা আরও একবার স্পষ্ট করেছে। ইউক্রেনের আকাশ প্রতিরক্ষার সীমাবদ্ধতা এবং আরও আন্তর্জাতিক সহায়তার প্রয়োজনীয়তা এ হামলার মাধ্যমে নতুন করে সামনে এসেছে। যুদ্ধের অবসান নিয়ে আলোচনা যতই চলুক, ময়দানে এখনো যে হিংস্র বাস্তবতা বিরাজ করছে, তা এই হামলা পুরো দুনিয়াকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

যদি আপনার কোনও বিষয়ে ডাউট থাকে বা কোনও বিষয় suggest করতে চান তাহলে মেল করুন!

নবীনতর পূর্বতন

banglafacts 4