মার্কিন রাজনীতির রঙ্গমঞ্চে এক নাটকীয় দ্বন্দ্ব শুরু হয়েছে: সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং টেসলা ও স্পেসএক্সের কর্ণধার এলন মাস্কের মধ্যে। এক সময়ের মিত্র এই দুই ক্ষমতাধর ব্যক্তি এখন একে অপরের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে বিবাদে লিপ্ত। কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে ট্রাম্পের “ওয়ান বিগ বিউটিফুল বিল” — একটি বিপুল ট্যাক্স ছাড় এবং সরকারি ব্যয়ের প্রস্তাব, যা মাস্ক “সম্পূর্ণ পাগলামি ও ধ্বংসাত্মক” বলে উল্লেখ করেছেন। মাস্ক এমনকি হুমকি দিয়েছেন, বিলটি পাস হলে তিনি “আমেরিকা পার্টি” নামে নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করবেন।
এই বিবাদ শুধু ব্যক্তিগত আক্রমণেই সীমাবদ্ধ নেই। ট্রাম্প প্রকাশ্যে মাস্ককে দক্ষিণ আফ্রিকায় “ফিরে যেতে” বলার ইঙ্গিত দিয়েছেন, এবং মাস্কের কোম্পানিগুলোর সরকারি ভর্তুকি খতিয়ে দেখতে সরকারের ডিপার্টমেন্ট অফ গভর্নমেন্ট এফিসিয়েন্সি (DOGE)-কে নির্দেশ দেওয়ার হুমকিও দিয়েছেন। এই অভূতপূর্ব সংঘর্ষ আমেরিকার প্রযুক্তি এবং রাজনৈতিক অঙ্গনের গভীর ফাটলকে সামনে এনেছে।
বিতর্কের সূচনা: ‘ওয়ান বিগ বিউটিফুল বিল’ এবং মাস্কের রোষ
বিতর্ক শুরু হয় ট্রাম্পের “ওয়ান বিগ বিউটিফুল বিল” ঘোষণার মাধ্যমে, যা বিপুল করছাড় এবং ফেডারেল ব্যয়ের হ্রাসের একটি প্যাকেজ। বিলের মাধ্যমে ধনীদের জন্য করছাড় এবং বৈদ্যুতিক যানবাহনের (EV) ট্যাক্স ক্রেডিট বাতিলের প্রস্তাব রাখা হয়েছে।
মাস্ক, যিনি সবুজ প্রযুক্তির এক শীর্ষ প্রচারক, একে “উন্মাদনা” বলে উল্লেখ করেন এবং সতর্ক করেন যে EV ক্রেডিট বাতিল হলে শুধু টেসলা নয়, আমেরিকার সমগ্র ইলেকট্রিক গাড়ির শিল্প বিপদের মুখে পড়বে। পরক্ষণেই তিনি সরকারি ভর্তুকি বন্ধ করারও আহ্বান জানান, যাতে “সত্যিকারের মুক্ত বাজার” প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ট্রাম্পের অর্থনৈতিক নীতির দ্বিচারিতা প্রকাশ পায়।
ট্রাম্পের পাল্টা আক্রমণ: হুমকি, অপবাদ, এবং বিতাড়নের ইঙ্গিত
ট্রাম্প, যিনি আগেও রাজনৈতিক শত্রুদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছেন, মাস্ককেও ছাড়েননি। ট্রুথ সোশ্যাল-এ পোস্ট করে তিনি বলেন, মাস্ক “ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি ভর্তুকি পাওয়া মানুষ” এবং সরকারী সাহায্য ছাড়া টেসলা, স্পেসএক্স কিছুই করতে পারতো না। তিনি বলেন, “মাস্ককে দোকান বন্ধ করে দক্ষিণ আফ্রিকায় ফিরে যেতে হতে পারে।” সাংবাদিকরা স্পষ্টভাবে জানতে চাইলে ট্রাম্প উত্তর দেন, “দেখা যাক কী করা যায়।”
সবচেয়ে বড় কথা, তিনি DOGE-এর মাধ্যমে মাস্কের কোম্পানিগুলোর ভর্তুকি পুনর্বিবেচনার হুমকি দেন, যা কার্যত সরকারি ক্ষমতার অপব্যবহারের ইঙ্গিত।
মাস্কের জবাব: “সব কেটে ফেলুন”
ট্রাম্পের আক্রমণের জবাবে মাস্ক এক চরমপন্থী প্রতিক্রিয়া দেন: “CUT IT ALL” অর্থাৎ সব ভর্তুকি বন্ধের আহ্বান জানান। তার মতে, প্রকৃত মুক্ত বাজারে কোনো কর্পোরেট ভর্তুকির প্রয়োজন নেই। সমর্থকরা একে মাস্কের নির্ভীকতা বললেও, সমালোচকরা একে ভণ্ডামি মনে করছেন, কারণ মাস্কের কোম্পানিগুলো বছরের পর বছর বিপুল সরকারি সাহায্য নিয়েই বড় হয়েছে।
মাস্কের ভর্তুকি ইতিহাস
টেসলা গাড়ির জন্য ফেডারেল এবং বিভিন্ন রাজ্যের EV করছাড়, স্পেসএক্সের নাসা এবং পেন্টাগনের মাল্টি-বিলিয়ন ডলারের চুক্তি, এমনকি সোলারসিটির জন্যও প্রণোদনা — সবই মাস্কের কোম্পানিগুলোর দ্রুত বৃদ্ধিতে ভূমিকা রেখেছে। যদিও ট্রাম্পের অভিযোগ অতিরঞ্জিত, বাস্তবে মাস্কের ব্যবসা সরকারী সহায়তায় উপকৃত হয়েছে, যেমনটি বহু মার্কিন কর্পোরেশনই হয়।
বন্ধু থেকে শত্রু: ট্রাম্প-মাস্ক সম্পর্ক
২০১৭ সালে ট্রাম্পের বিজনেস অ্যাডভাইসরি কাউন্সিলে মাস্ক ছিলেন। ট্রাম্প তখন প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন, আর মাস্ক সেই প্রতিবাদে পদত্যাগ করেন। এরপর সম্পর্ক শীতল থাকলেও প্রকাশ্যে এমন তীব্র আক্রমণ এই প্রথম দেখা গেল।
রাজনৈতিক প্রভাব: রিপাবলিকান বিভক্তির শঙ্কা
মাস্কের প্রস্তাবিত “আমেরিকা পার্টি” যদি সত্যি হয়, তবে তা রিপাবলিকান ভোটারদের মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টি করতে পারে। মাস্কের অনুগামীদের বড় অংশ তরুণ রক্ষণশীল, যারা ট্রাম্পের পরিবর্তে মাস্কের দিকেই ঝুঁকতে পারে। এটি ২০২৮ সালের নির্বাচনে ভোটের হিসাব পাল্টে দিতে পারে।
ব্যবসায়িক প্রভাব: টেসলা, স্পেসএক্স এবং বাজার
ট্রাম্পের হুমকির পর টেসলার শেয়ারপত্রে পতন দেখা দিয়েছে। কারণ EV করছাড় বন্ধ হলে টেসলার গাড়ির দাম কার্যত বাড়বে। স্পেসএক্সের নাসা ও পেন্টাগনের চুক্তিও রাজনৈতিক চাপের শিকার হতে পারে, যা মহাকাশ অভিযানে প্রভাব ফেলতে পারে।
আইনগত ও সাংবিধানিক দিক
একজন প্রাকৃতিক নাগরিককে (মাস্ক ২০০২ সালে মার্কিন নাগরিকত্ব পেয়েছেন) বিতাড়নের হুমকি দেওয়া আইনগতভাবে অবৈধ এবং সাংবিধানিক অধিকার লঙ্ঘন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ট্রাম্পের এমন বক্তব্য গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে আঘাত করছে।
ভর্তুকি বনাম মুক্ত বাজার বিতর্ক
এই দ্বন্দ্ব আবার সামনে এনেছে মূল বিতর্ক: সরকার কি শিল্পকে ভর্তুকি দিয়ে গাইড করবে, নাকি পুরো বাজারের হাতে ছেড়ে দেবে? মাস্কের অবস্থান, ভর্তুকি পুরোপুরি বন্ধ করা উচিত। কিন্তু সমালোচকরা বলছেন, মাস্কের কোম্পানির শুরুতে এই ভর্তুকিগুলোই তাকে শীর্ষে নিয়ে এসেছে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যুদ্ধ
এই দ্বন্দ্ব সোশ্যাল মিডিয়ায় তুফান তুলেছে। মাস্ক ও ট্রাম্প উভয়ের বিশাল ফলোয়ারবেস একে এক নতুন মাত্রায় নিয়ে গেছে। এ নিয়ে মিম, ট্রেন্ড, লাইভ বিতর্ক হচ্ছে সর্বত্র, যা আমেরিকার রাজনৈতিক সংস্কৃতি আরও নাটকীয় করে তুলছে।
বৈশ্বিক প্রভাব: চীন, ইউরোপ ও EV শিল্প
মাস্কের টেসলা চীনের গিগাফ্যাক্টরির উপর নির্ভরশীল। যদি আমেরিকায় EV ক্রেডিট বন্ধ হয়, চীনা কোম্পানি BYD বা NIO টেসলার বাজার দখল করে নিতে পারে। ইউরোপে EV ভর্তুকি চালু থাকায়, ইউরোপীয় কোম্পানিরাও বাড়তি সুবিধা পাবে, যা আমেরিকান প্রযুক্তি নেতৃত্বের জন্য ক্ষতিকর।
ভবিষ্যতের সম্ভাবনা
- মাস্ক পিছু হটতে পারেন — সম্ভাবনা কম।
- ট্রাম্প হুমকি থেকে সরে আসতে পারেন — নির্বাচনের ক্ষতি হলে এমনটা হতে পারে।
- বিবাদ তীব্র হতে পারে — আইনি ও ব্যবসায়িক জটিলতা বাড়াবে।
- মাস্কের নতুন পার্টি সত্যি গঠন হতে পারে — যা রাজনৈতিক মানচিত্র বদলে দিতে পারে।
উপসংহার
এই দ্বন্দ্ব প্রমাণ করেছে, মার্কিন পুঁজিবাদ ও রাজনীতির মধ্যে কতটা গভীর দ্বন্দ্ব রয়েছে। ভর্তুকি নির্ভরতার প্রশ্নে দুই শক্তিশালী ব্যক্তি এমন লড়াইয়ে নেমেছেন, যা আমেরিকার প্রযুক্তি, অর্থনীতি ও রাজনীতির ভবিষ্যত নির্ধারণ করতে পারে। ট্রাম্প-মাস্ক সংঘর্ষ এখন শুধু ব্যক্তিগত লড়াই নয়, বরং আমেরিকার প্রযুক্তি নেতৃত্ব, মুক্ত বাজারের নীতি এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের একটি বড় পরীক্ষা।