ইরানের ফোরদো পারমাণবিক কেন্দ্র: গবেষণা না বোমা?

 

ইরানের ফোরদো পারমাণবিক স্থাপনা: শান্তিপূর্ণ গবেষণা না কি যুদ্ধের প্রস্তুতি?

9913ef91-4c8f-4979-8762-bfabd09d950d

ভূমিকা
ইরানকে ঘিরে পারমাণবিক বিতর্ক দীর্ঘদিন ধরে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। বিশেষ করে ফোরদো পারমাণবিক স্থাপনা (Fordow Nuclear Facility), যা সরকারিভাবে শাহিদ আলী মোহাম্মাদি পারমাণবিক স্থাপনা (Shahid Ali Mohammadi Nuclear Facility) নামে পরিচিত, বর্তমানে বিশ্ব রাজনীতিতে উদ্বেগের অন্যতম উৎসে পরিণত হয়েছে। এই গোপন, শক্তভাবে সুরক্ষিত এবং পাহাড়ের গভীরে নির্মিত স্থাপনাটি ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

এই নিবন্ধে আমরা বিশ্লেষণ করব ফোরদো স্থাপনার অবস্থান, গঠন, ইতিহাস, উদ্দেশ্য, ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধির মাত্রা, আন্তর্জাতিক উদ্বেগ এবং সাম্প্রতিক ঘটনা ও সম্ভাব্য পরিণতি।


ফোরদো স্থাপনার অবস্থান ও গঠন

ফোরদো পারমাণবিক স্থাপনাটি ইরানের উত্তর-পশ্চিমে, কোম (Qom) শহর থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এটি পূর্বে ইসলামী বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর (IRGC) একটি সামরিক ঘাঁটি ছিল।

এই স্থাপনাটি পর্বতের নিচে, প্রায় ৮০-৯০ মিটার (২৬০-২৯৫ ফুট) গভীরে নির্মিত হয়েছে। চারপাশে পুরু কংক্রিটের দেয়াল ও বহুস্তরীয় বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার দ্বারা এটি সুরক্ষিত। এর গভীর অবকাঠামো এবং শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা একে প্রচলিত বোমা বা বিমান হামলা থেকে কার্যত অপ্রতিরোধ্য করে তোলে।

ফোরদোর স্থাপনায় রয়েছে:

  • প্রশস্ত ভূগর্ভস্থ টানেল
  • কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা
  • উন্নত শীতলীকরণ (cooling) সিস্টেম
  • নির্দিষ্ট বিদ্যুৎ সরবরাহ নেটওয়ার্ক

ইতিহাস ও নির্মাণকাল

ইরান ২০০৬ সালে ফোরদো স্থাপনায় নির্মাণ কাজ শুরু করলেও, ২০০৯ সাল পর্যন্ত এই প্রকল্পের অস্তিত্ব গোপন রেখেছিল। পরবর্তীতে পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থাগুলি এর অস্তিত্ব প্রকাশ করে, এবং ইরান বাধ্য হয়ে ২০০৯ সালের সেপ্টেম্বরে আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি সংস্থা (IAEA)-কে এর কথা জানায়।

তখন ইরান দাবি করে যে এই স্থাপনাটি ইউরেনিয়াম হেক্সাফ্লোরাইড (UF6) গ্যাস উৎপাদনের জন্য ব্যবহৃত হবে, যা প্রায় ৫% ইউ-২৩৫ (Uranium-235) সমৃদ্ধ। পরিকল্পনা ছিল প্রায় ৩,০০০ সেন্ট্রিফিউজ বসানোর।


২০১৫ সালের পরমাণু চুক্তি (JCPOA) ও তার প্রভাব

২০১৫ সালে স্বাক্ষরিত যুগান্তকারী যৌথ সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা (JCPOA) অনুযায়ী, ইরান ফোরদোতে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ ও গবেষণা কার্যক্রম ১৫ বছরের জন্য বন্ধ করতে সম্মত হয়। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী, স্থাপনাটি একটি পারমাণবিক গবেষণা ও প্রযুক্তি কেন্দ্রে পরিণত করা হয়।

ফোরদোতে তখন শুধুমাত্র ১,০৪৪টি IR-1 ধরনের সেন্ট্রিফিউজ রাখা অনুমোদিত ছিল। তবে সেগুলি দিয়ে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কার্যক্রম পরিচালনা নিষিদ্ধ ছিল।


চুক্তি ভঙ্গ ও পুনরায় সমৃদ্ধকরণ কার্যক্রম

২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প JCPOA থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নেন। এর ফলে চুক্তিটি কার্যত ভেঙে পড়ে এবং ইরান ধীরে ধীরে আবারও পারমাণবিক কার্যক্রম শুরু করে।

ইরান জানায়, তারা ফোরদোতে পুনরায় ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করতে শুরু করেছে, এবং তাদের দাবি অনুযায়ী, এই গবেষণা শুধুমাত্র শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যে, যেমন চিকিৎসা গবেষণা ও ক্যানসারের চিকিৎসায় ব্যবহৃত আইসোটোপ উৎপাদনের জন্য। তবে যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য পশ্চিমা দেশগুলো মনে করে, ইরান এই স্থাপনাকে গোপনে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করার উদ্দেশ্যে ব্যবহার করছে।


ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধির মাত্রা ও আন্তর্জাতিক উদ্বেগ

ফোরদো স্থাপনাটি বর্তমানে আন্তর্জাতিক মহলে বিশেষভাবে উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ:

  • এটাই একমাত্র ইরানি স্থাপনা যেখানে IAEA পরিদর্শকরা অস্ত্র-মানব ইউরেনিয়ামের কাছাকাছি পরিশোধিত কণার সন্ধান পেয়েছেন।
  • জানুয়ারি ২০২৩: IAEA জানায়, ইরান ফোরদোতে দুটি সেন্ট্রিফিউজ চক্র যুক্ত করেছে, যার মাধ্যমে তারা ৬০% মাত্রায় ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করছে — যা শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যে প্রয়োজনীয় মাত্রার অনেক ঊর্ধ্বে।
  • মার্চ ২০২৩: IAEA নিশ্চিত করে যে তারা ৮৩.৭% মাত্রার সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম কণা শনাক্ত করেছে। উল্লেখ্য, ৯০% ইউ-২৩৫ সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামকেই পারমাণবিক অস্ত্রের জন্য ব্যবহৃত করা যায়।

এই মাত্রার ইউরেনিয়াম সংরক্ষণ ও উৎপাদন কোনোভাবেই শান্তিপূর্ণ গবেষণার আওতায় পড়ে না বলে আন্তর্জাতিক মহলের অভিমত।


সাম্প্রতিক ঘটনাবলি (জুন ২০২৫ পর্যন্ত)

২০২৫ সালের জুন মাসে ইরানে একাধিক পারমাণবিক স্থাপনায় হামলার খবর সামনে আসে। পশ্চিমা মিডিয়া ও কিছু ইসরায়েলি সূত্র জানায় যে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র যৌথভাবে কিছু গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় হামলা চালিয়েছে, যার মধ্যে ফোরদোও রয়েছে বলে দাবি করা হয়।

একটি বিস্ফোরণের খবর পাওয়া গেলেও, আন্তর্জাতিক পরমাণু সংস্থা (IAEA)-এর মহাপরিচালক রাফায়েল গ্রোসি বলেন, “ফোরদো ফুয়েল এনরিচমেন্ট প্ল্যান্টে কোনো দৃশ্যমান ক্ষতির প্রমাণ নেই।”

এরপরও বিশেষজ্ঞ মহল মনে করে যে:

  • ফোরদোর অবস্থান ভূগর্ভে এবং তার চারপাশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এতটাই শক্তিশালী যে সাধারণ বোমা বা বিমান হামলা এটি ধ্বংস করতে পারবে না।
  • তাই, ইসরায়েলের দাবি সত্ত্বেও, স্থাপনাটি কার্যত অক্ষত এবং সম্পূর্ণভাবে চালু রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।

বিশ্ব রাজনীতিতে ফোরদোর তাৎপর্য

ফোরদো পারমাণবিক স্থাপনাটি আজ শুধুমাত্র একটি গবেষণাগার নয়, বরং এটি বিশ্ব কূটনীতি, নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা কৌশলের একটি মোক্ষম দৃষ্টান্তে পরিণত হয়েছে।

কেন এটি গুরুত্বপূর্ণ?

  • এটি স্পষ্ট যে, ফোরদো কৌশলগতভাবে এমনভাবে গঠিত যাতে এটি সহজে ধ্বংসযোগ্য না হয়।
  • উচ্চমাত্রায় ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধির ক্ষমতা থাকায় এটি ইরানকে স্বল্প সময়ে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির সামর্থ্য দেয়।
  • এর অস্তিত্ব ও কার্যকলাপ মধ্যপ্রাচ্যে অস্ত্র প্রতিযোগিতাকে আরও উসকে দিতে পারে।

উপসংহার

ফোরদো পারমাণবিক স্থাপনাটি এখন আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য একটি প্রধান উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যদিও ইরান বারবার দাবি করে আসছে যে তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি শান্তিপূর্ণ, তবে বাস্তবতা ও IAEA-এর পর্যবেক্ষণ অন্যরকম ইঙ্গিত দেয়।

এই মুহূর্তে ফোরদো শুধুমাত্র ইরানের নিজস্ব নিরাপত্তা নীতি নয়, বরং বৈশ্বিক কূটনীতির জন্যও একটি লিটমাস টেস্ট। শান্তিপূর্ণ সমাধান ও কূটনৈতিক আলোচনার মাধ্যমে এই সংকট থেকে উত্তরণই আন্তর্জাতিক সমাজের জন্য শ্রেয়। তবে তার আগে, আরও স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও IAEA-এর কার্যকর পরিদর্শন নিশ্চিত করাই একান্ত প্রয়োজন।


পাঠকের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন:
আপনার মতে, ইরান কি সত্যিই শান্তিপূর্ণ গবেষণার জন্য ফোরদো ব্যবহার করছে, নাকি এটি ভবিষ্যৎ পারমাণবিক অস্ত্র প্রস্তুতির একটি অংশ? মতামত জানাতে মন্তব্য করুন।


সোর্স: আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা, IAEA রিপোর্ট, বিশেষজ্ঞ মতামত
ভাষান্তর ও বিশ্লেষণ: ChatGPT | অনুবাদ ও সম্পাদনা: বিস্বদীপ মাহাতো (আপনার নাম দিলে এখানে যুক্ত করতে পারি)


আরও বিশ্লেষণধর্মী রাজনৈতিক ও বৈজ্ঞানিক প্রতিবেদন পেতে আমাদের পেজে যুক্ত থাকুন।

#IranNuclearProgram #FordowFacility #IAEA #MiddleEastPolitics #BengaliArticle

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

যদি আপনার কোনও বিষয়ে ডাউট থাকে বা কোনও বিষয় suggest করতে চান তাহলে মেল করুন!

নবীনতর পূর্বতন

banglafacts 4